এডিটর’স মাইন্ড

মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান পত্নী এবং পরিজন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৪ মে, ২০২২


Thumbnail মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান পত্নী এবং পরিজন

১৯৯৮ সাল। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আওয়ামী লীগ। জিল্লুর রহমান একাধারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সহধর্মিণী আইভি রহমান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য জিল্লুর রহমানের দফতরে গেছি। আমরা ক্যামেরা লাইট এসব ঠিক করছি। এ সময় আরও দু-একজন নেতা নিয়ে মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলেন আইভি রহমান। আইভি রহমানকে বসিয়েই মন্ত্রী গেলেন ভিতরের ছোট কক্ষে। এ সময় মন্ত্রীর টেবিলে থাকা লাল ফোন বেজে উঠল। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে আমি আইভি রহমানকে বললাম ফোনটা ধরতে। আইভি রহমান ফোনটা ধরলেন না। পরে মন্ত্রী এসে দেখলেন। ফোনটা এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। জিল্লুর রহমান ফোন করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত কথা বলে রেখে দিলেন। সাক্ষাৎকার শেষ করে বিদায় নিচ্ছি। তখন আইভি রহমান আমাকে বললেন, ‘শোন ওটা লাল ফোন। লাল ফোন যার নামে তিনি ছাড়া এটা ধরার এখতিয়ার কারও নেই।’ আইভি রহমানের এই কথাটার তাৎপর্য যথার্থ বুঝলাম এত বছর পর। রেলমন্ত্রীর ৯ মাসের দাম্পত্য সঙ্গীর ক্ষমতার দাপট দেখে। আওয়ামী লীগে আইভি রহমান জনপ্রিয় মুখ ছিলেন। তাঁর নিজস্ব পরিচয় ছিল। কিন্তু তারপরও মন্ত্রীর লাল ফোন তিনি ধরেননি। আর রেলমন্ত্রীর পত্ন্নী ৯ মাস হলো বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রেল মন্ত্রণালয়কেই অস্থির করে তুলেছেন। রেলের টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করার আগে অবশ্য রেলমন্ত্রীর নবপরিণীতার ক্ষমতা সম্পর্কে আমজনতা খুব একটা জানত না। বিয়ের ৯ মাসে তিনি কেবল তার স্বামীকেই আপন করে নেননি। রেল মন্ত্রণালয়কেও সংসারের একটা অংশ বানিয়ে ফেলেছেন। এখন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, মন্ত্রীপত্নীর সিন্ডিকেটের। মন্ত্রীপত্নী ঠিকাদারি, টিকিট কিংবা অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কি না সে বিতর্কে আমি যাব না। রেলমন্ত্রী এসব জানতেন কি না, সে প্রশ্নও আমি করব না। তবে রেলমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ৯ মাস। এখনো তার বোঝার অনেক বাকি।’ তার এই বক্তব্যের সহজীকরণ করলে যা দাঁড়ায়, মন্ত্রীপত্নী এখনো ‘অবুঝ বধূ’। বাংলা সাহিত্য ঘাঁটলেই অবুঝ বধূদের নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিপত্তির কথা জানা যায়। তবে রেলমন্ত্রীর অবুঝ স্ত্রীর এই অধ্যায়টি সাহিত্য বা ইতিহাসে স্থান পাবে কি না আমরা এখনো জানি না। গণমাধ্যমে এ বিষয়টি এমনভাবে আসছে যাতে মনে হতে পারে শুধু রেলমন্ত্রীর স্ত্রীই বোধহয় ‘ক্ষমতাবান’। কিন্তু বাস্তবতা তেমনটি নয়। রেলমন্ত্রীর পত্নী আলোচনায় এসেছেন একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কয়েক মাস ধরেই মন্ত্রণালয়ের লোকজন তার ক্ষমতার উত্তাপের আঁচ পেয়েছেন। আবার রেলমন্ত্রীর পত্নী এবং পত্নীপরিজন যেভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন, সেভাবে আর কেউ দেখান না এমনটি নয়। কান পাতলেই শোনা যায় অনেক মন্ত্রীর পরিজনের ক্ষমতার দাপটের কথা। অনেক মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন মন্ত্রীদের নিকটজনরা। টিটিই শফিকুলের মতো কোনো ঘটনা ঘটে না এ জন্যই এসব গণমাধ্যমে আসে না। কিন্তু কান পাতলেই এসব ক্ষমতার দাপটের কথা শোনা যায়। একজন মন্ত্রীপুত্র অভিজাত এলাকায় আলাদা অফিস নিয়েছেন। সেখানে ঠিকাদাররা নিয়মিত যান। দেন-দরবার হয়। মন্ত্রীপুত্র সরকারি একান্ত গোপনীয় ফাইল দেখেন। মন্ত্রীপুত্রের কথা অনুযায়ী মন্ত্রী ফাইলে স্বাক্ষর করেন। একজন মন্ত্রীর স্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প দেখভাল করেন। মন্ত্রীপত্নীর প্রতিনিধি হিসেবে আছেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব। এপিএস ছাড়া ওই মন্ত্রী কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করেন না। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের চারপাশে দেখা যায়। মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতায় তখন তার নিকটজনরা মধু খাবেন এটা স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ এটাকে মেনেই নিয়েছে। যারা মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার বাণিজ্যে নেই তারা আছেন বিদেশ ভ্রমণ। মন্ত্রীরা যখন বিদেশ সফরে আত্মীয়-পরিজনকে নিয়ে একটু আনন্দ ভ্রমণ করেন, তখন আমলা এবং অধস্তন কর্মকর্তারা কীভাবে চুপচাপ বসে থাকবেন। সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি সফর তালিকায় চোখ রাখলাম। ৫৫ জনের বিশাল বহর। তালিকায় এক প্রতিমন্ত্রীর দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ জিনিসটা কী বোঝার জন্য একটু খোঁজখবর নিলাম। জানা গেল ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হলো আসলে চাকর-বাকর। কোটটা পরিয়ে দেবে। জুতাটা পায়ে গলিয়ে দেবে। গালে ময়লা লাগলে টিস্যু দিয়ে মুছে দেবে। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অনেক কাজ। তাই একজন প্রতিমন্ত্রী দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করবেন, এতে অবাক হওয়ার কী আছে। প্রতিমন্ত্রী যখন দুজন চাকর-বাকর (ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) নিয়ে যাচ্ছেন, তখন তার মা-বোন না গেলে বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড হবে না। এটা তো রীতিমতো গৃহবিবাদ সৃষ্টি করবে। প্রতিমন্ত্রী বুদ্ধিমান, তাই তার মা এবং বোনকেও সফরসঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী যদি তার পারিবারিক সুখ সুরক্ষায় মনোযোগী হন, তাহলে তার অধস্তন কর্মকর্তারাও তো তা অনুসরণ করবেন। না হলে, সেটা হবে অবাধ্যতা। তাই এই মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার স্ত্রী-কন্যাকে সঙ্গী করেছেন। প্রতিমন্ত্রীরা যদি চৌদ্দগোষ্টিকে সফরসঙ্গী করেন, তাহলে এমপিরা কি বিদেশে গিয়ে নিঃসঙ্গতাকে বরণ করবেন? এটা কী করে হয়? তাই সফর তালিকায় থাকা এমপি তার স্ত্রীকেও সঙ্গী করেছেন। সংসদ সদস্য মানে তো শুধু পুরুষ নন, নারীরাও এখন সংসদ সদস্য হচ্ছেন। নির্বাচন করে অথবা কোটায়। পুরুষ সদস্য যদি তার পত্নীকে সফরসঙ্গী করেন, তাহলে বিষয়টি ভারী পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যায়। এ জন্য সফরে যাওয়া মহিলা এমপিও তার স্বামীকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বামীকে একা রেখে যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। এভাবে পারিবারিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রাষ্ট্রের পয়সায় বিদেশ যাওয়াটা এখন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিমন্ত্রী বিদেশযাত্রায় পারিবারিক ব্যাপ্তি আরও বড় করেছেন। প্রতিমন্ত্রী যাচ্ছেন সুইজারল্যান্ড। অপরূপ সুন্দর দেশ। এমন দেশে একা যাওয়া রীতিমতো গর্হিত কাজ। এ জন্য প্রতিমন্ত্রী তার নিকটজনের কাউকে বাদ দেননি। প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে, মেয়ের জামাই এমনকি প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাইও সফরসঙ্গী। প্রতিমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তাও তার স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়েছেন সঙ্গী হিসেবে। মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের এক রকম যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণ প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। বুধবার অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী অযথা বিদেশ ভ্রমণ না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার মর্মার্থ কি আমাদের মন্ত্রী মহোদয়গণ অনুভব করবেন? যেসব মন্ত্রীর আত্মীয়-পরিজন মন্ত্রণালয়ে নেই। প্রমোদ বিহারের সঙ্গী নন, তাদেরও দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা এলাকায় আছেন। মন্ত্রীদের এখন ক্লোন হচ্ছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন আর তাদের ভাই-ব্রাদাররা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাইয়েরাই এলাকায় মন্ত্রী কিংবা তার চেয়েও ক্ষমতাবান। একজন মন্ত্রী ভাইদের বিশ্বাস করেন না। নিজের স্ত্রীকেই স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন। জিতিয়ে এনেছেন। তাদের কথায় এলাকার প্রশাসন ওঠবস করে। জনগণ তটস্থ থাকে। কিছুদিন আগে সাবেক এক মন্ত্রীর ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। মন্ত্রীর চেয়েও তিনি এলাকায় ক্ষমতাবান ছিলেন। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন স্রেফ দুর্নীতি করে। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আগে তাকে নিয়ে কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। এখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ভাইদের নানা কথা বাতাসে ভাসে। কোনো মন্ত্রীর ভাই নদী দখল করে জমির মালিক হয়েছেন। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে আবার জমি সরকারের কাছে বিক্রির পাঁয়তারা করেছেন, সে খবর আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার কোনো কোনো মন্ত্রীর ভাইয়েরা ভীষণ চতুর। তারা কাজ করেন নীরবে, নিভৃতে। মন্ত্রীর ভাইয়েরা যে এলাকায় অঘোষিত মন্ত্রী এমনটা কিন্তু নয়। অনেক মন্ত্রীর পত্নীও এলাকায় ব্যাপক আলোচিত। কোনো কোনো মন্ত্রীর সহধর্মিণী মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় নেমেছেন। স্বামী সামনে মন্ত্রীর চেয়েও বড় পদে যাবেন। এলাকায় নির্বাচন করবেন না। তিনিই আগামী দিনের প্রার্থী। এমন ঘোষণার কথাও কোথাও কোথাও শোনা যায়। এসব সত্য না মিথ্যা সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু জনগণের মধ্যে এসব নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ ধারণাগুলো সংক্রামক। বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারাই আজকাল বলাবলি করেন, কিছু মন্ত্রী সরকারকে লজ্জায় ফেলছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মন্ত্রী এবং তার পত্নীপরিজনের জন্য লজ্জিত হলেও মন্ত্রীরা কি তার স্বজনদের নিয়ে লজ্জিত? আওয়ামী লীগের এই ‘সৌভাগ্যবান’ মন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নাম বলে মাতম করেন। কিন্তু জাতির পিতার আদর্শ এবং জীবনাচার কতটুকু অনুসরণ করেন? জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা কী সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আজকাল ভিআইপি বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছু কিছু মন্ত্রীর পত্নীদের দেখলে মনে হয় যেন আস্ত একটা সোনার দোকান গায়ে জড়িয়েছেন। বঙ্গমাতা কোনো দিন রাষ্ট্রীয় কাজে নাক গলাননি। তিনি ছিলেন দুঃসময়ের কাণ্ডারি। দল যখন বিপর্যস্ত, বঙ্গবন্ধু যখন কারাবন্দি তখন দলের হাল ধরেছেন। কিন্তু কোনো পদ নেননি। বঙ্গবন্ধু মহামানব। বঙ্গমাতার উচ্চতায় এখন আর কারও পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু শেখ হাসিনার জীবনাচার তো স্বজনকাতর মন্ত্রীদের অজানা থাকার কথা নয়। ’৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করতেন। ওয়াজেদ মিয়ার চাকরি শেষ হওয়ার পর অবসরে যান। শেখ হাসিনা তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেননি। এটাই শেখ হাসিনার আদর্শ। ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে ড. ওয়াজেদ মিয়া কটি বিদেশ সফরে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসেবে সরকারি গাড়ি তাঁর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া কোনো দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকলের গাড়ি ব্যবহার করেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তার কদিন বাদেই (২০০৯-এর মে মাসে) মৃত্যুবরণ করেন এই অসামান্য মেধাবী মানুষটি। শেখ হাসিনার পরিবারের অন্য সদস্যরাও কখনো ‘ক্ষমতাবান’ হিসেবে আবির্ভূত হননি। ক্ষমতার দাপট দেখাননি। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ অটিজম নিয়ে কাজ করেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশে^ তিনি অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশও অটিজমকে গুরুত্ব দিয়েছে সায়মা ওয়াজেদের একান্ত পরিশ্রমের জন্যই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অটিজম সেল হয়েছে। এই সেলের দায়িত্বে এক সময় ছিলেন সুভাষ চন্দ্র সরকার। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তিনি এই সেলের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু মন্ত্রীর সঙ্গে তার বিরোধ হয়। এক সময় মন্ত্রী তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। মন্ত্রীর অনুরোধে সুভাষ চন্দ্র সরকারকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। বদলির সময়ই একটি অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তৃতা দিতে আসেন সায়মা ওয়াজেদ। সুভাষ চন্দ্র সরকার নিজেই আমাকে এক দিন এ ঘটনাটির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে চা পান করতে করতে সায়মা ওয়াজেদ জানেন যে সুভাষকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এটি শুনে সায়মা দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আমি আপনার কর্মতৎপরতা মিস করব। সুভাষ বললেন ‘আমাকে এখানে রাখার জন্য একটু বলতে পারেন কি?’ সায়মা ওয়াজেদ উত্তরে বলেছিলেন ‘দুঃখিত। এটা করতে পারব না। মা এসব একদম পছন্দ করেন না।’ প্রধানমন্ত্রীর কন্যা তাঁর সেক্টরে ভালো কাজ করা এক ব্যক্তির বদলি থামাতে তদবির করেন না। অথচ সেই প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় অনেক মন্ত্রীর পত্নী-পরিজন বদলি এবং নিয়োগ বাণিজ্যকে রীতিমতো পেশা বানিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের স্বজনপ্রীতির সূচনাকাল ১৯৭৫। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই এটাকে ভোগের সুযোগ হিসেবে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে জিয়াউর রহমানকে সৎ হিসেবে চিত্রিত করার প্রাণান্তর চেষ্টা করা হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি দেখিয়ে এটিকে এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কিন্তু জিয়া এবং তার পরিবার কতটা সৎ ছিল, তা নিয়ে সত্যনিষ্ঠ কোনো গবেষণা নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখব হয়তো ভবিষ্যতে। কিন্তু ছোট একটি তথ্য দিতে চাই এ লেখায়। জিয়া ততদিনে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ৬ জুন ১৯৭৭ সালে জিয়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে গেলেন। সঙ্গে তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্র। আট দিন পর জিয়া দেশে ফিরলেন একা। তার পত্নী এবং পুত্ররা মাস কাটাল লন্ডনে। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করে। এ সময় এ নিয়ে সরকারের মধ্যে নানা কথাবার্তা হয়। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পেতেন। ভারতের আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়া টুডে’ এ নিয়ে একটি ছোট্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। জিয়া ‘ইন্ডিয়া টুডে’র ওই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। জিয়ার জীবদ্দশায় বাংলাদেশে ইন্ডিয়া টুডে নিষিদ্ধ ছিল। জিয়ার শাসনামল ছিল এক অন্ধকার সময়। অবরুদ্ধ সময়। সে সময়ের খুব কম তথ্যই মানুষ জানত। লন্ডনে প্রমোদ ভ্রমণের মতো অনেক তথ্যই বন্দি করে রাখা হতো। এরশাদের জমানায় অবরুদ্ধ তথ্যের দেয়ালে চির ধরে। এরশাদের বিনোদন বিলাস, তার বান্ধবী এবং পত্নীগণের অনেক কেচ্ছা-কাহিনি সে সময় বিদেশের গণমাধ্যমে বেরোতে থাকে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সে সময় মোশাররফ হোসেন। তিনি পরবর্তীতে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরশাদ জমানায় তার স্ত্রীর দাপট ছিল সর্বত্র। এটা অবশ্য তার সরকারি চাকুরে স্বামীর বদৌলতে নয়। এরশাদের কারণে সরকারে প্রচণ্ড ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন জিনাত। এরশাদের পতনের পর বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন। বেগম জিয়ার হাতেই পরিবার এবং স্বজন তোষণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বেগম জিয়ার ভাইবোন হয়ে ওঠেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। ২০০১ সালে বেগম জিয়া দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে জিয়া পরিবার এখনকার শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবারের মতোই রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক হয়ে যান। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে তার পুত্র তারেক রহমান হয়ে ওঠেন অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার এক ভাই হন সেনাবাহিনীর কেনাকাটা সিন্ডিকেটের প্রধান। মন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের হাতে বিমান দেউলিয়া হয়। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান টেলিকম, বিজ্ঞাপন ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব পান। ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন তিনি। পাঠক একটু মিলিয়ে দেখুন, এখন শ্রীলঙ্কায় যে অবস্থা ঠিক এরকম অবস্থাই বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। জিয়া পরিবারের কাছেই ছিল সব ক্ষমতা। আজ শ্রীলঙ্কায় যা ঘটছে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তা ঘটে গেছে। ক্ষমতা ভোগের এই ব্যাধি এখন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো মন্ত্রীর মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। ভালো লক্ষণ হলো ব্যাধিটা চিহ্নিত হয়েছে। এখন এর চিকিৎসা প্রয়োজন।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

রেলমন্ত্রী   ট্রেন   ক্ষমতাবান   পত্নী   পরিজন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।

আকর্ষণহীন, উত্তেজনাহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন শুরু হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রক্রিয়া। যথারীতি উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দল নেই। শেষ মুহুর্তে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্বতন্ত্রভাবেও উপজেলা নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে তিন ধাপে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে দেখা গেল বিএনপির বেশ কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এর পর পরই এলো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই ধারণা করা যায়।। উপজেলা নির্বাচন এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই-ভাতিজা, শালা-মামাদের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই। মানুষের সামনে বিকল্প নেই। সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে কেন যাবে? বিএনপির এই ‘ভোট বর্জন’ কৌশল কি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ? 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন বর্জন, অসহযোগ আন্দোলনও সফল হয়নি। শুধুমাত্র ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়েছেন। যে নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত, সেখানে ভোট দিয়ে কি হবে-এরকম একটি মানসিকতা পল্লবিত হয় ভোটারদের মধ্যে। নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নষ্ট হতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকেই। ঐ নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করেছিল। সে সময় ১৫৩ টি আসনে জনগণ ভোটই দিতে পারেনি। বিএনপির বর্জন দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ২০১৮’র নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এবারও অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী ভোট দিতে যাননি। জনগণের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। অথচ ঐতিহ্যগত ভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ নির্বাচন পাগল। ভোটকে তারা উৎসব মনে করে। সেই উৎসব এখন ভাঙ্গা হটের মতো। দেশের অর্ধেকের বেশী নাগরিক জীবনে ভোটই দেননি। একটি ভোট যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার, এটিই এদেশের মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। এটি বিরাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় উপসর্গ। তাবৎ পন্ডিতরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। বিএনপি তো প্রতিদিন মুখস্থ বুলীর মতো, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার নিয়ে আওয়ামী লীগকে গালাগালি করছে। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষা, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির কি কোন দায়িত্ব নেই? বিএনপি কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? নাকি তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার মিশনে বিএনপি একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে এখন যেতে চাই না। 
এবছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কি পেল? এবার অবাধ, সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপর প্রচন্ড চাপ ছিলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, হুশিয়ারির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের অবাধ, সুষ্টু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতেই হতো। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর জনগণের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো। পশ্চিমা দেশ গুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিল। সব কিছু মিলিয়ে এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা ছিলো অসম্ভব, অলীক কল্পনা। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলো। জনগণ ভোটের মাঠে নানা চিন্তা, মত ও পথের প্রার্থী পেলেন না। বিএনপি বলতেই পারে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না- এটা নিশ্চিত হয়েই তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির এই অনুমান কে মানবে? বিএনপির নির্বাচন বর্জনে দলটির ক্ষতি হয়েছে। জনগণের ক্ষতি হয়েছে। লাভ হয়েছে সুশীল সমাজের। এই নির্বাচন জনগণের মধ্যে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে অনীহা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরীর কাজ হয়েছে আরো ত্বরান্বিত। ২০০৭ সালে এরকম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেই সুশীলরা ক্ষমতা দখল করেছিল। 

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তারপর থেকেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে সুশীল সমাজ। এজন্য বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন সম্মানিত কিছু সুশীল। কিন্তু বিএনপি যদি রাজনীতির পথেই থাকতো, তাহলে নির্বাচনে যেতো। তাদের অভিযোগ জনগণের সামনে তুলে ধরতো। ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনেও বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে দমন পীড়ন, নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আম-আদমী পার্টির প্রধান নেতা কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে পার্লামেন্ট থেকে। কংগ্রেস অভিযোগ করছে, বিজেপি নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাই বলে কংগ্রেস, আম-আদমী পার্টি কিংবা তৃণমূল কি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে? না, বরং তারা এই অভিযোগ গুলোকেই নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে, জনগণের কাছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর যে হতাশা এবং অস্থিরতা তা দেখে আমার মতো অনেকেই মনে করছিল, দলটির ভুল ভাঙ্গবে, আত্ম উপলব্ধি হবে বিএনপির। ভুল শোধরানোর জন্য হলেও উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য অনবদ্য এক সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবে না। ফলে বিএনপিও এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়া অংশগ্রহণ করলে ভোটে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরী হতো। বিএনপি এবং তার গোপন এবং প্রকাশ্য মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নিলে গণতন্ত্রের রক্তশূন্য শরীরে রাজনীতির রক্ত সঞ্চালিত হতো। উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ‘রাজনীতি’ কে আরো দুর্বল এবং মুমূর্ষু করলো। বিএনপি দেশে গণতন্ত্র চায় না। জনগণের অধিকারও চায়না। তারা শুধুমাত্র চায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এর বিপরীতে প্রশ্ন উঠতেই পারে আওয়ামী লীগ কি মুক্ত, সুস্থ রাজনীতি চায়? আওয়ামী লীগ কি গণতন্ত্রের বিকাশ চায়? রাজনীতি হত্যার উৎসবে কি আওয়ামী লীগও সামিল নয়? 

টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কৌশল যেভাবে রপ্ত করেছে, ঠিক সেভাবে কি সংগঠনকে নীতি ও আদর্শের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে? আওয়ামী লীগের ভেতরে কি কোন রাজনীতি আছে? আদর্শ চর্চা আছে? প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই কি নিজেকে হত্যা করছে না? সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলটি কোন্দল বিভক্তিকে সাংগঠনিক স্বীকৃতি দেয়। দেশে এখন কোন বিরোধী দল নেই। কোথাও সরকারের সমালোচনা নেই। সবাই সরকারকে ‘সাধু সাধু’ করে। আওয়ামী লীগ এখন একাধিক টীম হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলছে। কোন্দলকে দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। বিএনপি-জামায়াতের দরকার নেই, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই একে অন্যের চরিত্র হনন করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে, খুন করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারা এসব কোন্দলকে পাত্তা দিতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন আত্ম তুষ্টির সর্বোচ্চ চূড়ায়। কোন বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। তাদের মতে, বিরোধী দল নেই, তাই একাধিক গ্রুপ থাকলে দল শক্তিশালী হবে। কর্মী বাড়বে। দলে ভারসাম্য থাকবে। একজন এমপি বলছিলেন, সবাই তো শেখ হাসিনার। যে জিতবে, সেই আপন। যে হারবে, সে জয়ীকে চাপে রাখবে। এরকম ‘চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স’ কৌশল চলছে আওয়ামী লীগ। এটাই নাকি ভালো। কিন্তু এটি যে কি ভয়ংকর দর্শন তা বুঝতে আওয়ামী লীগকে আরেকটি দুঃসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে বিশ্বস্ত, ত্যাগী, দল ও নেতার জন্য সব কিছু উৎসর্গ করার মতো নেতা-কর্মী শূন্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেতা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, নেতার জন্য জীবন দেবো-এই মনোভাব আওয়ামী লীগ থেকে উঠে গেছে বহু আগেই। আওয়ামী লীগে এখন ‘নব্য মোশতাক’ তৈরী হচ্ছে মাশরুমের মতো। নেতার সামনে স্তুতি, আড়ালে সমালোচনা-এটাই এখন আওয়ামী সংস্কৃতি। সব নেতা, পাতি নেতা জানেন, মূল নেতা তার বিকল্প রেখেছেন। তিনি দলে অপরিহার্য নন। কাল নেতার হাত সরে গেলেই সে ‘জিরো’। মূল নেতার তিনি একান্ত আপন নন। এই উপলব্ধি তাকে লোভী করে। দুর্নীতিবাজ করে। আদর্শহীন এক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদে পরিণত করে। এই উপলব্ধির কারণেই সে সংগঠন ভালোবাসেনা, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না। আওয়ামী লীগের ক’জন নেতা এখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন? কাজের চেয়ে মূল নেতার নেক নজরে থাকাটাই তাদের জন্য লাভজনক। এজন্য আওয়ামী লীগে চলছে আখের গোছানোর উৎসব। যে যেভাবে পারছে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতরা হয় বৈষয়িক হয়ে উঠেছেন। টাকা-কড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য মনোযোগী হচ্ছেন, অথবা দূরে, নিভৃতে চলে যাচ্ছেন অবহেলায়, হতাশায়। দল করো, পদ দখল করো, নির্বাচন করো, টাকা বানাও-আওয়ামী লীগের এই অধ্যায় সমাপ্ত প্রায়। এরপর শুরু হয়েছে, ছেলে, বউ, শালা, মামা, ভাগিনাদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা। যার এক ঝলক দেখা যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা বড় অংশ এখন সাধারণ মানুষকে ‘মানুষ’ মনে করে না। তাদের পাত্তাও দেয় না। নেতারা চার পাশে রাখেন স্তাবকদের। কিছু একটা বলেই চাটুকারদের দিকে তাকান। তারা অনুগত ভৃত্যের মতো মাথা নাড়েন এবং হাসেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আজ বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের মতো। এরা জনসম্পৃক্তহীন, উদ্বাস্তু। জনবিচ্ছিন্নতার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টি। এই সুযোগে রাজনীতির মরা লাশ কুড়ে কুড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় মৌলবাদী শকুন। তরুণদের মধ্যে রাজনীতির আগ্রহ নেই। আরো সোজা সাপটা বললে, তরুণরা রাজনীতিকে রীতিমতো ঘৃণা করে। একারণেই ‘রাজনীতি মুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবী এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাদের মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র নেতাদের ভয় পান বটে, কিন্তু সম্মান করেন না। রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এভাবেই সর্বত্র রাজনীতিকে কলংকিত করার উৎসব চলছে। রাজনীতি মানেই খারাপ-এটা প্রমাণের এক ভয়ংকর খেলা শুরু হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো। আবার অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতার চাবি তুলে দেয়া। তেমন পরিস্থিতির দিকেই কি ছুটছে বাংলাদেশ?     

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

পদ হারানোর ঝুঁকিতে আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য

প্রকাশ: ০২:০০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন। 

আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদকের টেলিআলাপের পরপরই ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির ৩ নম্বর কার্যালয়ে যান এবং সেখানে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে তিনি যারা যারা নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন। 

একই সাথে তিনি এটাও জানান যে, যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরকম একটি বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। 

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে শুধু বিষয়টি অবহিত করেননি, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তত তিনজন আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং কথা বলে তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই  হারুন অর রশীদ হীরা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা থেকে এবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তার এই প্রার্থীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির সাথেও টেলিফোনে কথা হয়েছে বলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ইনসাইডারকে নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। তার সাথেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেন এবং তাকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য পরামর্শ দেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও আলাপ করেছেন বলে জানা গেছে। তার ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচরে প্রার্থী হয়েছেন। 

এই সমস্ত স্বজনরা যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করে সে ক্ষেত্রে কী করা হবে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং এদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা প্রেসিডিয়াম এবং এই প্রেসিডিয়ামের দুজন সদস্য যখন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করেছেন তখন অন্যরা সেটা মানবে কীভাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান গ্রহণ করতে চায় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনা বলেছেন, যারাই এ সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদেরকে দল থেকে পদ হারানো বা বহিষ্কারের নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন দল থেকে বহিষ্কৃত হন তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত যদি এই উপজেলা নির্বাচনে স্বজনদের অবস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে এই দুই নেতা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।

আওয়ামী লীগ   উপজেলা নির্বাচন   ড. আব্দুর রাজ্জাক   শাহজাহান খান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু: শেখ হাসিনাই হতে পারেন শান্তির দূত

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা। 

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির দর্শন জাতিসংঘ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিশ্বশান্তি দর্শনের আলোকেই ইসরায়েল ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। 

বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে কঠোর এবং যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর অবিচার, হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সবসময় নিন্দা জানাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ঈদের শুভেচ্ছা ভাষণেও মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক বিপর্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'মাদার অব হিউম্যানিটি' হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন। আর এ কারণেই বিশ্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। উদার মুসলিম দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি আলাদা একটি অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশ একদিকে যেমন ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করে, অন্যদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং ধর্মের নামে উগ্র সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। আর এটি বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে বিশ্বের এমন একজন নেতা যিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সংকট সমাধানের আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারেন। তার শান্তির মডেলকে সামনে রেখে যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার টেবিলে বসে তাহলে ইসরায়েল ইস্যুতে শান্তি অসম্ভব নয়।

বিশ্বে যারা নেতৃবৃন্দ আছেন তারা প্রায় অনেকেই বিতর্কিত এবং পক্ষপাতে দুষ্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব নেতার অবস্থানে থাকতে পারছেন না। চীন এই বিষয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পক্ষ করতে চায় না। তাছাড়া বিভাজিত বিশ্বে চীনের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মেনে নেবে না এটা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি রাশিয়া এখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়া পুতিনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এরদোয়ান ব্যাপারে ইসরায়েল সহ অন্যান্য দেশগুলোর একটি অবস্থান রয়েছে। তাছাড়া তুরস্ক এই বিতর্কে কতটুকু সহনীয় অবস্থায় থাকতে পারবে তা নিয়ে ব্যস্ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এই অবস্থায় বিশ্বকে যুদ্ধাবস্থা থেকে সামাল দিতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনাই। তার শান্তির বার্তা যদি বিবাদমান পক্ষগুলো অনুধাবন করে তাহলে এই জটিল কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি অসম্ভব নয়। আর এই শান্তির জন্য শেখ হাসিনাই হতে পারেন বিশ্ব নেতা। তার শান্তির দর্শন এবং তার শান্তির উদ্যোগের মাধ্যমে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হতে পারে বিশ্ব।

ইরান-ইসরায়েল   শেখ হাসিনা   শান্তির দূত   জো বাইডেন   ইরান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন যারা

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগে নীরবে নিভৃতে পালাবদল ঘটছে। এক সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মানে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ সেলিম, মতিয়া চৌধুরী। এখন তাদের অধ্যায় আস্তে আস্তে যবনিকা ঘটেছে। শারীরিক ভাবে তারা অনেকেই অসুস্থ। অনেকে এখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। বরং একটি নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সামনে নিয়ে আসছেন। তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে জায়গা করে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের এই পালাবদলটি শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনীতির একটি অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। 

পুরনোদেরকে অসম্মান না করে নতুনদের জন্য জায়গা করে দেওয়ার যে কৌশল সেটি রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয়। কিছু দিন আগেও যারা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের বদলে এখন আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু নেতা। যারা আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর যাদেরকে বেশি পাদপ্রদীপে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন;

১. ড. হাছান মাহমুদ: ড. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি ঘটেছে। এর আগে তিনি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। এবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। স্পষ্টতই আওয়ামী লীগ সভাপতি তাকে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসছেন। তিনি আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও বটে। কোন কারণে সাধারণ সম্পাদকের পদ খালি হলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও ড. হাছান মাহমুদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই অনেকে মনে করছেন। আর এই সমস্ত বিবেচনা থেকেই আওয়ামী লীগে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে সামনে আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। 

২. জাহাঙ্গীর কবির নানক: জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন নিজ যোগ্যতায়। মাঠের নেতা হিসেবে তার দীর্ঘদিনের সুনাম ছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। রাজনীতিতে চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়েই তিনি এগিয়ে গেছেন তার আদর্শের কারণে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার পর তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে গেছেন। তার পুরস্কার তিনি পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে উন্নীত হন। এবার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা এখন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছেন। 
৩. আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কর্মী বান্ধব হওয়ার কারণে তার অবস্থান আস্তে আস্তে দৃঢ় হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের অন্যতম বাহাউদ্দিন নাছিম কর্মীদের কাছে আওয়ামী লীগ সংগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত এবং সংগঠনের প্রশ্নে অকুতোভয় এবং একনিষ্ঠ এই নেতা মন্ত্রী না হয়েও আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতি নির্ধারক হয়ে উঠছেন নিজ যোগ্যতায়। 

৪. আব্দুর রহমান: আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীর কবির নানক এর মতোই তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। কিন্তু তারপরও তিনি ভেঙে পড়েননি। সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। এবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থার প্রতিদান তিনি ভালো ভাবেই দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের একটি পালা বদল ঘটছে। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু কিংবা শেখ ফজলুল করিমের জায়গা আস্তে আস্তে এই সমস্ত নেতারা জায়গা করে নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের একটা পাইপলাইন তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। যেখানে পর্যায়ক্রমে নেতারা অপেক্ষমান অবস্থায় আছেন। নেতৃত্বের শূন্যতা আওয়ামী লীগে যেন না হয় সেজন্য একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আব্দুর রহমান   জাহাঙ্গীর কবির নানক   ড. হাছান মাহমুদ   আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অন্ধকার ছয়দিন

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের লোডশেডিং চলছে। গত বুধবার থেকে সংবাদপত্র বের হচ্ছে না। টানা ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধের বিশ্ব রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। না কোন প্রতিবাদে নয়, দাবী আদায়ের জন্য নয়। ছুটির ফাঁদে সংবাদপত্র বন্ধ আছে। সংবাদপত্রকে বলা হয় জরুরী সেবা। চিকিৎসক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা যেমন জরুরী সেবা দেন, তেমনি সংবাদকর্মীদের কাজও হলো দেশের মানুষকে সার্বক্ষণিকভাবে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয়া। বিশেষ করে ছুটির সময় এটার প্রয়োজন আরো বেশী। এবার দেশে একটা দীর্ঘ ছুটি। এসময় সংবাদপত্র অনেক জরুরী। আচ্ছা ভাবুন তো, ছয়দিন যদি হাসপাতালে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো, কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বলতো ছয়দিন তারা দায়িত্ব পালন করবে না। তাহলে কি হতো? আমিতো মনে করি, সংবাদপত্র বন্ধ রাখার বিষয়টিও তেমনি আঁতকে ওঠার মতো। কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকদের এনিয়ে বিকার নেই।  

এবার বাংলাদেশ দু’টি বড় উৎসব কাছাকাছি সময় উদ্যাপন করছে। ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে না করতেই, আগামীকাল (রোববার) ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব। এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। তবে বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর কেবল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব নয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে আনন্দ করে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই রীতি চলে এসেছে দীর্ঘদিন। ইদানিংকার মতো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন ধর্মীয় উৎসবকেই দেখা হতো না। ঈদের দিন অন্য ধর্মের বন্ধুরাও বাসায় আসতো সেমাই মিষ্টি এক সাথে খাওয়া হতো। আবার হিন্দুদের পূজাতেও আমরা যেতাম। অনেক মজা হতো। যতো দিন যাচ্ছে আমাদের ধর্মীয় উদার নৈতিক চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছে ধর্মান্ধ সংকীর্ণতা। এখন ঈদ উৎসব যেন অনেকটাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলিত। রমজান মাস জুড়ে এক ধরনের কঠোর বিধি নিষেধ থাকে যা স্বতঃস্ফূর্ত না। আরোপিত এবং লোক দেখানো। এই আরোপিত বিধি নিষেধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কিছু ‘বক ধার্মিক’। এদের কারণে গত তিন ঈদে পহেলা বৈশাখ নির্বাসিত ছিলো। পবিত্র রমজানের সাথে পহেলা বৈশাখের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু তারপরও অতি উৎসাহী কট্টরবাদীদের দাপটে শৃঙ্খলিত হয় পহেলা বৈশাখ। অথচ বাঙালী হিসেবে পহেলা বৈশাখীই আমাদের প্রথম এবং প্রধান সর্বজনীন উৎসব। বাংলা বর্ষ বরণ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বেশ কয়েক বছর পর এবার পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হবে বাঁধাহীন ভাবে। বাঙালী জাতি বর্ষবরণ করবে মুক্ত ভাবে। এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের উপলক্ষ্য তো বটেই। কিন্তু এত বড় উৎসব হবে সংবাদপত্রহীন! কি অদ্ভুত! সংবাদপত্র কি দায়িত্বহীন মালিকানার শিকার?

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট। কিছু মানুষ যতোই কট্টর মৌলবাদী হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখনও উগ্র পন্থাকে সমর্থন করে না। এজন্য একই সময়ে একাধিক ধর্মাবলম্বীদের উৎসব এদেশে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়। এবার রমজানের কথায় ধরা যাক না কেন। এবার রমজানের মধ্যেই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ‘ইস্টার সানডে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোজার মধ্যেই দোল উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায় রং উৎসবে মেতেছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বলেননি যে, রোজার জন্য ইস্টার সানডে করা যাবে না কিংবা দোল উৎসব বন্ধ রাখতে হবে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় কিছু উপরের তলার মানুষ। যারা ধর্ম প্রতিপালনের চেয়ে লোক দেখানোতে বেশী আগ্রহী। এদের হাতে ধর্ম এবং সংস্কৃতি কোনটাই নয়। এবার ঈদের পরপরই পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হচ্ছে-এজন্য আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এটি এক অনন্য সুযোগ। এর মাধ্যমে প্রমাণ হতে পারে আমরা বাঙালী, আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা উদার। এদেশের মানুষ যেমন ঈদ উৎসব করলো তেমনি বাংলা নববর্ষকেও বরণ করবে। এই বর্ষ বরণের উৎসব যেন ঢেকে দিচ্ছে সংবাদপত্রে ছুটি। এবার ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিকরা। ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে মোট ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার এক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংবাদপত্র মালিকরা। পহেলা বৈশাখে কেন সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে? কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ‘ঈদ সংখ্যা’ সাময়িকী প্রকাশ করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই সব সাময়িকী গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি আশা করেছিলাম এবার যেহেতু কাছাকাছি সময়ে ঈদ এবং বর্ষবরণ তাই সংবাদপত্রগুলো পহেলা বৈশাখে একটা ছোট সাময়িকী করবে। আলাদা আলাদা সাময়িকী না করুক ঈদ সংখ্যা এবং নববর্ষ সংখ্যা মিলিতভাবে করবে। কিন্তু কোথায় কি, এবার পহেলা বৈশাখে কোন সংবাদপত্রই বেরুচ্ছে না। শুধু পহেলা বৈশাখ কেন? বাংলাদেশে এখন চলছে অন্ধকার সময়। ১০ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল দেশে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। এটি নজীর বিহীন। 

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, এ যুগে সংবাদপত্র ৬ দিন না ৬ মাস বন্ধ থাকলো কার কি? এখন সংবাদের জন্য কে আর দৈনিক পত্রিকার অপেক্ষা করে? অনলাইন, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়ার এই যুগে কেউ আর খবরের জন্য সকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষা করে না। সকাল বেলা এক কাপ চায়ের সাথে একটি সংবাদপত্র এখন উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ নয়। এসব ঘটনা প্রিন্ট মিডিয়ার অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত। কিন্তু তারপরও প্রিন্ট মিডিয়া এখনও বিশ্বস্ততা এবং আস্থার প্রতীক। একজন পাঠক টেলিভিশনে বা অনলাইনে যতো সংবাদই দেখুক বা পড়ুক না কেন, দিনের শেষে তার নির্ভরতা ছাপা কাগজ। অনলাইনে কোন সংবাদ পাঠ করার পর তার সত্যতা যাচাই করে ছাপা কাগজে। তাই এখনও সংবাদ, সঠিক তথ্যের জন্য প্রধান নির্ভরতার জায়গা হলো সংবাদপত্র। তথ্যের এই বিশ্বস্ত উৎস বন্ধ আছে। টানা ছয়দিনের জন্য দেশের মানুষ সংবাদপত্র পাবে না। এই ছয়দিনকে বলা যায় অন্ধকার সময়। সংবাদপত্র বিহীন একটা দিন মানে অন্ধকার দিন-রাত্রি। গত ১০ এপ্রিল থেকে অন্ধকার ছয়দিন শুরু হয়েছে। আমরা যারা সেকেলে মানুষ। ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা খুঁজি তাদের জন্য এই ছয়দিন দূর্বিসহ, অবর্ননীয়। 

প্রশ্ন হলো সংবাদপত্রের মালিকরা কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলো? এই সিদ্ধান্ত দেশের সংবাদপত্র শিল্পকে আরো সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের মালিকানা শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের দখলে। প্রধান সব সংবাদপত্রই কোন না কোন শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। বড় শিল্পপতিদের কাছে সংবাদপত্র হলো মর্যাদার প্রতীক। মুক্ত সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পাঠকের কাছে দায় বদ্ধতা ইত্যাদি ব্যবসায়ীদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। সংবাদপত্র এখনকার মালিকদের কাছে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘অস্ত্র’। এই ক্ষমতা দেখিয়ে তারা তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে। সুদৃঢ় করে। সরকার সংবাদপত্র মালিকদের ভয় পায়। ব্যাংক তো তটস্থ থাকে। তাই পত্রিকা থাকা মানে ব্যবসায়ীদের সব মুশকিল আসান। কর্পোরেট হাউসে এখন সাংবাদিকতা নেই, এক ঝাঁক ক্রীতদাস আছে। যাদের একমাত্র কাজ মালিকদের মনোরঞ্জন করা। এদের মধ্যে যিনি সম্পাদক তিনি হলেন সবচেয়ে বড় ক্লাউন। মালিকদের খুশী করাই তার একমাত্র কাজ। পেশাগত উৎকর্ষতা চুলোয় যাক। যিনি মালিকের স্বার্থ যতো নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত করেন তিনি ততো বড় সম্পাদক। এই অস্ত্র প্রয়োগ করে মালিকরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায়। যারা তাদের কথা শোনে না তাদের এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যবসায়ীদের কাছে একধরনের বর্মের মতো। নিজেদের অপকর্ম, স্বেচ্ছাচারিতা জায়েজ করার জন্য সংবাদপত্রকে তারা ব্যবহার করে। সংবাদপত্রের মালিক হবার কারণে কেউ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। এভাবেই চলছে সংবাদপত্র শিল্প। সংবাদপত্র এখন কর্পোরেট ক্রীতদাস। তাই মালিকরা সংবাদপত্র দুই দিন বন্ধ থাকলো না ছয়দিন বন্ধ থাকলো তা নিয়ে ভাবেন না। তারা তাদের ব্যবসা সুরক্ষা পত্রিকা দিয়ে কতটা হলো তা নিয়েই ব্যস্ত। সংবাদপত্র মালিকরা পাঠকের কাছে জবাবদিহিতার বিশ্বাসী নন। তারা দেখেন এই সংবাদপত্র তাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পারছে। ছাপা কাগজ একদিন বের না হলে অনেক সংবাদপত্রের অনেক টাকা সাশ্রয়। এসব বিবেচনা করেই মালিকরা মনে করেছেন পত্রিকা যদি কয়েকটা দিন বন্ধই থাকে, কি এমন ক্ষতি। কিন্তু এই ছয়দিন সংবাদপত্র বন্ধ যে এক ভয়ংকর বার্তা দিলো তাকি মালিকরা অনুধাবন করেন? সংবাদপত্র ছাড়াও যে দেশ চলে, এমন এক ঘোষণাই কি দিলেন না মালিকরা। ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন