এডিটর’স মাইন্ড

মারিয়া কৃষ্ণা সাবিনা এবং একজন শেখ হাসিনা

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২


Thumbnail মারিয়া কৃষ্ণা সাবিনা এবং একজন শেখ হাসিনা

কৃষ্ণা রানী সরকার যখন কোনাকুনি শটে নেপালের জালে তৃতীয় গোলটি দিল তখন আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, অনুমান করি আমার মতো অনেকেই ১৯ সেপ্টেম্বর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশে এখন নানা শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, হতাশা। ব্যর্থতার চোরাবালিতে আটকে গেছে আমাদের প্রিয় ক্রিকেট। এর মধ্যে আমাদের মেয়েদের এ অসাধারণ সাফল্য যেন তীব্র দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টি। এ সাফল্য কেবল সাফজয় নয়। আমি এটাকে কেবল একটি টুর্নামেন্ট বিজয় হিসেবে দেখি না। এ জয় মৌলবাদ, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। এ জয় প্রান্তিক মানুষের। এ জয় অদম্য লড়াকু বাঙালি নারীর। ওরা ১১ জন যেন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। যখন নারী কী পোশাক পরবে তা নিয়ে নিদ্রাহীন কিছু মানুষ। পোশাকের জন্য নারী হেনস্তা হচ্ছে। যে সময় বিষণ্নতায় কিশোরী-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ যুগেও নারীর পথচলা নতুন করে দুর্গম হচ্ছে, তখন সাবিনা, রুপনা চাকমা, মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণা রানী সরকার যেন একেকটা আলোকবর্তিকা। তারা যেন মশাল জ্বালিয়ে পথ দেখালেন বাংলাদেশের সব নারীকে। ফাইনালের আগের দিন সানজিদা আক্তার তার ফেসবুকে লিখেছিলেন- ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজন যোদ্ধাদল মাঠে থাকব। যে দলের অনেকে এগিয়ে এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধে লড়ে অভ্যস্ত।’ এ নারী দলের কারা কীভাবে সংগ্রাম করে এসেছেন তা আমাদের গণমাধ্যমের কল্যাণে এখন সবার জানা। এ নারীরা কী অসাধ্য সাধন করেছেন, কী প্রবল প্রতিপক্ষকে উপেক্ষা করে তারা খেলায় টিকেছেন তা এখন আমরা সবাই মোটামুটি জানি। কলসিন্দুর গ্রামের গল্প, সাতক্ষীরায় সাবিনার যুদ্ধ। রক্ষণশীলদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রংপুরের পালিচড়ার রামজীবন গ্রামের মৌসুমীর সংগ্রামের কাহিনি এখন আমরা জানি। কলসিন্দুরের মফিজ স্যার, রংপুরের কোচ মিলন, রাঙামাটির শান্তিমণি চাকমা ও বীর সেনদের মতো উজাড় করা প্রশিক্ষকদের অবদানের কথাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চা হচ্ছে। ‘মেয়েদের কোচ’ এ পরিচয়ে লজ্জা না পেয়ে গোলাম রব্বানী ছোটন যেন পিতার মতো তাদের বড় করেছেন।

১৯ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের সব গণমাধ্যমেই এ নিয়ে নানা লেখা-ফিচার পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি। আবেগাপ্লুত হচ্ছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বেশির ভাগ গণমাধ্যমই নারী ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যের মানুষটিকে উহ্য রেখেছে। তাঁর নাম আলোচনায়ই নেই। অথচ তিনি না থাকলে আমাদের নারীরা আদৌ ফুটবল খেলতে পারতেন কি না আমার সন্দেহ। তিনি হলেন শেখ হাসিনা। নারী ফুটবল বিকাশে সবচেয়ে যাঁর অবদান তাঁর নাম নিতে কেন আমাদের এত আড়ষ্টতা?

কলসিন্দুরের মেয়ে মারিয়া মান্ডার কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা আনন্দ করার জন্য ফুটবল খেলতাম। প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। তখন জানতাম না ফুটবল খেললে টাকা পাওয়া যায়। বিদেশে যাওয়া যায়। এখন বুঝি ফুটবলের মূল্য। অনেকের টাকা আছে কিন্তু বিদেশে সবার যাওয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কজনের হয়। আমরা তাঁর সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছি। আমাদের টাকা দিয়েছেন। আদর করেছেন।’ মারিয়া মান্ডার বক্তব্য থেকেই জানা যায় বাংলাদেশে নারী ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যচারিণী কে। তাঁর নাম শেখ হাসিনা। তাঁর উৎসাহে-পৃষ্ঠপোষকতায় নারীরা আজ দেশের জন্য এ সম্মান বয়ে এনেছেন। আমাদের অদম্য মেয়েদের পথ তৈরি করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমাদের রাজনীতিবিদদের অদ্ভুত এক ব্যাধি আছে। কোনো অর্জন হলে তাতে তাঁর দলের হিস্সা খোঁজা। সব কৃতিত্ব একা নিয়ে নিতে চায়। একটা সুখস্মৃতিকে আমার-আমার বলে কাদায় লেপ্টে দেয়। এই যেমন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের নারী দল সাফজয় করে দেশে ফিরল। তাদের ‘খোলা বাসে’ রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হলো। এ সময় মির্জা ফখরুল হঠাৎ এক নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন। তিনি বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সাফ গেমস নারী ফুটবল খেলা চালু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।’ ফখরুল বললেন, ‘আমি পত্রিকায় দেখলাম ডানা (কামরুন নাহার ডানা), যিনি মহিলা ফেডারেশনের একসময় প্রধান ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম টুর্নামেন্টটা বেগম জিয়ার সরকারের সময় অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে শুরু হয়।’ পাঠক লক্ষ্য করুন, সাফ নারী ফুটবল যদি জিয়া শুরু করেন (যিনি ১৯৮১-তে ইন্তেকাল করেছেন) তাহলে ১৯৯১ সালে কিংবা ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া কীভাবে প্রথম টুর্নামেন্ট চালু করলেন? রাজনীতিবিদরা এ রকম গোঁজামিলে বক্তব্য দেন। এজন্য সাধারণ মানুষ তাঁদের কথাকে স্রেফ বিনোদন মনে করেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি তাহলে ক্রমে কৌতুকাভিনেতায় পরিণত হচ্ছেন? বিএনপি মহাসচিব ইদানীং নানা তথ্য আবিষ্কারের জন্য আলোচিত। তাঁর কথায় বেগম জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বেগম জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিংবা খালেদা জিয়ার মানবাধিকার পদক- সবই রাজনীতিতে ব্যাপক কৌতুক জন্ম দেয়। তবে সাফ নারী ফুটবলের জনক জিয়া, এ তথ্য বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব কৌতুক ভাণ্ডারে খুব শিগগিরই স্থান পাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ নারীদের বিশ্বকাপ প্রথম শুরু হয় জিয়ার মৃত্যুর ১০ বছর পর ১৯৯১ সালে। চীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নারী বিশ্বকাপে অংশ নেয় মাত্র ১২টি দেশ। এশিয়ার মাত্র তিনটি দেশের নারীরা ওই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল। দেশগুলো হলো- চীন, জাপান ও চাইনিজ তাইপে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬ সালের আগে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা তাদের সভায় নারীদের কথা বলারও সুযোগ দিত না। এই যখন বিশ্বে নারী ফুটবলের ইতিহাস, তখন মির্জা ফখরুলের ‘জিয়া সাফ নারী ফুটবলের প্রবর্তক’- এ বক্তব্যে দমফাটা হাসি না ডুকরে কান্না করা উচিত, তা নিয়ে আপনার বিভ্রম হতেই পারে। মূলত ১৯৯১ সালে নারী বিশ্বকাপের পরই ফিফা নারী ফুটবলের বিশ্বায়নের অভিযাত্রা শুরু করে। একপর্যায়ে ফিফা তার সদস্যদের জন্য নারী ফুটবল চালু বাধ্যতামূলক করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন নড়েচড়ে বসে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কামরুন নাহার ডানাকে উদ্ধৃত করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ও এক ধরনের তথ্য বিকৃতি। ২০০৩ সালে বাফুফে একাদশ নামে একটি নারী দল গঠন করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি দল আনা হয় প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য। কিন্তু বিএনপির প্রধান শরিক জামায়াত এবং আরও মৌলবাদী সংগঠন এ খেলার বিরুদ্ধে হুমকি দেয়। এমনকি তারা স্টেডিয়াম ঘেরাও পর্যন্ত করে। ফলে তিন ম্যাচের মধ্যে একটি মাঠে গড়ায়। ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের কাছে আত্মসর্মপণ করে বেগম জিয়ার সরকার। বাকি দুটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। এ যেন শুরু না হতেই শেষ হওয়ার গল্প। নারী ফুটবল নিয়ে কীভাবে এগোবে সরকার? যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদীদের শীর্ষ দুই নেতাই তো তখন মন্ত্রী। এরপর নারী ফুটবল বাক্সবন্দি হয়ে যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত রুপনা চাকমা, শিউলি, শামসুন্নাহার যে কত কষ্ট বুকে নিয়ে ফুটবল ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন কে জানে?

ফখরুল যদি বেসামাল কথা বলেন, তখন ক্ষমতাসীন দলের কেউ বেসামাল আচরণ করবে না, তা কী করে হয়। বিমানবন্দরে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নারী ফুটবল দলকে বরণ করে নিল। এরপর ‘ছাদখোলা বাসে’ শোভাযাত্রা। কিন্তু বাফুফেতে যাওয়ার পর ঘটল বীভৎস কাণ্ড। যারা বিজয় আনল তাদের ঠেলে দিয়ে আসন দখল করে নিলেন প্রতিমন্ত্রী, সচিব আর বাফুফে সভাপতি। মনে হলো এরাই নেপালে দশরথ রঙ্গশালায় খেলে এলেন। সাবিনা চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে এক কোনায়, ছোটন তো যেন বাইরের দর্শক। ক্ষমতায় থাকলে যে কিছু মানুষের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় বাফুফেতে সংবাদ সম্মেলন তা আরেকবার প্রমাণ করল। এ কর্তাব্যক্তিরা শুধু কাণ্ডজ্ঞানহীন নন, ন্যূনতম বোধশক্তিহীন। এ অবুঝ নাদানদের কে বোঝাবে এ অর্জন তাঁদের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়, বাংলাদেশের। এটা শেখ হাসিনার চরম শত্রুরাও স্বীকার করবেন, তিনি ক্রীড়া-অন্তঃপ্রাণ। যেখানেই বাংলাদেশ যে খেলাই খেলেছে, সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর সুভাশিস পৌঁছে গেছে। এমনকি এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েও তিনি সাবিনা, রুপনাদের খোঁজ নিয়েছেন বরাবর। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও উন্নতির উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ নারী ফুটবল যুগের সূচনা হয় আসলে ২০০৯ সালেই। তখনো মৌলবাদীদের আস্ফালন ছিল, হুমকি ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব হুমকি-ধমকি প্রশ্রয় দেননি। উল্টো ২০১০ সালে কক্সবাজারে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক হয় বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ নারী দল ভুটানকে ২-০ গোলে, শ্রীলঙ্কাকে ৯-০ গোলে পরাজিত করে। সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হেরে যায়। এরপর ২০১১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে চালু হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা গোল্ডকাপ। স্কুল পর্যায়ে দেশব্যাপী এ টুর্নামেন্টই আসলে নারী ফুটবলের জাগরণের সূচনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসেন আজকের বিজয়ী সাবিনারা। ভালো খেলে একের পর চমক দেখান বাংলার অদম্য মেয়েরা। আর এ জাগরণে নেপথ্য থেকে অফুরান সহযোগিতা করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এএফসি-১৫, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫সহ যখন যেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা জিতেছেন তখনই তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। নারী দলের প্রত্যেক সদস্যকে বিভিন্ন সময় ১ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অনেক পণ্ডিত দেখি বলেন, আর্থিক অনুদান ভালো নয়। এতে ক্রীড়াবিদদের পদস্খলন হয়। ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়ে কেউ কেউ দেখলাম বলার চেষ্টা করছেন ‘এ মেয়েগুলো টাকা পেলে খেলায় মনোযোগ দেবে না।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঠিকই জানেন দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করে এরা ফুটবল খেলছেন। অর্থনৈতিক শক্তি না থাকলে এরা এগোতে পারবে না। নারী স্বাধীনতার জন্য চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পুরস্কারের অর্থের সুবাদে এরা শক্তি পেয়েছেন, সাহস পেয়েছেন। পরিবার এদের জেদ মেনে নিয়েছে। শুধু আর্থিক অনুদান নয়, রুপনা চাকমার মতো অনেক নারী ফুটবলারকে শেখ হাসিনা জমি দিয়েছেন। দিয়েছেন ঘর উপহার। এর ফলে হতদরিদ্র বাবা-মারা সমাজকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পেয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছার মূল্য দিয়েছেন। কিন্তু শুধু উপহার এবং অনুদান দিয়ে তো প্রতিদিনের জীবন চলে না। এজন্য দরকার আর্থিক নিশ্চয়তা। খেলাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে সাবিনা, স্বপ্না, মনিকাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসবে। নতুন রুপনা, শিউলি, মাসুরারা আসবে না। এ ক্ষেত্রে এক অসাধারণ উদ্যোগ নেয় দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং উৎসাহে বসুন্ধরা নারী ফুটবল দল গঠিত হয়। এবার সাফজয়ী নারী দলের প্রথম একাদশের আটজনই বসুন্ধরা কিংসের হয়ে ঘরোয়া লিগে খেলেন। বসুন্ধরা গ্রুপ এই নারীদের অনিশ্চয়তার আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছে। আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বপ্নের সীমানা অনেক বড় করে দিয়েছে। নারী ফুটবলের এ জাগরণে এ বৃহৎ শিল্প পরিবারের অবদান বিরাট। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত নারী ফুটবলকে একটা কাঠামো দিয়েছে। একটা রূপকল্প দিয়েছে। স্কুল ফুটবল, ঘরোয়া লিগ, জাতীয় দল এ বিন্যাস নারী দলকে এগিয়ে দিচ্ছে। একজন কিশোরী এখন জানে, এটি শুধু তার শখ কিংবা নেশা নয়। তার পেশা। এ পেশায় অর্থ, সম্মান দুই-ই আছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ দেশের নারী ক্রিকেট এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর।

কিন্তু সাবিনা, কৃষ্ণা কিংবা মারিয়া মান্ডাদের এ জয়কে আমি শুধু একটা ট্রফি জয়ের আনন্দের মধ্যে বন্দি করে রাখতে চাই না। এটি কেবল একটি খেলার উৎকর্ষতা নয়। এ জয়ের বহুমাত্রিক তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশ নারী দলের খেলোয়াড়দের দেখুন। যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে। সমতলের আদিবাসী, পাহাড়ি আদিবাসী, বাঙালি। সবাই মিলে একটি দল। যেমন সবাই মিলে এই বাংলাদেশ। এ তরুণ প্রাণ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েরা কীভাবে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ উপড়ে ফেলেছেন। এ রকম একটি বাংলাদেশের স্বপ্নই তো আমরা দেখেছিলাম একাত্তরে। আমাদের স্বাধীনতার স্লোগান ছিল- ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালি’। সেই স্লোগানে এ নিপুণ চিত্ররূপ যেন মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণা আর সাবিনাদের দলটি। যখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হিংস্র নখ আবার বেরিয়ে এসেছে, যখন ধর্মীয় উৎসবের আগে আতঙ্কের প্রহর গোনে আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তখন সম্প্রীতির বাংলাদেশের এক চিলতে উঠোন যেন আমাদের নারী ফুটবল দল।

সাবিনাদের আরেকটি ব্যাপার আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরা সবাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে এসেছেন এ অদম্য মেয়েরা। খুব সাধারণ বাঙালি পরিবার। এদের কারও বাবা দিনমজুর, কেউ কৃষক, কেউ ক্ষুদ্র বিক্রেতা, কেউ শ্রমিক, কেউ রাজমিস্ত্রি। এ সাধারণের শক্তি যে কত অপরাজেয় তা বোঝা গেল আরেকবার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন মুটে, মজুর, শ্রমিক, কৃষকের সম্মিলিত বিজয়গাথা। এদের বিজয়টাও তেমনি। এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই আমাদের শক্তি। কলসিন্দুর, রংপুর, সাতক্ষীরা, রাঙামাটির প্রত্যন্ত জনপদই আমাদের বাংলাদেশ। এ প্রান্তিক মানুষই দেশটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এ মেয়েরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটেছেন। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছেন। সমাজের তথাকথিত শৃঙ্খলা এরা উপেক্ষা করেছেন। মানুষের কটূক্তি-উপহাস এরা পাত্তা দেননি। এদের লক্ষ্য ছিল অবিচল। এ মেয়েরা আমাদের সবাইকে বিশেষ করে নারীদের এক বড় শিক্ষা দিলেন। বাধা অতিক্রম করতে হবে। প্রতিকূলতা জয় করেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। কঠিন পরিশ্রম এবং অবিচলে এগিয়ে গেলে লক্ষ্য অর্জিত হবেই। এ শিক্ষাটা কৃষ্ণা, রুপনা, স্বপ্নারা নতুন করে শেখালেন। একটু হতাশায় আত্মহত্যা নয়; খানিকটা ব্যর্থতায় বিষণ্ন্নতা নয়; কঠিন তিরস্কার কিংবা অবহেলায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া নয় বরং এসব পরাজিত করার নামই জীবন। সানজিদা, শিউলি, মনিকারা অভিভাবকদের জন্যও একটা বার্তা দিয়ে গেলেন- আমার মেয়ে পড়তে চায়, তাকে পড়তে দেব। আমার মেয়ে আকাশ স্পর্শ করতে চায়, আমি সায় দেব। আমার মেয়ে গান গাইতে চায়, গান গাইতে দেব। বারবার প্রতিনিয়ত তাকে বলব না, ‘তুমি মেয়ে। তোমাকে সংসার করতে হবে। স্বামীর জন্য রান্না শিখতে হবে। স্বামীর জামা-জুতা সাফ করতে হবে। ইচ্ছা করুক না করুক স্বামীর সঙ্গে শুতে হবে। তাকে সুখ দিতে হবে। তোমার ইচ্ছাটা মুখ্য নয়। তুমি স্বামীর জন্য উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ। এটাই তোমার গন্তব্য।’ যেসব বাবা-মা তাঁদের মেয়েসন্তানদের এ শিক্ষায় গড়ে তুলতে চান, একজন ‘স্বামীর সেবক’ বানাতে চান- শিউলি, সাথী, রিতু তার এক মোক্ষম জবাব। আসুন না আমরা মারিয়া, রুপনা, মনিকাদের বাবা-মায়ের মতো উদার হই। আমাদের মেয়েদের জীবনকে দিই পূর্ণতা। এ জয় সবাইকে এ বার্তাটাও দিয়ে গেল। এ মেয়েদের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে আমি অদ্ভুত মিল পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের। এরা যেন লক্ষ্য স্থির করে বিপরীত স্রোতে সাঁতার কেটে পৌঁছেছে সোনালি বন্দরে। শেখ হাসিনার জীবনটাও তেমনি। এরা যেমন অসম্ভব শব্দটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যাও তেমন। এরা যেমন অবহেলা, বঞ্চনায় হতোদ্যম হননি। তেমনি গল্প শেখ হাসিনারও। বুধবার শুনলাম এ মেয়েরা বারবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। এদের সবাইকে বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ডেকে নিয়ে গেছেন। আদর করেছেন। হয়তো তাঁর সাহস, মনোবল সঞ্চারিত করেছেন এ কিশোরীদের মধ্যে। কী অদ্ভুত! এ সেপ্টেম্বরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। ২৮ সেপ্টেম্বর। জন্মদিনের আগে তাঁর প্রেরণায় অদম্য হয়ে ওঠা মেয়েরা যেন এক বিজয় পালক তুলে দিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। শেখ হাসিনা যেমন তাঁর সব অর্জন এ দেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেন। অপরাজিতরাও তাঁদের বিজয় উৎসর্গ করলেন দেশবাসীকে। শেখ হাসিনার দেখানো পথেই হাঁটছেন এ আলোর পথযাত্রীরা। যে পথের গন্তব্য হলো নারী মুক্তির বাংলাদেশ।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

মারিয়া   কৃষ্ণা   সাবিনা   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।

আকর্ষণহীন, উত্তেজনাহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন শুরু হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রক্রিয়া। যথারীতি উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দল নেই। শেষ মুহুর্তে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্বতন্ত্রভাবেও উপজেলা নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে তিন ধাপে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে দেখা গেল বিএনপির বেশ কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এর পর পরই এলো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই ধারণা করা যায়।। উপজেলা নির্বাচন এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই-ভাতিজা, শালা-মামাদের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই। মানুষের সামনে বিকল্প নেই। সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে কেন যাবে? বিএনপির এই ‘ভোট বর্জন’ কৌশল কি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ? 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন বর্জন, অসহযোগ আন্দোলনও সফল হয়নি। শুধুমাত্র ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়েছেন। যে নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত, সেখানে ভোট দিয়ে কি হবে-এরকম একটি মানসিকতা পল্লবিত হয় ভোটারদের মধ্যে। নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নষ্ট হতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকেই। ঐ নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করেছিল। সে সময় ১৫৩ টি আসনে জনগণ ভোটই দিতে পারেনি। বিএনপির বর্জন দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ২০১৮’র নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এবারও অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী ভোট দিতে যাননি। জনগণের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। অথচ ঐতিহ্যগত ভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ নির্বাচন পাগল। ভোটকে তারা উৎসব মনে করে। সেই উৎসব এখন ভাঙ্গা হটের মতো। দেশের অর্ধেকের বেশী নাগরিক জীবনে ভোটই দেননি। একটি ভোট যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার, এটিই এদেশের মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। এটি বিরাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় উপসর্গ। তাবৎ পন্ডিতরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। বিএনপি তো প্রতিদিন মুখস্থ বুলীর মতো, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার নিয়ে আওয়ামী লীগকে গালাগালি করছে। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষা, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির কি কোন দায়িত্ব নেই? বিএনপি কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? নাকি তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার মিশনে বিএনপি একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে এখন যেতে চাই না। 
এবছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কি পেল? এবার অবাধ, সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপর প্রচন্ড চাপ ছিলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, হুশিয়ারির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের অবাধ, সুষ্টু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতেই হতো। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর জনগণের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো। পশ্চিমা দেশ গুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিল। সব কিছু মিলিয়ে এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা ছিলো অসম্ভব, অলীক কল্পনা। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলো। জনগণ ভোটের মাঠে নানা চিন্তা, মত ও পথের প্রার্থী পেলেন না। বিএনপি বলতেই পারে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না- এটা নিশ্চিত হয়েই তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির এই অনুমান কে মানবে? বিএনপির নির্বাচন বর্জনে দলটির ক্ষতি হয়েছে। জনগণের ক্ষতি হয়েছে। লাভ হয়েছে সুশীল সমাজের। এই নির্বাচন জনগণের মধ্যে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে অনীহা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরীর কাজ হয়েছে আরো ত্বরান্বিত। ২০০৭ সালে এরকম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেই সুশীলরা ক্ষমতা দখল করেছিল। 

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তারপর থেকেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে সুশীল সমাজ। এজন্য বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন সম্মানিত কিছু সুশীল। কিন্তু বিএনপি যদি রাজনীতির পথেই থাকতো, তাহলে নির্বাচনে যেতো। তাদের অভিযোগ জনগণের সামনে তুলে ধরতো। ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনেও বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে দমন পীড়ন, নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আম-আদমী পার্টির প্রধান নেতা কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে পার্লামেন্ট থেকে। কংগ্রেস অভিযোগ করছে, বিজেপি নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাই বলে কংগ্রেস, আম-আদমী পার্টি কিংবা তৃণমূল কি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে? না, বরং তারা এই অভিযোগ গুলোকেই নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে, জনগণের কাছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর যে হতাশা এবং অস্থিরতা তা দেখে আমার মতো অনেকেই মনে করছিল, দলটির ভুল ভাঙ্গবে, আত্ম উপলব্ধি হবে বিএনপির। ভুল শোধরানোর জন্য হলেও উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য অনবদ্য এক সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবে না। ফলে বিএনপিও এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়া অংশগ্রহণ করলে ভোটে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরী হতো। বিএনপি এবং তার গোপন এবং প্রকাশ্য মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নিলে গণতন্ত্রের রক্তশূন্য শরীরে রাজনীতির রক্ত সঞ্চালিত হতো। উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ‘রাজনীতি’ কে আরো দুর্বল এবং মুমূর্ষু করলো। বিএনপি দেশে গণতন্ত্র চায় না। জনগণের অধিকারও চায়না। তারা শুধুমাত্র চায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এর বিপরীতে প্রশ্ন উঠতেই পারে আওয়ামী লীগ কি মুক্ত, সুস্থ রাজনীতি চায়? আওয়ামী লীগ কি গণতন্ত্রের বিকাশ চায়? রাজনীতি হত্যার উৎসবে কি আওয়ামী লীগও সামিল নয়? 

টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কৌশল যেভাবে রপ্ত করেছে, ঠিক সেভাবে কি সংগঠনকে নীতি ও আদর্শের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে? আওয়ামী লীগের ভেতরে কি কোন রাজনীতি আছে? আদর্শ চর্চা আছে? প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই কি নিজেকে হত্যা করছে না? সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলটি কোন্দল বিভক্তিকে সাংগঠনিক স্বীকৃতি দেয়। দেশে এখন কোন বিরোধী দল নেই। কোথাও সরকারের সমালোচনা নেই। সবাই সরকারকে ‘সাধু সাধু’ করে। আওয়ামী লীগ এখন একাধিক টীম হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলছে। কোন্দলকে দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। বিএনপি-জামায়াতের দরকার নেই, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই একে অন্যের চরিত্র হনন করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে, খুন করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারা এসব কোন্দলকে পাত্তা দিতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন আত্ম তুষ্টির সর্বোচ্চ চূড়ায়। কোন বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। তাদের মতে, বিরোধী দল নেই, তাই একাধিক গ্রুপ থাকলে দল শক্তিশালী হবে। কর্মী বাড়বে। দলে ভারসাম্য থাকবে। একজন এমপি বলছিলেন, সবাই তো শেখ হাসিনার। যে জিতবে, সেই আপন। যে হারবে, সে জয়ীকে চাপে রাখবে। এরকম ‘চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স’ কৌশল চলছে আওয়ামী লীগ। এটাই নাকি ভালো। কিন্তু এটি যে কি ভয়ংকর দর্শন তা বুঝতে আওয়ামী লীগকে আরেকটি দুঃসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে বিশ্বস্ত, ত্যাগী, দল ও নেতার জন্য সব কিছু উৎসর্গ করার মতো নেতা-কর্মী শূন্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেতা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, নেতার জন্য জীবন দেবো-এই মনোভাব আওয়ামী লীগ থেকে উঠে গেছে বহু আগেই। আওয়ামী লীগে এখন ‘নব্য মোশতাক’ তৈরী হচ্ছে মাশরুমের মতো। নেতার সামনে স্তুতি, আড়ালে সমালোচনা-এটাই এখন আওয়ামী সংস্কৃতি। সব নেতা, পাতি নেতা জানেন, মূল নেতা তার বিকল্প রেখেছেন। তিনি দলে অপরিহার্য নন। কাল নেতার হাত সরে গেলেই সে ‘জিরো’। মূল নেতার তিনি একান্ত আপন নন। এই উপলব্ধি তাকে লোভী করে। দুর্নীতিবাজ করে। আদর্শহীন এক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদে পরিণত করে। এই উপলব্ধির কারণেই সে সংগঠন ভালোবাসেনা, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না। আওয়ামী লীগের ক’জন নেতা এখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন? কাজের চেয়ে মূল নেতার নেক নজরে থাকাটাই তাদের জন্য লাভজনক। এজন্য আওয়ামী লীগে চলছে আখের গোছানোর উৎসব। যে যেভাবে পারছে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতরা হয় বৈষয়িক হয়ে উঠেছেন। টাকা-কড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য মনোযোগী হচ্ছেন, অথবা দূরে, নিভৃতে চলে যাচ্ছেন অবহেলায়, হতাশায়। দল করো, পদ দখল করো, নির্বাচন করো, টাকা বানাও-আওয়ামী লীগের এই অধ্যায় সমাপ্ত প্রায়। এরপর শুরু হয়েছে, ছেলে, বউ, শালা, মামা, ভাগিনাদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা। যার এক ঝলক দেখা যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা বড় অংশ এখন সাধারণ মানুষকে ‘মানুষ’ মনে করে না। তাদের পাত্তাও দেয় না। নেতারা চার পাশে রাখেন স্তাবকদের। কিছু একটা বলেই চাটুকারদের দিকে তাকান। তারা অনুগত ভৃত্যের মতো মাথা নাড়েন এবং হাসেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আজ বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের মতো। এরা জনসম্পৃক্তহীন, উদ্বাস্তু। জনবিচ্ছিন্নতার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টি। এই সুযোগে রাজনীতির মরা লাশ কুড়ে কুড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় মৌলবাদী শকুন। তরুণদের মধ্যে রাজনীতির আগ্রহ নেই। আরো সোজা সাপটা বললে, তরুণরা রাজনীতিকে রীতিমতো ঘৃণা করে। একারণেই ‘রাজনীতি মুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবী এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাদের মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র নেতাদের ভয় পান বটে, কিন্তু সম্মান করেন না। রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এভাবেই সর্বত্র রাজনীতিকে কলংকিত করার উৎসব চলছে। রাজনীতি মানেই খারাপ-এটা প্রমাণের এক ভয়ংকর খেলা শুরু হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো। আবার অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতার চাবি তুলে দেয়া। তেমন পরিস্থিতির দিকেই কি ছুটছে বাংলাদেশ?     

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

পদ হারানোর ঝুঁকিতে আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য

প্রকাশ: ০২:০০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন। 

আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদকের টেলিআলাপের পরপরই ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির ৩ নম্বর কার্যালয়ে যান এবং সেখানে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে তিনি যারা যারা নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন। 

একই সাথে তিনি এটাও জানান যে, যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরকম একটি বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। 

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে শুধু বিষয়টি অবহিত করেননি, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তত তিনজন আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং কথা বলে তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই  হারুন অর রশীদ হীরা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা থেকে এবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তার এই প্রার্থীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির সাথেও টেলিফোনে কথা হয়েছে বলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ইনসাইডারকে নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। তার সাথেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেন এবং তাকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য পরামর্শ দেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও আলাপ করেছেন বলে জানা গেছে। তার ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচরে প্রার্থী হয়েছেন। 

এই সমস্ত স্বজনরা যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করে সে ক্ষেত্রে কী করা হবে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং এদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা প্রেসিডিয়াম এবং এই প্রেসিডিয়ামের দুজন সদস্য যখন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করেছেন তখন অন্যরা সেটা মানবে কীভাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান গ্রহণ করতে চায় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনা বলেছেন, যারাই এ সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদেরকে দল থেকে পদ হারানো বা বহিষ্কারের নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন দল থেকে বহিষ্কৃত হন তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত যদি এই উপজেলা নির্বাচনে স্বজনদের অবস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে এই দুই নেতা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।

আওয়ামী লীগ   উপজেলা নির্বাচন   ড. আব্দুর রাজ্জাক   শাহজাহান খান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু: শেখ হাসিনাই হতে পারেন শান্তির দূত

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা। 

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির দর্শন জাতিসংঘ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিশ্বশান্তি দর্শনের আলোকেই ইসরায়েল ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। 

বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে কঠোর এবং যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর অবিচার, হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সবসময় নিন্দা জানাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ঈদের শুভেচ্ছা ভাষণেও মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক বিপর্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'মাদার অব হিউম্যানিটি' হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন। আর এ কারণেই বিশ্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। উদার মুসলিম দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি আলাদা একটি অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশ একদিকে যেমন ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করে, অন্যদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং ধর্মের নামে উগ্র সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। আর এটি বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে বিশ্বের এমন একজন নেতা যিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সংকট সমাধানের আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারেন। তার শান্তির মডেলকে সামনে রেখে যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার টেবিলে বসে তাহলে ইসরায়েল ইস্যুতে শান্তি অসম্ভব নয়।

বিশ্বে যারা নেতৃবৃন্দ আছেন তারা প্রায় অনেকেই বিতর্কিত এবং পক্ষপাতে দুষ্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব নেতার অবস্থানে থাকতে পারছেন না। চীন এই বিষয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পক্ষ করতে চায় না। তাছাড়া বিভাজিত বিশ্বে চীনের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মেনে নেবে না এটা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি রাশিয়া এখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়া পুতিনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এরদোয়ান ব্যাপারে ইসরায়েল সহ অন্যান্য দেশগুলোর একটি অবস্থান রয়েছে। তাছাড়া তুরস্ক এই বিতর্কে কতটুকু সহনীয় অবস্থায় থাকতে পারবে তা নিয়ে ব্যস্ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এই অবস্থায় বিশ্বকে যুদ্ধাবস্থা থেকে সামাল দিতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনাই। তার শান্তির বার্তা যদি বিবাদমান পক্ষগুলো অনুধাবন করে তাহলে এই জটিল কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি অসম্ভব নয়। আর এই শান্তির জন্য শেখ হাসিনাই হতে পারেন বিশ্ব নেতা। তার শান্তির দর্শন এবং তার শান্তির উদ্যোগের মাধ্যমে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হতে পারে বিশ্ব।

ইরান-ইসরায়েল   শেখ হাসিনা   শান্তির দূত   জো বাইডেন   ইরান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন যারা

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগে নীরবে নিভৃতে পালাবদল ঘটছে। এক সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মানে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ সেলিম, মতিয়া চৌধুরী। এখন তাদের অধ্যায় আস্তে আস্তে যবনিকা ঘটেছে। শারীরিক ভাবে তারা অনেকেই অসুস্থ। অনেকে এখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। বরং একটি নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সামনে নিয়ে আসছেন। তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে জায়গা করে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের এই পালাবদলটি শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনীতির একটি অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। 

পুরনোদেরকে অসম্মান না করে নতুনদের জন্য জায়গা করে দেওয়ার যে কৌশল সেটি রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয়। কিছু দিন আগেও যারা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের বদলে এখন আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু নেতা। যারা আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর যাদেরকে বেশি পাদপ্রদীপে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন;

১. ড. হাছান মাহমুদ: ড. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি ঘটেছে। এর আগে তিনি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। এবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। স্পষ্টতই আওয়ামী লীগ সভাপতি তাকে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসছেন। তিনি আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও বটে। কোন কারণে সাধারণ সম্পাদকের পদ খালি হলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও ড. হাছান মাহমুদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই অনেকে মনে করছেন। আর এই সমস্ত বিবেচনা থেকেই আওয়ামী লীগে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে সামনে আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। 

২. জাহাঙ্গীর কবির নানক: জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন নিজ যোগ্যতায়। মাঠের নেতা হিসেবে তার দীর্ঘদিনের সুনাম ছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। রাজনীতিতে চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়েই তিনি এগিয়ে গেছেন তার আদর্শের কারণে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার পর তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে গেছেন। তার পুরস্কার তিনি পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে উন্নীত হন। এবার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা এখন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছেন। 
৩. আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কর্মী বান্ধব হওয়ার কারণে তার অবস্থান আস্তে আস্তে দৃঢ় হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের অন্যতম বাহাউদ্দিন নাছিম কর্মীদের কাছে আওয়ামী লীগ সংগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত এবং সংগঠনের প্রশ্নে অকুতোভয় এবং একনিষ্ঠ এই নেতা মন্ত্রী না হয়েও আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতি নির্ধারক হয়ে উঠছেন নিজ যোগ্যতায়। 

৪. আব্দুর রহমান: আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীর কবির নানক এর মতোই তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। কিন্তু তারপরও তিনি ভেঙে পড়েননি। সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। এবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থার প্রতিদান তিনি ভালো ভাবেই দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের একটি পালা বদল ঘটছে। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু কিংবা শেখ ফজলুল করিমের জায়গা আস্তে আস্তে এই সমস্ত নেতারা জায়গা করে নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের একটা পাইপলাইন তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। যেখানে পর্যায়ক্রমে নেতারা অপেক্ষমান অবস্থায় আছেন। নেতৃত্বের শূন্যতা আওয়ামী লীগে যেন না হয় সেজন্য একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আব্দুর রহমান   জাহাঙ্গীর কবির নানক   ড. হাছান মাহমুদ   আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অন্ধকার ছয়দিন

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের লোডশেডিং চলছে। গত বুধবার থেকে সংবাদপত্র বের হচ্ছে না। টানা ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধের বিশ্ব রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। না কোন প্রতিবাদে নয়, দাবী আদায়ের জন্য নয়। ছুটির ফাঁদে সংবাদপত্র বন্ধ আছে। সংবাদপত্রকে বলা হয় জরুরী সেবা। চিকিৎসক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা যেমন জরুরী সেবা দেন, তেমনি সংবাদকর্মীদের কাজও হলো দেশের মানুষকে সার্বক্ষণিকভাবে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয়া। বিশেষ করে ছুটির সময় এটার প্রয়োজন আরো বেশী। এবার দেশে একটা দীর্ঘ ছুটি। এসময় সংবাদপত্র অনেক জরুরী। আচ্ছা ভাবুন তো, ছয়দিন যদি হাসপাতালে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো, কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বলতো ছয়দিন তারা দায়িত্ব পালন করবে না। তাহলে কি হতো? আমিতো মনে করি, সংবাদপত্র বন্ধ রাখার বিষয়টিও তেমনি আঁতকে ওঠার মতো। কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকদের এনিয়ে বিকার নেই।  

এবার বাংলাদেশ দু’টি বড় উৎসব কাছাকাছি সময় উদ্যাপন করছে। ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে না করতেই, আগামীকাল (রোববার) ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব। এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। তবে বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর কেবল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব নয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে আনন্দ করে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই রীতি চলে এসেছে দীর্ঘদিন। ইদানিংকার মতো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন ধর্মীয় উৎসবকেই দেখা হতো না। ঈদের দিন অন্য ধর্মের বন্ধুরাও বাসায় আসতো সেমাই মিষ্টি এক সাথে খাওয়া হতো। আবার হিন্দুদের পূজাতেও আমরা যেতাম। অনেক মজা হতো। যতো দিন যাচ্ছে আমাদের ধর্মীয় উদার নৈতিক চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছে ধর্মান্ধ সংকীর্ণতা। এখন ঈদ উৎসব যেন অনেকটাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলিত। রমজান মাস জুড়ে এক ধরনের কঠোর বিধি নিষেধ থাকে যা স্বতঃস্ফূর্ত না। আরোপিত এবং লোক দেখানো। এই আরোপিত বিধি নিষেধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কিছু ‘বক ধার্মিক’। এদের কারণে গত তিন ঈদে পহেলা বৈশাখ নির্বাসিত ছিলো। পবিত্র রমজানের সাথে পহেলা বৈশাখের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু তারপরও অতি উৎসাহী কট্টরবাদীদের দাপটে শৃঙ্খলিত হয় পহেলা বৈশাখ। অথচ বাঙালী হিসেবে পহেলা বৈশাখীই আমাদের প্রথম এবং প্রধান সর্বজনীন উৎসব। বাংলা বর্ষ বরণ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বেশ কয়েক বছর পর এবার পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হবে বাঁধাহীন ভাবে। বাঙালী জাতি বর্ষবরণ করবে মুক্ত ভাবে। এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের উপলক্ষ্য তো বটেই। কিন্তু এত বড় উৎসব হবে সংবাদপত্রহীন! কি অদ্ভুত! সংবাদপত্র কি দায়িত্বহীন মালিকানার শিকার?

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট। কিছু মানুষ যতোই কট্টর মৌলবাদী হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখনও উগ্র পন্থাকে সমর্থন করে না। এজন্য একই সময়ে একাধিক ধর্মাবলম্বীদের উৎসব এদেশে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়। এবার রমজানের কথায় ধরা যাক না কেন। এবার রমজানের মধ্যেই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ‘ইস্টার সানডে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোজার মধ্যেই দোল উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায় রং উৎসবে মেতেছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বলেননি যে, রোজার জন্য ইস্টার সানডে করা যাবে না কিংবা দোল উৎসব বন্ধ রাখতে হবে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় কিছু উপরের তলার মানুষ। যারা ধর্ম প্রতিপালনের চেয়ে লোক দেখানোতে বেশী আগ্রহী। এদের হাতে ধর্ম এবং সংস্কৃতি কোনটাই নয়। এবার ঈদের পরপরই পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হচ্ছে-এজন্য আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এটি এক অনন্য সুযোগ। এর মাধ্যমে প্রমাণ হতে পারে আমরা বাঙালী, আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা উদার। এদেশের মানুষ যেমন ঈদ উৎসব করলো তেমনি বাংলা নববর্ষকেও বরণ করবে। এই বর্ষ বরণের উৎসব যেন ঢেকে দিচ্ছে সংবাদপত্রে ছুটি। এবার ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিকরা। ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে মোট ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার এক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংবাদপত্র মালিকরা। পহেলা বৈশাখে কেন সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে? কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ‘ঈদ সংখ্যা’ সাময়িকী প্রকাশ করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই সব সাময়িকী গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি আশা করেছিলাম এবার যেহেতু কাছাকাছি সময়ে ঈদ এবং বর্ষবরণ তাই সংবাদপত্রগুলো পহেলা বৈশাখে একটা ছোট সাময়িকী করবে। আলাদা আলাদা সাময়িকী না করুক ঈদ সংখ্যা এবং নববর্ষ সংখ্যা মিলিতভাবে করবে। কিন্তু কোথায় কি, এবার পহেলা বৈশাখে কোন সংবাদপত্রই বেরুচ্ছে না। শুধু পহেলা বৈশাখ কেন? বাংলাদেশে এখন চলছে অন্ধকার সময়। ১০ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল দেশে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। এটি নজীর বিহীন। 

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, এ যুগে সংবাদপত্র ৬ দিন না ৬ মাস বন্ধ থাকলো কার কি? এখন সংবাদের জন্য কে আর দৈনিক পত্রিকার অপেক্ষা করে? অনলাইন, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়ার এই যুগে কেউ আর খবরের জন্য সকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষা করে না। সকাল বেলা এক কাপ চায়ের সাথে একটি সংবাদপত্র এখন উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ নয়। এসব ঘটনা প্রিন্ট মিডিয়ার অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত। কিন্তু তারপরও প্রিন্ট মিডিয়া এখনও বিশ্বস্ততা এবং আস্থার প্রতীক। একজন পাঠক টেলিভিশনে বা অনলাইনে যতো সংবাদই দেখুক বা পড়ুক না কেন, দিনের শেষে তার নির্ভরতা ছাপা কাগজ। অনলাইনে কোন সংবাদ পাঠ করার পর তার সত্যতা যাচাই করে ছাপা কাগজে। তাই এখনও সংবাদ, সঠিক তথ্যের জন্য প্রধান নির্ভরতার জায়গা হলো সংবাদপত্র। তথ্যের এই বিশ্বস্ত উৎস বন্ধ আছে। টানা ছয়দিনের জন্য দেশের মানুষ সংবাদপত্র পাবে না। এই ছয়দিনকে বলা যায় অন্ধকার সময়। সংবাদপত্র বিহীন একটা দিন মানে অন্ধকার দিন-রাত্রি। গত ১০ এপ্রিল থেকে অন্ধকার ছয়দিন শুরু হয়েছে। আমরা যারা সেকেলে মানুষ। ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা খুঁজি তাদের জন্য এই ছয়দিন দূর্বিসহ, অবর্ননীয়। 

প্রশ্ন হলো সংবাদপত্রের মালিকরা কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলো? এই সিদ্ধান্ত দেশের সংবাদপত্র শিল্পকে আরো সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের মালিকানা শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের দখলে। প্রধান সব সংবাদপত্রই কোন না কোন শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। বড় শিল্পপতিদের কাছে সংবাদপত্র হলো মর্যাদার প্রতীক। মুক্ত সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পাঠকের কাছে দায় বদ্ধতা ইত্যাদি ব্যবসায়ীদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। সংবাদপত্র এখনকার মালিকদের কাছে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘অস্ত্র’। এই ক্ষমতা দেখিয়ে তারা তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে। সুদৃঢ় করে। সরকার সংবাদপত্র মালিকদের ভয় পায়। ব্যাংক তো তটস্থ থাকে। তাই পত্রিকা থাকা মানে ব্যবসায়ীদের সব মুশকিল আসান। কর্পোরেট হাউসে এখন সাংবাদিকতা নেই, এক ঝাঁক ক্রীতদাস আছে। যাদের একমাত্র কাজ মালিকদের মনোরঞ্জন করা। এদের মধ্যে যিনি সম্পাদক তিনি হলেন সবচেয়ে বড় ক্লাউন। মালিকদের খুশী করাই তার একমাত্র কাজ। পেশাগত উৎকর্ষতা চুলোয় যাক। যিনি মালিকের স্বার্থ যতো নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত করেন তিনি ততো বড় সম্পাদক। এই অস্ত্র প্রয়োগ করে মালিকরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায়। যারা তাদের কথা শোনে না তাদের এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যবসায়ীদের কাছে একধরনের বর্মের মতো। নিজেদের অপকর্ম, স্বেচ্ছাচারিতা জায়েজ করার জন্য সংবাদপত্রকে তারা ব্যবহার করে। সংবাদপত্রের মালিক হবার কারণে কেউ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। এভাবেই চলছে সংবাদপত্র শিল্প। সংবাদপত্র এখন কর্পোরেট ক্রীতদাস। তাই মালিকরা সংবাদপত্র দুই দিন বন্ধ থাকলো না ছয়দিন বন্ধ থাকলো তা নিয়ে ভাবেন না। তারা তাদের ব্যবসা সুরক্ষা পত্রিকা দিয়ে কতটা হলো তা নিয়েই ব্যস্ত। সংবাদপত্র মালিকরা পাঠকের কাছে জবাবদিহিতার বিশ্বাসী নন। তারা দেখেন এই সংবাদপত্র তাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পারছে। ছাপা কাগজ একদিন বের না হলে অনেক সংবাদপত্রের অনেক টাকা সাশ্রয়। এসব বিবেচনা করেই মালিকরা মনে করেছেন পত্রিকা যদি কয়েকটা দিন বন্ধই থাকে, কি এমন ক্ষতি। কিন্তু এই ছয়দিন সংবাদপত্র বন্ধ যে এক ভয়ংকর বার্তা দিলো তাকি মালিকরা অনুধাবন করেন? সংবাদপত্র ছাড়াও যে দেশ চলে, এমন এক ঘোষণাই কি দিলেন না মালিকরা। ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন