এডিটর’স মাইন্ড

সেই ষড়যন্ত্র এখনো চলছে

প্রকাশ: ১০:০২ এএম, ১৬ জুলাই, ২০২২


Thumbnail সেই ষড়যন্ত্র এখনো চলছে

১৬ জুলাই, ২০০৭। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির সব শোক যেন বৃষ্টি হয়ে নেমেছে। প্রবল বর্ষণের মধ্যেই ভোর ৬টায় সুধা সদনে প্রবেশ করে যৌথ বাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার দেখিয়ে সুধা সদন থেকে বের করে আনেন। এর আগে সুধা সদনের চারদিকে ছিল রীতিমতো যেন যুদ্ধাবস্থা। ২ সহস্রাধিক পুলিশ, র‍্যাব ও অন্যান্য বাহিনী ঘিরে রেখেছিল সুধা সদন। পুলিশ, র‍্যাবসহ যৌথ বাহিনীর প্রায় ৩০ জন সদস্য সুধা সদনে প্রবেশ করেন। শেখ হাসিনা এ সময় ছিলেন অবিচল, ভয়হীন। সকালেই তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে জানতে চান কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে? দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে? যৌথ বাহিনীর অফিসাররা জানান, ১৩ জুন গুলশান থানায় ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী তাঁর বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা এতটুকু বিচলিত না হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে আইনি বিষয়ে কথা বলেন। শেখ হাসিনা গ্রেফতারের সময় কথা বলেছিলেন তৎকালীন আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গেও। নির্ভীক, সাহসী শেখ হাসিনা তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য আনা গাড়িতে ওঠেন। এরপর সুশীল নিয়ন্ত্রিত অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর। সে লড়াইয়ে জয়ী হয়েই শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার শেখ হাসিনার কারণেই শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়।

বিএনপির দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাটের প্রেক্ষাপটে এক-এগারোর সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপর প্রথম দিন থেকেই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তারেক জিয়া একের পর এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেন। নির্বাচনের পরপরই সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর তান্ডব শুরু হয়। তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয়। ১ অক্টোবর ২০০১ থেকে ১০ অক্টোবর ২০০১ বাংলাদেশে ছিল এক বীভৎসতার নারকীয় উৎসব। এরপর হাওয়া ভবন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেই দলীয়করণ করা হয়। বিএনপির সাবেক নেতা বিচারপতি কে এম হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হন, এজন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচন কমিশনকে এক তামাশার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। সেনাবাহিনীকে নিজেদের পক্ষে রাখতে সাতজনকে ডিঙিয়ে মইন উ আহমেদকে করা হয় সেনাপ্রধান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য। বিএনপি যেন চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকে সেজন্য সব আয়োজনই করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে সময় জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। একসময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থান রাজপথকে সহিংস করে তোলে। জনগণের জীবন এক ঘোর অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে নিপতিত হয়। এ সময়ই সুযোগ নেয় সুশীলসমাজ, আন্তর্জাতিক মহল ও গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অনড় অবস্থান। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার উদগ্র মানসিকতার মধ্যেই সুশীলরা দেশের ক্ষমতা দখলের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে। বিএনপির একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার কারণে দেশজুড়ে তখন এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ড. ইয়াজউদ্দিনের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ দেশবাসী। এ রকম এক পরিস্থিতিতে সেনাসমর্থিত সরকারকে স্বাগত জানায় দেশবাসী। মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু শিগগিরই এক-এগারো সরকারের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হতে থাকে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নয় বরং বিরাজনীতিকরণ বাস্তবায়নই ছিল ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই শুরু করে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান। রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিবাজ এটা প্রমাণই যেন এক-এগারো সরকারের মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি শুরু হয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও অভিযান। এসব অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের চরিত্রহনন, তাদের ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়। কয়েকজন সুশীল শুধু সাধু আর বাদবাকি সবাই চোর, দুর্নীতিবাজ- এটি প্রমাণই যেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের প্রধান কাজে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এক-এগারো হঠাৎ করে এক বাস্তবতা ছিল না। এটি ছিল সুশীলসমাজের একটি অংশের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার এক নিখুঁত বাস্তবায়ন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোও। এক-এগারোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থাভাজন এই ব্যক্তিকে সামনে রেখেই নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ড. ইউনূস যেন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হন, এজন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু সুশীলরা দ্রুতই বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক লড়াইয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনোভাবেই তাঁরা পারবে না। বরং শেষ পর্যন্ত এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপরই আস্থা রাখে। এক-এগারো সরকার তাই রাজনীতিহীন এক দেশে কর্তৃত্ব করতে চেয়েছিল। আর সে কারণেই নির্বাচন নয়, তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানেই ছিল তাদের সব মনোযোগ। এক-এগারোর পরিকল্পনায় কিছু লোভী রাজনীতিবিদও যুক্ত হয়েছিলেন। হালুয়া-রুটির আশায় তাঁরাও সুশীলদের পদলেহন শুরু করেন। সুশীলদের ‘রাজনৈতিক সংস্কার’ ফরমুলা আসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভ্রষ্ট, ভীরু রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেই। এ রাজনৈতিক সংস্কার ফরমুলায় দুই নেত্রীকে ‘মাইনাস’ করার প্রস্তাব রাখা হয়। দুটি প্রভাবশালী বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ‘মাইনাস ফরমুলার’ আবিষ্কারক। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন একজন। শেখ হাসিনা। এক-এগারোর আসল উদ্দেশ্য তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন। এ কারণে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ স্মরণ করিয়ে দেন। ২০০৭ সালের ২৩ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্রুত নির্বাচন আয়োজন এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা শুনতে হয় তাঁকে। বেশ কজন হেভিওয়েট নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। কারা সেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরোধিতা করেছিলেন। কারা দলে গণতন্ত্রায়ণের ফতোয়া দিয়ে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সবাই চেনে। নতুন করে নাম উচ্চারণ করে তাঁদের লজ্জা দিতে চাই না। স্রোতের বিপরীতে লড়াই করেই শেখ হাসিনা আজকের জায়গায় এসেছেন। তাই দ্রুত নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাড়াবাড়ির সমালোচনা তিনি অব্যাহত রাখেন। সুশীলরা বুঝতে পারেন দীর্ঘ মেয়াদে তাঁদের ক্ষমতায় থাকার একমাত্র বাধা শেখ হাসিনা। সুশীলদের প্রভু আন্তর্জাতিক মুরুব্বিরাও বুঝতে পারে, শেখ হাসিনাকে সরাতে না পারলে কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে না। এ কারণেই শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। পুত্র ও কন্যাকে দেখতে ১৫ মার্চ, ২০০৭ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তাঁর বিদেশযাত্রার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গীতা পাসি ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জানিয়েছিলেন এক মাসের মধ্যে তিনি দেশে ফিরবেন। ২৩ এপ্রিল তাঁর দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এটি ছিল একজন নাগরিকের মানবাধিকারের ওপর সবচেয়ে ঘৃণ্য হস্তক্ষেপ। কোনো বিচারেই একজন নাগরিককে তাঁর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না। ২০০৭-এর ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এক বিস্ময়কর প্রেসনোট জারি করে। ওই প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, ‘তাঁর দেশে ফিরে আসা দেশের আইনশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, জননিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’ কিন্তু শেখ হাসিনা সব সময়ই সাহসী। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই তিনি টিকে আছেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২৩ এপ্রিল ঢাকায় ফেরার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। ১৯ এপ্রিল লন্ডনে আসেন তিনি। এরপর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরতে চাইলে হিথরো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁকে বোর্ডিং পাস দেননি। এটি ছিল সুশীল সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনায় গোটা দেশের জনমত আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে চলে যায়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নতুন মেরুকরণ ঘটে। তীব্র সমালোচনার মুখে ২৬ এপ্রিল পিছু হটতে বাধ্য হয় মইন উ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দীনের সরকার। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় পান বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিমানবন্দরে লাখো মানুষের উপস্থিতি শেখ হাসিনাকে দেয় নতুন শক্তি, সাহস। কিন্তু সুশীলরা তখনো মাইনাস ফরমুলায় অটল। তাঁদের টার্গেট হয়ে যান শুধু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তাঁরা বুঝতে পারেন, শেখ হাসিনা থাকলে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্যই নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাঁরা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হতে থাকে। বোঝাই যাচ্ছিল শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এজন্য তিনি তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় বার্তাগুলো দিতে থাকেন। ঢালাও গ্রেফতার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রহননের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করতে থাকেন অব্যাহতভাবে। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ২০০৭-এর এই দিনে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি ছিলেন গণতন্ত্র আর মুক্তির প্রতীক। তাঁকে গ্রেফতার করে আসলে গণতন্ত্রকেই বন্দি করেছিল অনির্বাচিত সরকার।

এক-এগারোয় প্রবল চার প্রতিপক্ষের সঙ্গে একাই লড়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল এ দেশের সুশীলসমাজের একটি অংশ। যাঁদের ক্ষমতায় বসার খায়েশ যেন প্রায় চিরস্থায়ী এক রোগ। এঁরা সব সময় অনির্বাচিত শাসন চান। গণতন্ত্রে এঁদের প্রবল অরুচি। দেশে সব অবৈধ, অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনে এঁরা ‘উপদেষ্টা’ হয়ে ভাড়া খেটেছেন। এক-এগারোয় এই সুশীলরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাঁরা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে হটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ১৬ জুলাই তাঁরা চূড়ান্ত আঘাত হানেন। শুধু এক-এগারোয় নয়, শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভ্রষ্ট সুশীল ও ভ- জ্ঞানপাপীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এখনো করছেন।

এক-এগারোয় শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রতিপক্ষ ছিল আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহল। যারা বাংলাদেশকে একটি অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। বাংলাদেশ ওই সব দেশের কথায় উঠবে-বসবে। তাদের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। এ প্রভাবশালী মহল তাদের পোষা সুশীলদের দিয়ে একটি চিরস্থায়ী শাসনব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন জাতির পিতা। লড়াইটা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর কন্যা। বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর করার লড়াইটা আসলে পশ্চিমা প্রভুত্বের বিরুদ্ধেই লড়াই।

২০০৭-এ শেখ হাসিনার তৃতীয় প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁর দলের কিছু বিভ্রান্ত নেতা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গোটা তৃণমূল, মাঠের কর্মীরা ছিলেন দলের সভানেত্রীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু লোভে পড়ে বা পথভ্রষ্ট হয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁরা আসলে রাজনীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার চতুর্থ প্রতিপক্ষ ছিল প্রভাবশালী গণমাধ্যম। যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে লিপ্ত ছিল। এ প্রভাবশালী গণমাধ্যমই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এরা চিন্তার দিক থেকেই বিরাজনীতিকরণকে লালন করে।

আজ ১৫ বছর পর আমরা যদি ফিরে দেখি তাহলে প্রশ্নটা উঠতেই পারে। ১৬ জুলাইর লড়াইটা কি শেষ হয়েছে? আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তার পরও কি ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়েছে? শেখ হাসিনা কি নিরাপদ? ঝুঁকিমুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তরে আজকের চারপাশ একটু খতিয়ে দেখা জরুরি। এক-এগারোর সময় যে চার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখনো চলছে। এক-এগারোর সুশীলরা আগের চেয়ে সক্রিয়। প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা মাতম তুলছে। গণতন্ত্র নিয়ে তাঁদের আর্তনাদ দেখলে ভিরমি খেতে হয়। সুশাসন, মানবাধিকার, নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এসব ইস্যু নিয়ে সুশীলরা বিনিদ্র রজনি কাটাচ্ছেন। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধ করাই সুশীলদের এখন একমাত্র কাজ।

এক-এগারোয় সক্রিয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় কোনো রাখঢাক নেই। যত ভাবে পারে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। অথচ নিজেদের দেশের কী হাল তা যদি দেখত। প্রধানমন্ত্রীও মার্কিন নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এক-এগারোর মতোই সরব-সক্রিয়।

এ কথা ঠিক, এক-এগারো আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা দিয়েছে। এক-এগারোয় বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই তাঁকে দলে এবং দেশে অবিসংবাদিত নেতা বানিয়েছে। তৃণমূলে শেখ হাসিনাই শেষ কথা। তার পরও দলে যে নব্য মোশতাক নেই তা কী করে বলব। আপাত-নিষ্ক্রিয় কিন্তু যে কোনো সময় ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগের নব্য মোশতাকরা।

এক-এগারোর চেয়েও সক্রিয় এখন মাইনাস ফরমুলার প্রবক্তা গণমাধ্যমগুলো। কথায় কথায় বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানানো। কিছু লোডশেডিংয়ে আহাজারি করা। অর্থনীতি নিয়ে ভয়ংকর পূর্বাভাস দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এক নতুন মিশন এখন দৃশ্যমান।

সবচেয়ে বড় কথা, শেখ হাসিনা ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর কিছু নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, প্রয়াত সাহারা খাতুনের মতো কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনার পাশে। এখন কি দাঁড়ানোর মতো মানুষ পাওয়া যাবে? এক-এগারো আসলে এক প্রতীক। ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে অনির্বাচিত সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল। এক-এগারোর শক্তি সে সময়ই পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হয়নি। এখন এক-এগারোর শক্তি নতুন করে সক্রিয় হচ্ছে। ষড়যন্ত্র চলছে এখনো।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

ষড়যন্ত্র   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু: শেখ হাসিনাই হতে পারেন শান্তির দূত

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা। 

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির দর্শন জাতিসংঘ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিশ্বশান্তি দর্শনের আলোকেই ইসরায়েল ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। 

বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে কঠোর এবং যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর অবিচার, হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সবসময় নিন্দা জানাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ঈদের শুভেচ্ছা ভাষণেও মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক বিপর্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'মাদার অব হিউম্যানিটি' হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন। আর এ কারণেই বিশ্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। উদার মুসলিম দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি আলাদা একটি অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশ একদিকে যেমন ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করে, অন্যদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং ধর্মের নামে উগ্র সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। আর এটি বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে বিশ্বের এমন একজন নেতা যিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সংকট সমাধানের আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারেন। তার শান্তির মডেলকে সামনে রেখে যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার টেবিলে বসে তাহলে ইসরায়েল ইস্যুতে শান্তি অসম্ভব নয়।

বিশ্বে যারা নেতৃবৃন্দ আছেন তারা প্রায় অনেকেই বিতর্কিত এবং পক্ষপাতে দুষ্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব নেতার অবস্থানে থাকতে পারছেন না। চীন এই বিষয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পক্ষ করতে চায় না। তাছাড়া বিভাজিত বিশ্বে চীনের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মেনে নেবে না এটা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি রাশিয়া এখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়া পুতিনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এরদোয়ান ব্যাপারে ইসরায়েল সহ অন্যান্য দেশগুলোর একটি অবস্থান রয়েছে। তাছাড়া তুরস্ক এই বিতর্কে কতটুকু সহনীয় অবস্থায় থাকতে পারবে তা নিয়ে ব্যস্ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এই অবস্থায় বিশ্বকে যুদ্ধাবস্থা থেকে সামাল দিতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনাই। তার শান্তির বার্তা যদি বিবাদমান পক্ষগুলো অনুধাবন করে তাহলে এই জটিল কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি অসম্ভব নয়। আর এই শান্তির জন্য শেখ হাসিনাই হতে পারেন বিশ্ব নেতা। তার শান্তির দর্শন এবং তার শান্তির উদ্যোগের মাধ্যমে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হতে পারে বিশ্ব।

ইরান-ইসরায়েল   শেখ হাসিনা   শান্তির দূত   জো বাইডেন   ইরান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অন্ধকার ছয়দিন

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের লোডশেডিং চলছে। গত বুধবার থেকে সংবাদপত্র বের হচ্ছে না। টানা ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধের বিশ্ব রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। না কোন প্রতিবাদে নয়, দাবী আদায়ের জন্য নয়। ছুটির ফাঁদে সংবাদপত্র বন্ধ আছে। সংবাদপত্রকে বলা হয় জরুরী সেবা। চিকিৎসক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা যেমন জরুরী সেবা দেন, তেমনি সংবাদকর্মীদের কাজও হলো দেশের মানুষকে সার্বক্ষণিকভাবে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয়া। বিশেষ করে ছুটির সময় এটার প্রয়োজন আরো বেশী। এবার দেশে একটা দীর্ঘ ছুটি। এসময় সংবাদপত্র অনেক জরুরী। আচ্ছা ভাবুন তো, ছয়দিন যদি হাসপাতালে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো, কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বলতো ছয়দিন তারা দায়িত্ব পালন করবে না। তাহলে কি হতো? আমিতো মনে করি, সংবাদপত্র বন্ধ রাখার বিষয়টিও তেমনি আঁতকে ওঠার মতো। কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকদের এনিয়ে বিকার নেই।  

এবার বাংলাদেশ দু’টি বড় উৎসব কাছাকাছি সময় উদ্যাপন করছে। ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে না করতেই, আগামীকাল (রোববার) ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব। এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। তবে বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর কেবল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব নয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে আনন্দ করে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই রীতি চলে এসেছে দীর্ঘদিন। ইদানিংকার মতো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন ধর্মীয় উৎসবকেই দেখা হতো না। ঈদের দিন অন্য ধর্মের বন্ধুরাও বাসায় আসতো সেমাই মিষ্টি এক সাথে খাওয়া হতো। আবার হিন্দুদের পূজাতেও আমরা যেতাম। অনেক মজা হতো। যতো দিন যাচ্ছে আমাদের ধর্মীয় উদার নৈতিক চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছে ধর্মান্ধ সংকীর্ণতা। এখন ঈদ উৎসব যেন অনেকটাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলিত। রমজান মাস জুড়ে এক ধরনের কঠোর বিধি নিষেধ থাকে যা স্বতঃস্ফূর্ত না। আরোপিত এবং লোক দেখানো। এই আরোপিত বিধি নিষেধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কিছু ‘বক ধার্মিক’। এদের কারণে গত তিন ঈদে পহেলা বৈশাখ নির্বাসিত ছিলো। পবিত্র রমজানের সাথে পহেলা বৈশাখের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু তারপরও অতি উৎসাহী কট্টরবাদীদের দাপটে শৃঙ্খলিত হয় পহেলা বৈশাখ। অথচ বাঙালী হিসেবে পহেলা বৈশাখীই আমাদের প্রথম এবং প্রধান সর্বজনীন উৎসব। বাংলা বর্ষ বরণ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বেশ কয়েক বছর পর এবার পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হবে বাঁধাহীন ভাবে। বাঙালী জাতি বর্ষবরণ করবে মুক্ত ভাবে। এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের উপলক্ষ্য তো বটেই। কিন্তু এত বড় উৎসব হবে সংবাদপত্রহীন! কি অদ্ভুত! সংবাদপত্র কি দায়িত্বহীন মালিকানার শিকার?

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট। কিছু মানুষ যতোই কট্টর মৌলবাদী হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখনও উগ্র পন্থাকে সমর্থন করে না। এজন্য একই সময়ে একাধিক ধর্মাবলম্বীদের উৎসব এদেশে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়। এবার রমজানের কথায় ধরা যাক না কেন। এবার রমজানের মধ্যেই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ‘ইস্টার সানডে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোজার মধ্যেই দোল উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায় রং উৎসবে মেতেছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বলেননি যে, রোজার জন্য ইস্টার সানডে করা যাবে না কিংবা দোল উৎসব বন্ধ রাখতে হবে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় কিছু উপরের তলার মানুষ। যারা ধর্ম প্রতিপালনের চেয়ে লোক দেখানোতে বেশী আগ্রহী। এদের হাতে ধর্ম এবং সংস্কৃতি কোনটাই নয়। এবার ঈদের পরপরই পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হচ্ছে-এজন্য আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এটি এক অনন্য সুযোগ। এর মাধ্যমে প্রমাণ হতে পারে আমরা বাঙালী, আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা উদার। এদেশের মানুষ যেমন ঈদ উৎসব করলো তেমনি বাংলা নববর্ষকেও বরণ করবে। এই বর্ষ বরণের উৎসব যেন ঢেকে দিচ্ছে সংবাদপত্রে ছুটি। এবার ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিকরা। ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে মোট ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার এক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংবাদপত্র মালিকরা। পহেলা বৈশাখে কেন সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে? কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ‘ঈদ সংখ্যা’ সাময়িকী প্রকাশ করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই সব সাময়িকী গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি আশা করেছিলাম এবার যেহেতু কাছাকাছি সময়ে ঈদ এবং বর্ষবরণ তাই সংবাদপত্রগুলো পহেলা বৈশাখে একটা ছোট সাময়িকী করবে। আলাদা আলাদা সাময়িকী না করুক ঈদ সংখ্যা এবং নববর্ষ সংখ্যা মিলিতভাবে করবে। কিন্তু কোথায় কি, এবার পহেলা বৈশাখে কোন সংবাদপত্রই বেরুচ্ছে না। শুধু পহেলা বৈশাখ কেন? বাংলাদেশে এখন চলছে অন্ধকার সময়। ১০ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল দেশে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। এটি নজীর বিহীন। 

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, এ যুগে সংবাদপত্র ৬ দিন না ৬ মাস বন্ধ থাকলো কার কি? এখন সংবাদের জন্য কে আর দৈনিক পত্রিকার অপেক্ষা করে? অনলাইন, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়ার এই যুগে কেউ আর খবরের জন্য সকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষা করে না। সকাল বেলা এক কাপ চায়ের সাথে একটি সংবাদপত্র এখন উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ নয়। এসব ঘটনা প্রিন্ট মিডিয়ার অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত। কিন্তু তারপরও প্রিন্ট মিডিয়া এখনও বিশ্বস্ততা এবং আস্থার প্রতীক। একজন পাঠক টেলিভিশনে বা অনলাইনে যতো সংবাদই দেখুক বা পড়ুক না কেন, দিনের শেষে তার নির্ভরতা ছাপা কাগজ। অনলাইনে কোন সংবাদ পাঠ করার পর তার সত্যতা যাচাই করে ছাপা কাগজে। তাই এখনও সংবাদ, সঠিক তথ্যের জন্য প্রধান নির্ভরতার জায়গা হলো সংবাদপত্র। তথ্যের এই বিশ্বস্ত উৎস বন্ধ আছে। টানা ছয়দিনের জন্য দেশের মানুষ সংবাদপত্র পাবে না। এই ছয়দিনকে বলা যায় অন্ধকার সময়। সংবাদপত্র বিহীন একটা দিন মানে অন্ধকার দিন-রাত্রি। গত ১০ এপ্রিল থেকে অন্ধকার ছয়দিন শুরু হয়েছে। আমরা যারা সেকেলে মানুষ। ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা খুঁজি তাদের জন্য এই ছয়দিন দূর্বিসহ, অবর্ননীয়। 

প্রশ্ন হলো সংবাদপত্রের মালিকরা কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলো? এই সিদ্ধান্ত দেশের সংবাদপত্র শিল্পকে আরো সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের মালিকানা শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের দখলে। প্রধান সব সংবাদপত্রই কোন না কোন শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। বড় শিল্পপতিদের কাছে সংবাদপত্র হলো মর্যাদার প্রতীক। মুক্ত সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পাঠকের কাছে দায় বদ্ধতা ইত্যাদি ব্যবসায়ীদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। সংবাদপত্র এখনকার মালিকদের কাছে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘অস্ত্র’। এই ক্ষমতা দেখিয়ে তারা তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে। সুদৃঢ় করে। সরকার সংবাদপত্র মালিকদের ভয় পায়। ব্যাংক তো তটস্থ থাকে। তাই পত্রিকা থাকা মানে ব্যবসায়ীদের সব মুশকিল আসান। কর্পোরেট হাউসে এখন সাংবাদিকতা নেই, এক ঝাঁক ক্রীতদাস আছে। যাদের একমাত্র কাজ মালিকদের মনোরঞ্জন করা। এদের মধ্যে যিনি সম্পাদক তিনি হলেন সবচেয়ে বড় ক্লাউন। মালিকদের খুশী করাই তার একমাত্র কাজ। পেশাগত উৎকর্ষতা চুলোয় যাক। যিনি মালিকের স্বার্থ যতো নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত করেন তিনি ততো বড় সম্পাদক। এই অস্ত্র প্রয়োগ করে মালিকরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায়। যারা তাদের কথা শোনে না তাদের এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যবসায়ীদের কাছে একধরনের বর্মের মতো। নিজেদের অপকর্ম, স্বেচ্ছাচারিতা জায়েজ করার জন্য সংবাদপত্রকে তারা ব্যবহার করে। সংবাদপত্রের মালিক হবার কারণে কেউ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। এভাবেই চলছে সংবাদপত্র শিল্প। সংবাদপত্র এখন কর্পোরেট ক্রীতদাস। তাই মালিকরা সংবাদপত্র দুই দিন বন্ধ থাকলো না ছয়দিন বন্ধ থাকলো তা নিয়ে ভাবেন না। তারা তাদের ব্যবসা সুরক্ষা পত্রিকা দিয়ে কতটা হলো তা নিয়েই ব্যস্ত। সংবাদপত্র মালিকরা পাঠকের কাছে জবাবদিহিতার বিশ্বাসী নন। তারা দেখেন এই সংবাদপত্র তাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পারছে। ছাপা কাগজ একদিন বের না হলে অনেক সংবাদপত্রের অনেক টাকা সাশ্রয়। এসব বিবেচনা করেই মালিকরা মনে করেছেন পত্রিকা যদি কয়েকটা দিন বন্ধই থাকে, কি এমন ক্ষতি। কিন্তু এই ছয়দিন সংবাদপত্র বন্ধ যে এক ভয়ংকর বার্তা দিলো তাকি মালিকরা অনুধাবন করেন? সংবাদপত্র ছাড়াও যে দেশ চলে, এমন এক ঘোষণাই কি দিলেন না মালিকরা। ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সরকারের তিন মাস: সেরা অর্জন

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

প্রথম তিন মাস বর্তমান সরকারের জন্য ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করার ফলে এই নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয়, নির্বাচনের পর কী ধরনের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেটি ছিল সকলের কাছে একটি দেখার বিষয়। তবে সরকার প্রথম তিন মাসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট গুলোকে ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত সরকারের চেষ্টা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন রকম অভিযোগ নেই। 

সরকার এই প্রথম তিন মাসে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে;

১. নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আদায়: ৭ জানুয়ারি নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এটি সরকারের একটি প্রধান অর্জন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই নির্বাচনকে কীভাবে দেখবেন? নির্বাচনের পরে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলের নানা রকম আগাম পূর্বাভাস ছিল, সংশয় ছিল। কিন্তু এই সংশয় উড়িয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জন করেছে। নির্বাচনের পর প্রায় সব দেশই নতুন সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছে। এটি সরকারের জন্য একটি বিরাট অর্জন। এই সরকার যে এত তাড়াতাড়ি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। 

২ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনিয়ম দূর করার জন্যই সাঁড়াশি উদ্যোগ: নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। সুন্নতে খতনা করতে গিয়ে একাধিক শিশুর মৃত্যু, অবৈধ হাসপাতালে রোগীদের ভুল চিকিৎসার মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তার সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে হাসপাতালগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। অবৈধ বেশ কিছু ক্লিনিক হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে দুর্নীতির মধ্যে ডুবে ছিল তা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মানুষ সরকারের এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়েছে এবং আশা করছে যে, এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধের ক্ষেত্রে তার অবস্থান অটুট রাখবেন এটাই সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে।

৩. সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি: এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি বটে, তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সরকার সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রির যে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে ভ্যান রমজান মাসে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম, মাংস বিতরণ ব্যাপকভাবে ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকাগুলোর মানুষকে সুবিধা দিয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে মিলে দেশের ৩৫ টি জেলায় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন নিজস্ব উদ্যোগে সুলভ মূল্যে রমজানের পণ্য বিতরণ করার মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তরমুজ নিয়ে যখন কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেছে তখন কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকের বাজারের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে তরমুজ বিক্রি করে একটি নজির স্থাপন করেছে। এটি সরকারের জন্য একটি বড় শিক্ষা যে, বিকল্প চ্যানেলের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে পণ্য দিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তা খুব উপকার দেয়।

৪. ব্যাংক একীভূত করা: ব্যাংক একীভূতকরণ উদ্যোগটি নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরেই করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, যে সমস্ত দুর্বল ব্যাংক আছে, সেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সকল ব্যাংক একীভূত করবে এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় সীমা বেঁধে দিয়েছে। এই নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যে পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী, কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সহ একাধিক ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। এর ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে সকলে প্রত্যাশা করেন এ সমস্ত ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া বানানোর ক্ষেত্রে যারা দায়ী তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাদেরকে ছাড় দেওয়ার জন্য যেন ব্যাংক একীভূত না হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

৫. অবৈধ দালান-কোঠার বিরুদ্ধে অভিযান: বিশেষ করে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর গৃহায়ন পূর্ত মন্ত্রণালয় অবৈধ দালান এবং অনুমোদিত ভবনের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছে তা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারের নতুন গৃহায়ন পূর্ত মন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা। এখন পর্যন্ত যে অভিযান চলছে সেই অভিযান সরকারের সফল উদ্যোগের একটি বলেই অনেকে মনে করছেন। এছাড়াও সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ভালো কাজ করছে, যে কাজগুলো ফলাফল পেতে সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে। 


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

তোফায়েল আহমেদ: রাজনীতিতে অস্তমিত সূর্য

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ০৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

তোফায়েল আহমেদ কি রাজনীতিতে এক অস্তমিত সূর্য? তিনি কি নিভে যাচ্ছেন? বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে তিনি কি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন—এমন প্রশ্নগুলো এখন খুব বড় করে সামনে এসেছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে যারা তোফায়েল আহমেদকে দেখেছেন তারা আগের তোফায়েল আহমেদের ছায়াকেও দেখতে পারেননি। যে তোফায়েল আহমেদ ছিল সরব, যার ভরাট কণ্ঠস্বরে জাতীয় সংসদ প্রকম্পিত হত, যিনি সবসময় সবাইকে চমকে দিতেন বিভিন্ন দিন তারিখের হিসেব মুখস্থ বলে দিয়ে, যার সবসময় শত শত টেলিফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা মুখস্থ থাকত, যা স্মৃতিশক্তি নিয়ে সকলে প্রশংসা করত, রাজনীতিতে যিনি একজন যুবরাজের মত পদচারণা করতেন, নানা রকম বিতর্কের পরও তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন সেই তোফায়েল আহমেদ এখন কোথায়? 

এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তোফায়েল আহমেদ জয়ী হয়েছেন। সংসদে তাকে দেখা যায় কদাচিৎ। তবে তিনি এখন শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনেকটাই বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন। বিশেষ করে একাধিক অসুস্থতা তাকে এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটা চলা করতে দেয় না। তার কণ্ঠস্বরের তেজও কেড়ে নিয়েছে তার একের পর এক অসুখ। 

তোফায়েল আহমেদের এক পাশ অনেকটাই অবশ হয়ে গেছে। আর এ কারণেই তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তবে এখনও তিনি লেখালেখি করেন এবং নানারকম রাজনৈতিক আলোচনায় তাকে আগ্রহীও দেখা যায়। তবে আগের যে তোফায়েল আহমেদ, যিনি যে কোন রাজনৈতিক আড্ডা এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মধ্যমণি হিসেবে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন, যার দিকে তাকিয়ে থাকত লক্ষ লক্ষ জনতা সেই তোফায়েল আহমেদ এখন নেই। 

অনেকেই মনে করেন যে, রাজনৈতিক অসুস্থতার চেয়ে মানসিক ভাবেই তোফায়েল আহমেদ বেশি বিপর্যস্ত। বিশেষ করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তার ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরুর প্রেক্ষাপটেই রাজনীতিতে তিনি নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন। 

গত বছর আগস্টে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় শোক দিবসের স্মরণে এক লেখায় কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু যখন আক্রান্ত হন, ৩২ নম্বর যখন খুনিরা ঘিরে ফেলে তখন তিনি বেশ কয়েক জনকে ফোন করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তোফায়েল আহমেদে। হতাশাজনক হলেও তোফায়েল আহমেদ সেই টেলিফোনের পর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। এই লেখাটির পর আওয়ামী লীগের মধ্যে তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। অনেকে এটা নিয়ে হৈ চৈ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তোফায়েল আহমেদ এর প্রতিবাদও করতে পারেনি। কারণ আওয়ামী লীগ সভাপতিকে যারা চেনেন তারা সকলেই জানেন যে, বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে তিনি তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোন বক্তব্য দেন না। এই ঘটনার পর আকস্মিকভাবে তোফায়েল আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাকে চিকিৎসার জন্য বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেকে মনে করেছিলেন তিনি হয়ত নির্বাচন করবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন অসুস্থ শরীর নিয়ে। 

এখন তিনি জাতীয় সংসদে আসেন বটে তবে আগের মত সরব উপস্থিতি তার নেই। হয়ত রাজনীতির জীবনে তিনি শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। তবে রাজনীতির ইতিহাসে তোফায়েল আহমেদ চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তার রাজনৈতিক জীবনের দুটি ভাগ সবসময় আলোচিত থাকবে। একটি হল স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে তরুণ তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। আরেকটি হল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তার বিতর্কিত এবং রহস্যময় ভূমিকা। কোন তোফায়েল আহমেদ ইতিহাসে বেশি আলোচিত থাকবেন তা সময়ই বলে দেবে।



তোফায়েল আহমেদ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

জামায়াত যেভাবে বেঁচে আছে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৮ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

স্বাধীনতার মাসে জামায়াতে ইসলামী ঢাকার এক পাঁচতারকা হোটেলে জমকালো ইফতার পার্টির আয়োজন করে। ৮ বছর পর গত ৩০ মার্চ ঢাকার প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এই আয়োজন করেছিল জামায়াত। এই ইফতার পার্টিতে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যসহ ১৮ জন বিএনপি নেতা যোগ দেন। এই ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলটি তাদের অস্তিত্ব নতুন করে জানান দিল। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের দৃশ্যমান তৎপরতা কারও নজর এড়ায়নি। নির্বাচনের আগে থেকেই জামায়াত গুহা থেকে বের হতে শুরু করে। গত বছর জামায়াত দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্য সমাবেশ করে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কর্মিসভার আদলে এই সমাবেশের মাধ্যমে জামায়াত রাজনীতিতে নতুন করে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে। নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল জামায়াত দীর্ঘদিন পর মূলধারার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন শুরু করে। ইদানীং জামায়াত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিও দিচ্ছে।

কদিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার মুক্তি এবং বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দলটি এক বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সংগঠিত হওয়ার খবর আসছে। বুয়েটে শিবির এখন বেশ শক্তিশালী—এমন দাবি করছেন অনেকেই। শিবির ও হিজবুত তাহরীর প্ররোচণাতেই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবস্থান বলে অনেকে মনে করেন। উপজেলা নির্বাচনেও জামায়াত প্রার্থী দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতপন্থিরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। জেলায় জেলায় জামায়াতের সংগঠিত হওয়ার খবর এখন আর গোপন বিষয় নয়। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির অনেক নেতাই। রাজনীতির মাঠে এখন আলোচনার বিষয় ‘জামায়াত-বিএনপির কাছে আসার গল্প’। সব কিছু মিলিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী এই রাজনৈতিক সংগঠনটির পুনর্জন্ম হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে ’৭১-এর পরাজিত রাজনৈতিক দল জামায়াত। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের টিকে থাকারই কথা ছিল না। ’৭১-এর অপকর্মের জন্য এ দলটির ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যতবার অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, ততবারই নানা কৌশলে দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এবারও তাই। এবারের চিত্রটা বেশ আতঙ্কের। বাংলাদেশে একদিকে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নীরব উত্থান ঘটেছে। অন্যদিকে জামায়াত নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। আমি মনে করি, দুটি ঘটনা এক সূত্রে গাঁথা। এটি বাংলাদেশের জন্য আগামীর সংকটের বার্তা দেয়। কিন্তু এটা কেন ঘটছে?

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সে সময় এটি ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য এবং সাহসী একটি সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম ছাড়া খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেছিল এই ঘোষণা। এই অবিশ্বাসের যৌক্তিক কারণ ছিল। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। এখান থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টো চলা। শুরু হয় বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো মিশন। জিয়া ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন শুরু করেন। তিনি দালাল আইন বাতিল করেন। রাজাকার, আলবদরদের জেল থেকে মুক্তি দেন। লন্ডনে বসে ‘পাকিস্তান মুক্তি আন্দোলনে’ নেতৃত্ব দেওয়া যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক বড় স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ কারণেই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়া সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের এই বিধান বাতিল করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে সামরিক গোয়েন্দাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিএনপিতে তিনি রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করেন।

বহুল আলোচিত রাজাকার, মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজকে জিয়া প্রধানমন্ত্রী বানান। এখান থেকে শুরু। এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ২১ বছরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং যুদ্ধাপরাধীরা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। ক্ষমতা কেন্দ্রে তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছিল। প্রশাসনে, বিচার বিভাগে, সশস্ত্র বাহিনীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। সব জায়গায় তাদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একাত্তরের পরে জামায়াত আবার মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘হালাল’ হয় জামায়াত। ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জামায়াত সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। স্বাধীনতার মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত সরকারের হিস্যা হয়। এ সময় জামায়াত তার মুখোশ খুলে আসল চেহারা বের করে। যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে তারা দলের ‘আমির’ ঘোষণা করে। জামায়াতের এই ধৃষ্টতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় মুক্ত বুদ্ধির সচেতন নাগরিকবৃন্দ। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল হয় গোটা দেশ। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বিএনপি গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারে বাধ্য হয়। ‘গণআদালতে’ বিচার হয় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের। লাখো মানুষ এই বিচারে সংহতি জানায়। সরকার গণআদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু না করে আয়োজকদের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ জননী এবং বরেণ্য বুদ্ধিজীবী হলেন দেশদ্রোহী! আর আইনি মারপ্যাঁচে গোলাম আযম পেল নাগরিকত্ব। শহীদ জননী যে চেতনার মশাল জ্বালিয়েছিলেন, তা তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করে। এখান থেকেই যুদ্ধাপরাধী বিরোধী একটি জনমত তৈরি হয়।

এদেশের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান নেয়। তারুণ্যের এই জাগরণের কান্ডারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি জনমত সৃষ্টি হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ বিজয় পায়। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন পেয়ে এই জোট সরকার গঠন করে। দুই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে উড়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত পবিত্র জাতীয় পতাকা। এ ঘটনা তরুণ প্রজন্মকে আরও বিক্ষুব্ধ করে। ক্রমশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তরুণ প্রজন্মের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ তরুণদের হৃদয়ের কথা অনুভব করতে পেরেছিল। তবে, অনেকেই সে সময় বলেছিল, তরুণদের আকৃষ্ট করতেই আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নির্বাচনী ইশতেহারে দিয়েছে। আদৌতে বিচার করবে না। এদের বিচার করা অসম্ভব—এমন কথা বলার লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে শেখ হাসিনা অসীম সাহস এবং দৃঢ়তার পরিচয় দেন। এই একটি সিদ্ধান্তই তাকে অমরত্ব দিয়েছে। একে একে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় এবং রায়ও কার্যকর হতে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এক অভাবনীয় ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের মতো ঘৃণ্য নরঘাতকদের শাস্তি দিয়ে বাংলাদেশ ইতিহাসের ঋণ শোধ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর ধারণা করা হয়েছিল রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের মৃত্যু সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যখন চলছিল, তখনই নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী দলটি তার নির্বাচনী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ হারায়। সবকিছু মিলিয়ে এক ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে পতিত হয় ধর্মান্ধ মৌলবাদী এই রাজনৈতিক দলটি। স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর জামায়াতের যে অবস্থা হয়েছিল, ২০১৪ সাল থেকে তাদের একই অবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রথম সারির সব নেতা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে জামায়াত নেতৃত্বশূন্য হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটবে, প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো বিকশিত হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো চিত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর বাংলাদেশে উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশ সংকুচিত এবং বিলীন প্রায়।

অন্যদিকে দক্ষিণপন্থি উগ্র মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নতুন করে হচ্ছে শক্তিশালী। বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক দলগুলোই অস্তিত্বের সংকটে। অন্যদিকে ধর্মান্ধ, রাজনৈতিক দলগুলো মাথা চাড়া দিচ্ছে। জামায়াত ছাড়াও হেফাজতে ইসলামী, খেলাফাত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মতো দলগুলো এখন জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ে শক্তিশালী। এমনকি সংসদে তথাকথিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়েও ইসলামী দলগুলোর শক্তি ও সমর্থক বেশি। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে জামায়াত বিলীন হচ্ছে জন্যই ইসলাম পছন্দ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিকশিত হচ্ছে। ইসলাম পছন্দ জামায়াত অনুসারীরা এসব দলে ভিড় করছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। দেশে গত এক দশকে দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আবার জামায়াতও বেঁচে আছে। নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। নতুন কর্মীও এই দলে যুক্ত হচ্ছে। এর কারণ কি? এর কারণ বহুমাত্রিক। তবে প্রধান কারণ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতকে আদর্শিকভাবে পরাজিত করতে পারেনি বা হারানোর চেষ্টা করেনি। পেশি শক্তি দিয়ে জামায়াতকে নিঃশেষ করার চেষ্টা সফল হয়নি। এই চেষ্টা কখনো সফলও হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্বে যে আদর্শিক চেতনার উন্মেষ ঘটা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ এরকম একটি আদর্শিক লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্ম হতে পারত। কিন্তু নানা চক্রান্তে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নিজেই মুখ থুবড়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগের বাইরে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে জামায়াত কাজ করেছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে, শিক্ষাঙ্গনে জামায়তী বীজ রোপণ করা হয়েছিল। এরা গোপনে জামায়াতের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা এসব সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বাইরে আওয়ামী লীগ ভেতরে তারা জামায়াতের জন্য কাজ করছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। আওয়ামী লীগ এদের মূল উৎপাটন করতে পারেনি। এদের চিহ্নিত করতে পারেনি। এরা আওয়ামী লীগ সেজে জামায়াতের পক্ষে কাজ করছে। এরকম অনেক উদহারণ দেওয়া যায়। শেষ ঘটনার উদাহরণটাই দেখা যাক, ৩০ মার্চ সোনারগাঁও হোটেলে জামায়াত ইফতার পার্টি করল। সোনারগাঁও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচতারকা হোটেল। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকার বলে এর পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান। পরিচালনা বোর্ডে আছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব, পররাষ্ট্র সচিবের মতো আমলারা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোটেলে অনিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল (তাও আবার জামায়াত) ইফতার পার্টি করে কীভাবে? এভাবেই সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতপন্থিরা, ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা জামায়াতকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

৭৫ এর পর স্বাধীনতাবিরোধীরা ব্যবসা-বিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল আছে। বহাল আছে যুদ্ধাপরাধী সা.কা. চৌধুরীর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। অর্থবিত্তে ভালো অবস্থান থাকায় জামায়াতের পক্ষে পুনঃসংগঠিত হওয়া কঠিন হয়নি।

জামায়াত রাজনীতিতে সবসময়ই পেয়েছে বিশ্বস্ত মিত্র বিএনপিকে। বিএনপির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ককে ‘ভাই-ভাই সম্পর্ক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বাস্তবেও তাই, জামায়াত এবং বিএনপির সম্পর্ক যেন ফেভিকলের মতো। কিছুতেই তাদের আলাদা করা যায় না। কিছুদিন নানা পারিপার্শ্বিকতায় দুই ভাইয়ের সম্পর্কে দৃশ্যমান দূরত্ব হলেও এখন তারা আবার ঘনিষ্ঠ হবে। দুই দল একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। এটাও জামায়াতের বেঁচে থাকার একটি বড় কারণ।

তবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। জামায়াত বেঁচে আছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর নীরব উত্থান হচ্ছে। একলা আওয়ামী লীগকে সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাবে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। সেই লড়াই হবে অস্তিত্ব রক্ষার। আওয়ামী লীগ যদি সে যুদ্ধে পরাজিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে আরেকটি আফগানিস্তান।

 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   জামায়াত ইসলাম   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন