এডিটর’স মাইন্ড

মারিয়া কৃষ্ণা সাবিনা এবং একজন শেখ হাসিনা

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২


Thumbnail মারিয়া কৃষ্ণা সাবিনা এবং একজন শেখ হাসিনা

কৃষ্ণা রানী সরকার যখন কোনাকুনি শটে নেপালের জালে তৃতীয় গোলটি দিল তখন আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, অনুমান করি আমার মতো অনেকেই ১৯ সেপ্টেম্বর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশে এখন নানা শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, হতাশা। ব্যর্থতার চোরাবালিতে আটকে গেছে আমাদের প্রিয় ক্রিকেট। এর মধ্যে আমাদের মেয়েদের এ অসাধারণ সাফল্য যেন তীব্র দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টি। এ সাফল্য কেবল সাফজয় নয়। আমি এটাকে কেবল একটি টুর্নামেন্ট বিজয় হিসেবে দেখি না। এ জয় মৌলবাদ, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। এ জয় প্রান্তিক মানুষের। এ জয় অদম্য লড়াকু বাঙালি নারীর। ওরা ১১ জন যেন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। যখন নারী কী পোশাক পরবে তা নিয়ে নিদ্রাহীন কিছু মানুষ। পোশাকের জন্য নারী হেনস্তা হচ্ছে। যে সময় বিষণ্নতায় কিশোরী-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ যুগেও নারীর পথচলা নতুন করে দুর্গম হচ্ছে, তখন সাবিনা, রুপনা চাকমা, মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণা রানী সরকার যেন একেকটা আলোকবর্তিকা। তারা যেন মশাল জ্বালিয়ে পথ দেখালেন বাংলাদেশের সব নারীকে। ফাইনালের আগের দিন সানজিদা আক্তার তার ফেসবুকে লিখেছিলেন- ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজন যোদ্ধাদল মাঠে থাকব। যে দলের অনেকে এগিয়ে এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধে লড়ে অভ্যস্ত।’ এ নারী দলের কারা কীভাবে সংগ্রাম করে এসেছেন তা আমাদের গণমাধ্যমের কল্যাণে এখন সবার জানা। এ নারীরা কী অসাধ্য সাধন করেছেন, কী প্রবল প্রতিপক্ষকে উপেক্ষা করে তারা খেলায় টিকেছেন তা এখন আমরা সবাই মোটামুটি জানি। কলসিন্দুর গ্রামের গল্প, সাতক্ষীরায় সাবিনার যুদ্ধ। রক্ষণশীলদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রংপুরের পালিচড়ার রামজীবন গ্রামের মৌসুমীর সংগ্রামের কাহিনি এখন আমরা জানি। কলসিন্দুরের মফিজ স্যার, রংপুরের কোচ মিলন, রাঙামাটির শান্তিমণি চাকমা ও বীর সেনদের মতো উজাড় করা প্রশিক্ষকদের অবদানের কথাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চা হচ্ছে। ‘মেয়েদের কোচ’ এ পরিচয়ে লজ্জা না পেয়ে গোলাম রব্বানী ছোটন যেন পিতার মতো তাদের বড় করেছেন।

১৯ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের সব গণমাধ্যমেই এ নিয়ে নানা লেখা-ফিচার পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি। আবেগাপ্লুত হচ্ছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বেশির ভাগ গণমাধ্যমই নারী ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যের মানুষটিকে উহ্য রেখেছে। তাঁর নাম আলোচনায়ই নেই। অথচ তিনি না থাকলে আমাদের নারীরা আদৌ ফুটবল খেলতে পারতেন কি না আমার সন্দেহ। তিনি হলেন শেখ হাসিনা। নারী ফুটবল বিকাশে সবচেয়ে যাঁর অবদান তাঁর নাম নিতে কেন আমাদের এত আড়ষ্টতা?

কলসিন্দুরের মেয়ে মারিয়া মান্ডার কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা আনন্দ করার জন্য ফুটবল খেলতাম। প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। তখন জানতাম না ফুটবল খেললে টাকা পাওয়া যায়। বিদেশে যাওয়া যায়। এখন বুঝি ফুটবলের মূল্য। অনেকের টাকা আছে কিন্তু বিদেশে সবার যাওয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কজনের হয়। আমরা তাঁর সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছি। আমাদের টাকা দিয়েছেন। আদর করেছেন।’ মারিয়া মান্ডার বক্তব্য থেকেই জানা যায় বাংলাদেশে নারী ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যচারিণী কে। তাঁর নাম শেখ হাসিনা। তাঁর উৎসাহে-পৃষ্ঠপোষকতায় নারীরা আজ দেশের জন্য এ সম্মান বয়ে এনেছেন। আমাদের অদম্য মেয়েদের পথ তৈরি করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমাদের রাজনীতিবিদদের অদ্ভুত এক ব্যাধি আছে। কোনো অর্জন হলে তাতে তাঁর দলের হিস্সা খোঁজা। সব কৃতিত্ব একা নিয়ে নিতে চায়। একটা সুখস্মৃতিকে আমার-আমার বলে কাদায় লেপ্টে দেয়। এই যেমন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের নারী দল সাফজয় করে দেশে ফিরল। তাদের ‘খোলা বাসে’ রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হলো। এ সময় মির্জা ফখরুল হঠাৎ এক নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন। তিনি বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সাফ গেমস নারী ফুটবল খেলা চালু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।’ ফখরুল বললেন, ‘আমি পত্রিকায় দেখলাম ডানা (কামরুন নাহার ডানা), যিনি মহিলা ফেডারেশনের একসময় প্রধান ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম টুর্নামেন্টটা বেগম জিয়ার সরকারের সময় অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে শুরু হয়।’ পাঠক লক্ষ্য করুন, সাফ নারী ফুটবল যদি জিয়া শুরু করেন (যিনি ১৯৮১-তে ইন্তেকাল করেছেন) তাহলে ১৯৯১ সালে কিংবা ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া কীভাবে প্রথম টুর্নামেন্ট চালু করলেন? রাজনীতিবিদরা এ রকম গোঁজামিলে বক্তব্য দেন। এজন্য সাধারণ মানুষ তাঁদের কথাকে স্রেফ বিনোদন মনে করেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি তাহলে ক্রমে কৌতুকাভিনেতায় পরিণত হচ্ছেন? বিএনপি মহাসচিব ইদানীং নানা তথ্য আবিষ্কারের জন্য আলোচিত। তাঁর কথায় বেগম জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বেগম জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিংবা খালেদা জিয়ার মানবাধিকার পদক- সবই রাজনীতিতে ব্যাপক কৌতুক জন্ম দেয়। তবে সাফ নারী ফুটবলের জনক জিয়া, এ তথ্য বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব কৌতুক ভাণ্ডারে খুব শিগগিরই স্থান পাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ নারীদের বিশ্বকাপ প্রথম শুরু হয় জিয়ার মৃত্যুর ১০ বছর পর ১৯৯১ সালে। চীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নারী বিশ্বকাপে অংশ নেয় মাত্র ১২টি দেশ। এশিয়ার মাত্র তিনটি দেশের নারীরা ওই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল। দেশগুলো হলো- চীন, জাপান ও চাইনিজ তাইপে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬ সালের আগে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা তাদের সভায় নারীদের কথা বলারও সুযোগ দিত না। এই যখন বিশ্বে নারী ফুটবলের ইতিহাস, তখন মির্জা ফখরুলের ‘জিয়া সাফ নারী ফুটবলের প্রবর্তক’- এ বক্তব্যে দমফাটা হাসি না ডুকরে কান্না করা উচিত, তা নিয়ে আপনার বিভ্রম হতেই পারে। মূলত ১৯৯১ সালে নারী বিশ্বকাপের পরই ফিফা নারী ফুটবলের বিশ্বায়নের অভিযাত্রা শুরু করে। একপর্যায়ে ফিফা তার সদস্যদের জন্য নারী ফুটবল চালু বাধ্যতামূলক করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন নড়েচড়ে বসে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কামরুন নাহার ডানাকে উদ্ধৃত করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ও এক ধরনের তথ্য বিকৃতি। ২০০৩ সালে বাফুফে একাদশ নামে একটি নারী দল গঠন করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি দল আনা হয় প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য। কিন্তু বিএনপির প্রধান শরিক জামায়াত এবং আরও মৌলবাদী সংগঠন এ খেলার বিরুদ্ধে হুমকি দেয়। এমনকি তারা স্টেডিয়াম ঘেরাও পর্যন্ত করে। ফলে তিন ম্যাচের মধ্যে একটি মাঠে গড়ায়। ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের কাছে আত্মসর্মপণ করে বেগম জিয়ার সরকার। বাকি দুটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। এ যেন শুরু না হতেই শেষ হওয়ার গল্প। নারী ফুটবল নিয়ে কীভাবে এগোবে সরকার? যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদীদের শীর্ষ দুই নেতাই তো তখন মন্ত্রী। এরপর নারী ফুটবল বাক্সবন্দি হয়ে যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত রুপনা চাকমা, শিউলি, শামসুন্নাহার যে কত কষ্ট বুকে নিয়ে ফুটবল ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন কে জানে?

ফখরুল যদি বেসামাল কথা বলেন, তখন ক্ষমতাসীন দলের কেউ বেসামাল আচরণ করবে না, তা কী করে হয়। বিমানবন্দরে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নারী ফুটবল দলকে বরণ করে নিল। এরপর ‘ছাদখোলা বাসে’ শোভাযাত্রা। কিন্তু বাফুফেতে যাওয়ার পর ঘটল বীভৎস কাণ্ড। যারা বিজয় আনল তাদের ঠেলে দিয়ে আসন দখল করে নিলেন প্রতিমন্ত্রী, সচিব আর বাফুফে সভাপতি। মনে হলো এরাই নেপালে দশরথ রঙ্গশালায় খেলে এলেন। সাবিনা চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে এক কোনায়, ছোটন তো যেন বাইরের দর্শক। ক্ষমতায় থাকলে যে কিছু মানুষের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় বাফুফেতে সংবাদ সম্মেলন তা আরেকবার প্রমাণ করল। এ কর্তাব্যক্তিরা শুধু কাণ্ডজ্ঞানহীন নন, ন্যূনতম বোধশক্তিহীন। এ অবুঝ নাদানদের কে বোঝাবে এ অর্জন তাঁদের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়, বাংলাদেশের। এটা শেখ হাসিনার চরম শত্রুরাও স্বীকার করবেন, তিনি ক্রীড়া-অন্তঃপ্রাণ। যেখানেই বাংলাদেশ যে খেলাই খেলেছে, সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর সুভাশিস পৌঁছে গেছে। এমনকি এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েও তিনি সাবিনা, রুপনাদের খোঁজ নিয়েছেন বরাবর। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও উন্নতির উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ নারী ফুটবল যুগের সূচনা হয় আসলে ২০০৯ সালেই। তখনো মৌলবাদীদের আস্ফালন ছিল, হুমকি ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব হুমকি-ধমকি প্রশ্রয় দেননি। উল্টো ২০১০ সালে কক্সবাজারে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক হয় বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ নারী দল ভুটানকে ২-০ গোলে, শ্রীলঙ্কাকে ৯-০ গোলে পরাজিত করে। সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হেরে যায়। এরপর ২০১১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে চালু হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা গোল্ডকাপ। স্কুল পর্যায়ে দেশব্যাপী এ টুর্নামেন্টই আসলে নারী ফুটবলের জাগরণের সূচনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসেন আজকের বিজয়ী সাবিনারা। ভালো খেলে একের পর চমক দেখান বাংলার অদম্য মেয়েরা। আর এ জাগরণে নেপথ্য থেকে অফুরান সহযোগিতা করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এএফসি-১৫, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫সহ যখন যেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা জিতেছেন তখনই তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। নারী দলের প্রত্যেক সদস্যকে বিভিন্ন সময় ১ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অনেক পণ্ডিত দেখি বলেন, আর্থিক অনুদান ভালো নয়। এতে ক্রীড়াবিদদের পদস্খলন হয়। ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়ে কেউ কেউ দেখলাম বলার চেষ্টা করছেন ‘এ মেয়েগুলো টাকা পেলে খেলায় মনোযোগ দেবে না।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঠিকই জানেন দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করে এরা ফুটবল খেলছেন। অর্থনৈতিক শক্তি না থাকলে এরা এগোতে পারবে না। নারী স্বাধীনতার জন্য চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পুরস্কারের অর্থের সুবাদে এরা শক্তি পেয়েছেন, সাহস পেয়েছেন। পরিবার এদের জেদ মেনে নিয়েছে। শুধু আর্থিক অনুদান নয়, রুপনা চাকমার মতো অনেক নারী ফুটবলারকে শেখ হাসিনা জমি দিয়েছেন। দিয়েছেন ঘর উপহার। এর ফলে হতদরিদ্র বাবা-মারা সমাজকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পেয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছার মূল্য দিয়েছেন। কিন্তু শুধু উপহার এবং অনুদান দিয়ে তো প্রতিদিনের জীবন চলে না। এজন্য দরকার আর্থিক নিশ্চয়তা। খেলাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে সাবিনা, স্বপ্না, মনিকাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসবে। নতুন রুপনা, শিউলি, মাসুরারা আসবে না। এ ক্ষেত্রে এক অসাধারণ উদ্যোগ নেয় দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং উৎসাহে বসুন্ধরা নারী ফুটবল দল গঠিত হয়। এবার সাফজয়ী নারী দলের প্রথম একাদশের আটজনই বসুন্ধরা কিংসের হয়ে ঘরোয়া লিগে খেলেন। বসুন্ধরা গ্রুপ এই নারীদের অনিশ্চয়তার আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছে। আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বপ্নের সীমানা অনেক বড় করে দিয়েছে। নারী ফুটবলের এ জাগরণে এ বৃহৎ শিল্প পরিবারের অবদান বিরাট। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত নারী ফুটবলকে একটা কাঠামো দিয়েছে। একটা রূপকল্প দিয়েছে। স্কুল ফুটবল, ঘরোয়া লিগ, জাতীয় দল এ বিন্যাস নারী দলকে এগিয়ে দিচ্ছে। একজন কিশোরী এখন জানে, এটি শুধু তার শখ কিংবা নেশা নয়। তার পেশা। এ পেশায় অর্থ, সম্মান দুই-ই আছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ দেশের নারী ক্রিকেট এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর।

কিন্তু সাবিনা, কৃষ্ণা কিংবা মারিয়া মান্ডাদের এ জয়কে আমি শুধু একটা ট্রফি জয়ের আনন্দের মধ্যে বন্দি করে রাখতে চাই না। এটি কেবল একটি খেলার উৎকর্ষতা নয়। এ জয়ের বহুমাত্রিক তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশ নারী দলের খেলোয়াড়দের দেখুন। যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে। সমতলের আদিবাসী, পাহাড়ি আদিবাসী, বাঙালি। সবাই মিলে একটি দল। যেমন সবাই মিলে এই বাংলাদেশ। এ তরুণ প্রাণ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েরা কীভাবে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ উপড়ে ফেলেছেন। এ রকম একটি বাংলাদেশের স্বপ্নই তো আমরা দেখেছিলাম একাত্তরে। আমাদের স্বাধীনতার স্লোগান ছিল- ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালি’। সেই স্লোগানে এ নিপুণ চিত্ররূপ যেন মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণা আর সাবিনাদের দলটি। যখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হিংস্র নখ আবার বেরিয়ে এসেছে, যখন ধর্মীয় উৎসবের আগে আতঙ্কের প্রহর গোনে আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তখন সম্প্রীতির বাংলাদেশের এক চিলতে উঠোন যেন আমাদের নারী ফুটবল দল।

সাবিনাদের আরেকটি ব্যাপার আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরা সবাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে এসেছেন এ অদম্য মেয়েরা। খুব সাধারণ বাঙালি পরিবার। এদের কারও বাবা দিনমজুর, কেউ কৃষক, কেউ ক্ষুদ্র বিক্রেতা, কেউ শ্রমিক, কেউ রাজমিস্ত্রি। এ সাধারণের শক্তি যে কত অপরাজেয় তা বোঝা গেল আরেকবার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন মুটে, মজুর, শ্রমিক, কৃষকের সম্মিলিত বিজয়গাথা। এদের বিজয়টাও তেমনি। এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই আমাদের শক্তি। কলসিন্দুর, রংপুর, সাতক্ষীরা, রাঙামাটির প্রত্যন্ত জনপদই আমাদের বাংলাদেশ। এ প্রান্তিক মানুষই দেশটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এ মেয়েরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটেছেন। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছেন। সমাজের তথাকথিত শৃঙ্খলা এরা উপেক্ষা করেছেন। মানুষের কটূক্তি-উপহাস এরা পাত্তা দেননি। এদের লক্ষ্য ছিল অবিচল। এ মেয়েরা আমাদের সবাইকে বিশেষ করে নারীদের এক বড় শিক্ষা দিলেন। বাধা অতিক্রম করতে হবে। প্রতিকূলতা জয় করেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। কঠিন পরিশ্রম এবং অবিচলে এগিয়ে গেলে লক্ষ্য অর্জিত হবেই। এ শিক্ষাটা কৃষ্ণা, রুপনা, স্বপ্নারা নতুন করে শেখালেন। একটু হতাশায় আত্মহত্যা নয়; খানিকটা ব্যর্থতায় বিষণ্ন্নতা নয়; কঠিন তিরস্কার কিংবা অবহেলায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া নয় বরং এসব পরাজিত করার নামই জীবন। সানজিদা, শিউলি, মনিকারা অভিভাবকদের জন্যও একটা বার্তা দিয়ে গেলেন- আমার মেয়ে পড়তে চায়, তাকে পড়তে দেব। আমার মেয়ে আকাশ স্পর্শ করতে চায়, আমি সায় দেব। আমার মেয়ে গান গাইতে চায়, গান গাইতে দেব। বারবার প্রতিনিয়ত তাকে বলব না, ‘তুমি মেয়ে। তোমাকে সংসার করতে হবে। স্বামীর জন্য রান্না শিখতে হবে। স্বামীর জামা-জুতা সাফ করতে হবে। ইচ্ছা করুক না করুক স্বামীর সঙ্গে শুতে হবে। তাকে সুখ দিতে হবে। তোমার ইচ্ছাটা মুখ্য নয়। তুমি স্বামীর জন্য উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ। এটাই তোমার গন্তব্য।’ যেসব বাবা-মা তাঁদের মেয়েসন্তানদের এ শিক্ষায় গড়ে তুলতে চান, একজন ‘স্বামীর সেবক’ বানাতে চান- শিউলি, সাথী, রিতু তার এক মোক্ষম জবাব। আসুন না আমরা মারিয়া, রুপনা, মনিকাদের বাবা-মায়ের মতো উদার হই। আমাদের মেয়েদের জীবনকে দিই পূর্ণতা। এ জয় সবাইকে এ বার্তাটাও দিয়ে গেল। এ মেয়েদের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে আমি অদ্ভুত মিল পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের। এরা যেন লক্ষ্য স্থির করে বিপরীত স্রোতে সাঁতার কেটে পৌঁছেছে সোনালি বন্দরে। শেখ হাসিনার জীবনটাও তেমনি। এরা যেমন অসম্ভব শব্দটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যাও তেমন। এরা যেমন অবহেলা, বঞ্চনায় হতোদ্যম হননি। তেমনি গল্প শেখ হাসিনারও। বুধবার শুনলাম এ মেয়েরা বারবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। এদের সবাইকে বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ডেকে নিয়ে গেছেন। আদর করেছেন। হয়তো তাঁর সাহস, মনোবল সঞ্চারিত করেছেন এ কিশোরীদের মধ্যে। কী অদ্ভুত! এ সেপ্টেম্বরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। ২৮ সেপ্টেম্বর। জন্মদিনের আগে তাঁর প্রেরণায় অদম্য হয়ে ওঠা মেয়েরা যেন এক বিজয় পালক তুলে দিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। শেখ হাসিনা যেমন তাঁর সব অর্জন এ দেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেন। অপরাজিতরাও তাঁদের বিজয় উৎসর্গ করলেন দেশবাসীকে। শেখ হাসিনার দেখানো পথেই হাঁটছেন এ আলোর পথযাত্রীরা। যে পথের গন্তব্য হলো নারী মুক্তির বাংলাদেশ।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

মারিয়া   কৃষ্ণা   সাবিনা   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আবার লাইমলাইটে আমু

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২৭ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। আওয়ামী লীগের অন্য সব প্রবীণ নেতারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিলেও এখনও আমির হোসেন আমু স্ব অবস্থানে আছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি আবারও লাইমলাইটে আসছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ এখন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে একেবারে অনুপস্থিত থাকে। বয়সের ভারে তিনি ন্যুব্জ হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরীও দলীয় কর্মকাণ্ডে থাকেন বটে তবে আগের মতো নিজেকে মেলে ধরতে পারেন না শারীরিক নানা অসুস্থতার জন্য। প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে দেখা যায় বিশেষ দিবসের কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরকম পরিস্থিতিতে আমির হোসেন আমু নিজেকে এখন পর্যন্ত গতিশীল দেখেছেন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাকে সরব এবং তৎপর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বয়স তাকে পরাজিত করতে পারেনি। বরং তিনি এই বয়সেও অনেক তৎপর। কোনো কিছু না পাওয়ার বেদনাও তাকে হতাশ করতে পারেনি। কোন কিছু না পেয়েও তিনি রাজনীতির মাঠে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। 

আজ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠান হয় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের এই বর্ষীয়ান নেতা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর ঠিক আগে আগে তার বক্তব্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেন এবং এই বক্তব্যের মধ্যে তিনি কিছু ব্যতিক্রমী তথ্য উপস্থাপন করেন। 

শুধু এই বক্তব্য নয়, নির্বাচনের আগে থেকেই আমির হোসেন আমুকে রাজনীতিতে সক্রিয় এবং সরব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় জোটের রাজনীতির মেরুকরণ, আসন বণ্টন ইত্যাদিতে আমির হোসেন আমু অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। এই সময় শাহজাহান ওমরের আওয়ামী লীগে যোগদানের বিষয়ে তার ভূমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমির হোসেন আমুর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন বলেও একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় জায়গা না পেলেও দলে তিনি এখন অনেক বেশি প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন এলাকায় কোন্দল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানারকম মেরুকরণের ক্ষেত্রে আমির হোসেন আমু আবার ভূমিকা রাখতে শুরু করেছেন। আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর ছিলেন এক-এগোরার পর্যন্ত। বিশেষ করে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তখন থেকে ২০০৭ এর আগ পর্যন্ত আমির হোসেন আমু ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাজনীতিবিদদের একজন। কিন্তু এক-এগারোর সময় হঠাৎ করে তিনি সংস্কারপন্থী হয়ে যান এবং সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে তিনি তার বিশ্বস্ততার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেন। এখান থেকেই তিনি রাজনীতির বিচ্যুত ধারায় চলে যান। এরপর আমির হোসেন আমু আর আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক থাকেননি। প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবেও তার জায়গায় হয়নি। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। যদিও ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর তিনি রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারান। তবে গত ছয়-সাত মাসে আমির হোসন আমু আবার লাইমলাইটে এসেছেন। দেখার বিষয় যে, জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন কিনা।

আমির হোসেন আমু  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘ধোঁকা’ ধাক্কায় গর্তে বিএনপি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন, বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন? হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।

আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত, এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে, তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়। মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি। বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছে।

২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২ বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে। ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।

এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায় নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন। মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন। এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায় ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায় মুখ লুকান।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।



লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   বিএনএম   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদীদের ভীড় এবং সাকিব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২২ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ? এই আওয়ামী লীগ কি জাতির পিতার আদর্শের দল? এই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কি শেখ হাসিনার মতো সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্য? নাকি আওয়ামী লীগকে এখন গ্রাস করছে সুবিধাবাদী, চাটুকাররা। আওয়ামী লীগে অতিথি পাখিদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দুঃসময়ের কান্ডারীরা? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বহুরূপী নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ছবি দেখে। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ নির্বাচনের আগে বিএনপি ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এই তথ্য পুরোনো। বিএনএম নামে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি কিংস পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের কথা ছিলো তার। এজন্য বিভিন্ন দলের লোকজনকে জড়ো করার কাজেও হাত দিয়েছিলেন বিএনপির এই নেতা। তারই অংশ হিসেবে সাকিব আল হাসানকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মেজর (অবঃ) হাফিজ। নতুন এই দলে যোগও দিয়েছিলেন সাকিব। তাদের যুগল বন্দী ছবিতে কাউকে দুঃখিত মনে হয়নি। দু’জনের কেউই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফটোফ্রেমে বন্দী হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসাব নিকাশ মেলেনি। দেনা পাওনার হিসেব না মেলায় মেজর (অবঃ) হাফিজ বিএনএমের নেতৃত্ব নেননি। সাকিবও ক্ষমতাহীন এই দলে গিয়ে নিজের সদ্য শুরু রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিসর্জন দিতে চাননি। সাকিব যখন বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসছে, তখন তিনি আওয়ামী লীগের দরজায় টোকা দিয়েছেন। নিজের ‘ব্রান্ড’ ভেল্যুকে কাজে লাগিয়ে এমপিও হয়েছেন। অন্য দিকে আদর্শহীন পতিত রাজনীতিবিদ হতে হতে ফিরে আসা মেজর (অবঃ) হাফিজ নিজেকে ‘বীরপুরুষ’ হিসেবে জাহির করার সুযোগ পেয়েছেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে, নিজের সুবিধাবাদী পাপস্খলন করেছেন। এরপর রীতিমতো ইউটার্ন নিয়ে তারেক বন্দনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের শূণ্য স্থান পূরণের জন্য বিএনপিতে একজন নির্লজ্জ তেলবাজ চাটুকার দরকার ছিলো। প্রয়োজন ছিলো একজন ভাঁড় জ্যোতিষীর। মেজর (অবঃ) হাফিজ এখন বিএনপির সেই ভাঁড় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। যিনি জ্যোতীষ সাধনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন বিএনপি খুব শীঘ্রই ক্ষমতায় আসছেন। হতাশার সাগরে ডুবে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মেজর (অবঃ) হাফিজের কথায় ‘হতবাক’। নির্বাচনের আগে যে লোকটি, বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের কট্টর সমালোচক ছিলেন। যিনি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে না যাওয়ার বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন, তিনিই কিনা তারেকের ‘কাছের মানুষ’ হবার জন্য নিজেকে একজন রাজনৈতিক ক্লাউন হিসেবে উপস্থাপন করলেন। আমি মেজর (অবঃ) হাফিজকে নিয়ে কথা বলতে চাই না। ৭৫ এর পর বাংলাদেশে যে অপরাজনীতির ধারা সেই ধারার রাজনীতিতে মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো বহু পরগাছা আবর্জনা তৈরী হয়েছে। রাজনীতি মানে যাদের কাছে স্রেফ ক্ষমতার হালুয়া রুটির হিস্যা পাওয়া। বিএনএমে তিনি যোগ দিন বা না দিন, তার লোভাতুর, ক্ষুধার্ত চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো নিজের স্বার্থে রং বদল করা রাজনীতিবীদের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন, একদা দেশে সেরা ক্রিকেট অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। কি চমৎকার! রতনে রতন চেনে। 

সাকিব অবশ্য বৈষয়িক হিসেব নিকেশে মেজর (অবঃ) হাফিজের চেয়ে পাকা খেলোয়াড়। ক্রিকেট কেবল খেলা নয়, এটি বড় লোক, ক্ষমতাবান হবার একটা ম্যাজিক সিড়ি-এই ভাবনার আবিষ্কারক সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটকে সামনে রেখে তিনি বহুমাত্রিক বাণিজ্যে নিজের বিপুল প্রতিভাকে জাতির সামনে দেখিয়েছেন। কুমিরের ব্যবসা থেকে সোনা। হোটেল ব্যবসা থেকে কসমেটিকস সব জায়গায় তার বিচরণ। যে ক্রিকেট তাকে সবকিছু দিয়েছে, সেই ক্রিকেটকেই তিনি উপেক্ষা করেছেন নিজের আখের গোছোতে। এরকম সুবিধাবাদীরা ভয়ংকর। যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্যই বিপদজ্জনক। এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী তরুণকে আওয়ামী লীগ আলিঙ্গন করেছে। মনোনয়ন দিয়েছে এবং এমপিও বানিয়েছে। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিয়ে কোন সংশয় ছিলো না। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ ছিলো ভোটার উপস্থিতি, উৎসব মুখর, বিতর্কহীন নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাকিবের মতো এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করা ব্যক্তি কতটা প্রয়োজন, সে এক প্রশ্ন বটে। অনেকে বলবেন, গ্লামার বাড়াতে সাকিব, ফেরদৌস এর মতো তারকাদের নির্বাচনের মাঠে দরকার ছিলো। এতে সাধারণ মানুষের নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তথ্য উপাত্ত এই বক্তব্য সমর্থন করেনা। 

চিত্রনায়ক ফেরদৌসের ধানমন্ডি আসনের চেয়ে অনেক বেশী ভোট পেয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক তার মোহাম্মদপুর আসনে কিংবা বাহাউদ্দিন নাছিম মতিঝিলে। মাগুড়াতেও সাকিব কোন ভোট বিপ্লব করতে পারেন নি। বরং নির্বাচনের পর সাকিবকে ঘিরে নিত্য নতুন বিতর্ক তৈরী হচ্ছে। তার বোন একটি বেটিং অ্যাপের মালিকানায় আছে, এমন সংবাদ নিয়ে কদিন হৈ চৈ হলো। এর রেশে কাটতে না কাটতেই তখন সাকিব-হাফিজের বিএনএম কেলেংকারী। কেউ কেউ বলেছেন, সাকিব নাকি তারেকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই রটনাকারীদের অপপ্রচার। তবে, সাকিব যখন থেকে জন পরিচিতি পেয়েছেন, তখন থেকে তার মধ্যে এক লোভাতুর অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। বিত্ত, বৈভব ক্ষমতা, নাম যশের জন্য সাকিব সবকিছু করতে পারেন-এরকম একটা ভাবমূর্তি সাকিব তৈরী করেছেন। তাকে কখনো মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো আদর্শবান, নীতিবান একজন ব্যক্তিত্ব মনে হয়নি। আওয়ামী লীগে এখন সুবিধাবাদীদের জন্য দরজা যে খুলে দেয়া হয়েছে, সাকিবের সংসদ সদস্য হওয়া তার প্রমাণ। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ-সাকিব কান্ডের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা আরো উদ্বেগজনক এবং আতংকের। সাকিব কান্ড নিয়ে যখন মিডিয়ার তোলপাড় তখন ওবায়দুল কাদের বললেন, মনোনয়ন পাবার আগে সাকিব আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। এর আগে সাকিব কি করেছেন, সেটি নাকি তার (আওয়ামী লীগের) দেখার বিষয় না। কি সাংঘাতিক কথা! তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের আত্মীয় আত্মীয় স্বজন, জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করলেই সেই ব্যাক্তি পূত-পবিত্র হয়ে যাবেন? লুটেরা, দুর্নীতিবাজ অর্থ-পাচারকারীরা অবলীলায় আওয়ামী লীগে ঢুকে যেতে পারবেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য কি দলটি নীতি-আদর্শিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়? 

আওয়ামী লীগে অবশ্য সাকিবের মতো সুবিধাবাদীদেরই ভীড় এখন বেশী। তারাই এখন ক্ষমতার মধু খাচ্ছেন। হালুয়া-রুটির ভাগ বাটোয়ারাতেও তাদের হিস্যা বেশী। সাকিব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সেটির আগের এমপি ছিলেন একজন ত্যাগী পরীক্ষিত তরুন। যার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের দুঃসময় কষ্ট করেছে, সংগঠনকে আগলে রাখার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। ঐ তরুণের রাজনৈতিক জীবনে কোন বিচ্যুতি নেই। আদর্শ থেকে সরে আসেননি কখনো। এমনকি এবার নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়েও প্রতিবাদ করেননি বিনয়ী এই রাজনীতিবিদ। কারো কাছে প্রশ্ন করেন নি-‘কি আমার অপরাধ’? উন্মুক্ত নির্বাচন সত্বেও অনেকের মতো স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এই তরুণ বয়সে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিতে আদর্শ নিয়ে টিকে থাকাই আসল জয়। কিন্তু সাকিবের মতো সুসময়ের অতিথি পাখিদের কাছে আপাততঃ কোণঠাসা, দুঃসময়ের যোদ্ধা শিখর’রা। এটি শুধু মাগুরার এই আসনের চিত্র নয়। সারা দেশে এরকম বহু ত্যাগী সংগ্রামী, দুঃসময়ে দলের জন্য সবকিছু উজাড় করা আদর্শবান নেতা কর্মীরা আজ উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগের সুসময় তারা পরিত্যন্ত। অনাহুত। অপাংক্তেয়। তাহলে কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানরা শুধু দুঃসময়ে নির্যাতিত হবার জন্য? দলকে বাঁচাতে জীবন, যৌবন বিসর্জন দেয়ার জন্য? সুসময়ে তারা থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। বুক ভরা দুঃখ চেপে শুধু নীরবে গুমড়ে কাঁদার জন্যই কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানদের দরকার? 

ইতিহাস বলে, সুবিধাবাদী, চাটুকাররা দুঃসময়ে থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে যারা স্তুতির বন্যায় ভাসিয়ে রাখতো তারা ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর দলের পাশে দাঁড়ায় নি, প্রতিবাদ করেনি। সাকিবের চেয়েও বড় তারকা ড. কামাল হোসেন ৭৫ এর পর কি করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। ৯১ এর দুঃসময়েও ভাড়াটে সুবিধাবাদীরা সটকে পড়েছে। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীরা তারকারা ভোল পাল্টাতে সময় নেয়নি। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফ, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ব্যরিস্টার শফিক আহমেদের মতো উপেক্ষিতরাই আওয়ামী লীগ সভাপতির পাশে দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে দল রক্ষায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তেল চিটচিটে পাঞ্জাবী আর রং চটা মুজিব কোট পরা নির্ভীক তৃণমুল। যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ, কাঁদা মাটি মাখা গায়ে রক্ত ঝরিয়ে তারাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন, শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার দুঃসময়ে তারাই আওয়ামী লীগকে রক্ষায় রুখে দাঁড়াবে। তাহলে সুসময়ে কেন সুবিধাবাদীরা লুটেপুটে খাবে? আরেকটি দুঃসময় ডেকে আনার জন্য? এই স্বস্তির সুসময়ে আওয়ামী লীগ কেন মূল্যায়ন করে না দুঃসময়ের কান্ডারীদের?   

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের অনাহূতরা

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২০ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।

এরকম ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে রয়েছেন;

লিয়াকত শিকদার: লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী। দুঃসময়ে একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেখ হাসিনার প্রশ্নে তাকে কখনও আপোষ করতে দেখা যায়নি। কর্মীদের মধ্যে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু তারপরেও লিয়াকত শিকদার আওয়ামী লীগে অনাহূত।

ইসহাক আলী খান পান্না: ইসহাক আলী খান পান্না ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার সভাপতি এনামুল হক শামীম মন্ত্রী-এমপি হলেও ইসহাক আলী পান্নার কপালে কিছু জোটেনি। কি তার অপরাধ কেউ বলতে পারে না। 

মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী: মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একজন পরিচ্ছন্ন মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী এখন অপাংক্তেয়। তাকে কোথাও দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তিনি নেই। সংসদ সদস্য হিসেবেও তার তিনি জায়গা পাননি। আর মন্ত্রী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর অপরাধ কি কেউ বলতে পারে না। তার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছিল, তার যারা অনুগত কর্মী ছিল তাদেরও কেউ কেউ এখন মন্ত্রী হয়েছেন, অনেকেই এমপি হয়েছেন। কিন্তু মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী সেই জায়গাতেই রয়ে গেছেন।

বাহাদুর বেপারী: আওয়ামী লীগের আরেকজন মেধাবী ছাত্র নেতার নাম বাহাদুর বেপারী। বিভিন্ন সময় তার মেধা এবং যোগ্যতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে চর্চা হয়। ছাত্রলীগের যে কয়েকজন মেধাবী নেতা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে বাহাদুর বেপারী অন্যতম। কিন্তু বাহাদুর বেপারীও এখন আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। তিনিও এখন প্রায় অনাহূত। তাকে নিয়েও এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে খুব একটা চর্চা হয় না। বাহাদুর বেপারী ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বড় ধরনের লিড পাবেন বা তার তিনি পাদপ্রদীপে আসতে পারবেন এমনটিও মনে করেন না অনেকে।

অজয় কর খোকন: অজয় কর খোকনও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী এবং কঠিন সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অজয় কর খোকনও এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অপাংক্তেয়। তার কমিটিতে থাকা অনেকেই আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু অজয় কর খোকন যেন পরিত্যক্ত বাসের মতো আওয়ামী লীগে অপাংক্তেয় হয়ে আছেন।

দুঃসময়ের এসমস্ত ছাত্রলীগের নেতাদেরকে কেন টেনে তোলা হচ্ছে না, কেন তারা পরিত্যক্ত অবস্থায়, অনাহূত অবস্থায় আছেন এটি আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন। তবে এদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও যারা ছাত্রলীগ করে এসেছেন, এখন ভালো জায়গায় আছেন তারাও খুব একটা কথা বলতে রাজি হননা। কারণ পাছে তাদের নিজেদের সুবিধাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেউই এ সমস্ত অনাহূত, ত্যাগী, পরীক্ষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের জন্য কথা বলতে আগ্রহী নন। কেন? সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগ   ছাত্রলীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

ড. ইউনূসের মামলা এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। এই সমস্ত আলোচনার মোদ্দা কথা যেটা বেরিয়ে আসছে সেটা হল শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসকে জেলে যেতেই হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্তকরণ অর্থাৎ কনভিকশন অর্ডার স্থগিত করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছে, কোন মামলায় জামিন দেওয়া মানেই দণ্ড স্থগিত হয়ে যাওয়া। আর কনভিকশন বা দোষী সাব্যস্তকরণ কখনও স্থগিত করা যায় না। আর এই রায়ের মধ্য দিয়ে শ্রম আদালতের মামলাটি নতুন মাত্রা পেল এবং এটির একটি নতুন তাৎপর্য তৈরি হল। এই শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া হাইকোর্টেও ড. ইউনূস যে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই হাইকোর্ট যদি শেষ পর্যন্ত ড. ইউনূসকে শ্রম আদালত যে দণ্ড দিয়েছে তা বহাল রাখে তাহলে তাকে আদালতে যেতে হবে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন নিয়ে আছেন। এই জামিনের মেয়াদ রয়েছে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ড. ইউনূসকে যদি আবার নতুন করে জামিন না দেওয়া হয় তাহলে তাকে জেলে যেতে হবে। 

শ্রম আদালতের এই মামলাটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে চলতি বছরেই মাঝামাঝি সময় নাগাদ ড. ইউনূসের কারাবরণের ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। কারণ যে ছয় মাসের দণ্ড এই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল এবং তার জামিন ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল। এই দুটির যে কোনো একটি পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসের বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। সেই সিদ্ধান্তটি ড. ইউনূসের পক্ষে না গেলে তাকে কারাগারে যেতে হবে। 

তবে এটি ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার একমাত্র উপলক্ষ্য নয়। ইতোমধ্যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু এই চার্জশিট দাখিলের পরও ড. ইউনূস আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এখন এই জামিন যতদিন বহাল থাকবে ততদিন অর্থপাচার মামলায় ড. ইউনূসকে কারাগারে যেতে হবে না। কিন্তু যে কোন কারণে যদি এই জামিন বাতিল হয়ে যায় তাহলে এই অর্থ পাচার মামলাতেও ড. ইউনূসকে কারান্তরীণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অন্য যে মামলা গুলো আছে সেগুলো মূলত আয়কর ফাঁকি দেওয়ার মামলায় এবং টাকা ট্যাক্স এর টাকা পরিশোধের মামলা। যে মামলাগুলোতে ইউনূস পরাজিত হচ্ছেন সে মামলাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি আদালতে দিচ্ছেন। যদিও এখন আদালতে রায়ের পর তার আয়কর ফাঁকির অর্থ পরিশোধ করতেও তিনি উস্ম প্রকাশ করছেন। কিন্তু এই মামলাগুলোতে তার কারাগারে যাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। মূলত দুটি মামলায় ড. ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা খুব শিগগির বোঝা যাবে। একটি হল শ্রম আদালতে তার যে দণ্ড হয়েছে সেটি এবং অন্যটি অর্থপাচার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলা। এখন দেখার বিষয় যে এই সমস্ত মামলা থেকে জামিন নিয়ে ড. ইউনূস কতদিন বাইরে থাকেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস   শ্রম আদালত   হাইকোর্ট  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন