২৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য, অসাধারণ দিন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আওয়ামী লীগ তার অভিযাত্রার ৭৫ বছর পূর্ণ করল। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই উপমহাদেশে অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এই ৭৫ বছর আওয়ামী লীগ যেমন সুসময় পার করেছে, তেমনি পাড়ি দিয়েছে প্রতিকূলতার ঝঞ্ঝা। সবকিছু সামাল দিয়ে আওয়ামী লীগ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। একটি শক্তিশালী, বর্ণাঢ্য এবং চিরসবুজ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে।
আওয়ামী লীগ যেন অমলিন, আওয়ামী লীগ যেন চিরসজীব, প্রাণস্পন্দনে ভরপুর। এই ৭৫ বছরে আওয়ামী লীগের ইতিহাস যদি আমরা নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখব, আওয়ামী লীগের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের ইতিহাস একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাসই যেন বাংলাদেশের ইতিহাস। এ ইতিহাসের দুটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় সংগ্রামের ইতিহাস আর দ্বিতীয় অধ্যায়টি হলো বিনির্মাণের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের জাতীয় পতাকা, মানচিত্র এবং এ ভূখণ্ড। আওয়ামী লীগর মাধ্যমেই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা। আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের উন্নয়নের কান্ডারি।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে। মুসলিম লীগের প্রতি মানুষের আক্রোশ এবং আশাহতের বেদনা থেকেই জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের ভালোবাসার এক সামষ্টিক রূপ ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালির মুক্তির অবিচল সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল।
এ অভিযাত্রায় আওয়ামী লীগ বারবার বাধা পেয়েছে। সংগ্রাম করতে হয়েছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য। আর এটি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, নিপীড়িত হয়েছেন। এ দলটি বিভিন্ন সময় অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। কিন্তু তার পরও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করেছে এবং স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাকে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত করেছে। এই দল কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার পরই আওয়ামী লীগের নবযাত্রার সূচনা হয়। তিনিই আওয়ামী লীগকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন। জাতির পিতাই আওয়ামী লীগকে গণমানুষের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। তিনি গ্রামগঞ্জে প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। মানুষের অধিকারের বার্তা দিয়েছিলেন, দিয়েছেন মুক্তির বার্তা।
সে কারণেই আওয়ামী লীগ জনমানুষের প্রাণের দলে পরিণত হয়েছে। আর এ গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিল তিল করে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা ঘোষণা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচন প্রতিটি ধাপে আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আরও বিকশিত হয়েছে। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দীপ্ত হয়েছে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। জনগণের ঐক্যের শক্তিতেই আওয়ামী লীগ বলীয়ান।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সংগ্রামের ইতিহাসের পথ ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। দুটি নদী যেমন এক মোহনায় মিলিত হয় ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস এক মোহনায় মিলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। শহীদের রক্তে রঞ্জিত পবিত্র স্বাধীনতা এসেছে, এ পথ দিয়েই।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনের সংগ্রাম শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শুরু করেন সোনার বাংলা বিনির্মাণের এক কঠিন যুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এবং ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করে। সেই ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পথ হারায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর এক নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ধূসর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর যে গল্প সেই গল্পের নায়ক ‘শেখ হাসিনা’। তার হাত ধরেই আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ আবার জেগে ওঠে। অধিকারহারা মানুষ আবার আশার আলো দেখে। অন্ধকার টানেল থেকে বাংলাদেশের জনগণ এক নতুন যুদ্ধের সূচনা করে।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় সর্বসম্মতভাবে। তখন আওয়ামী লীগ একটি বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত রাজনৈতিক দল। অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। এরকম এক অবস্থায় দলটির হাল ধরেন শেখ হাসিনা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এখান থেকেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনা আর এখান থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামের নবযাত্রা।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়। একই সময় শুরু হয় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য এক নতুন যুদ্ধের। এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র জয়ী হয়। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে বিজয়ী হন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ‘সোনার বাংলা বিনির্মাণের’ উন্নয়নের অভিযাত্রার গল্প এখান থেকেই শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর যে দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল, যে দেশটি টিকবে কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে রীতিমতো গবেষণা হতো, সেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে। স্বাধীন-সার্বভৌম, আত্মনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মমর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল, মাত্র পাঁচ বছরে তিনি বাংলাদেশকে বদলে দেন। আশার প্রদীপ জ্বালান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি একদিকে যেমন গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের অংশীদার করেন। স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্য। স্বাধীনতার সুফল যেন সব মানুষ পায় তা নিশ্চিত করার জন্য এক অনবদ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকৌশল গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর আবার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে বাংলাদেশের। আবার ক্ষত-বিক্ষত হয় আওয়ামী লীগ। সারা দেশে দলটির ওপর জুলুম-নিপীড়ন চলে সীমাহীনভাবে। আওয়ামী লীগ নিধন যেন একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে পরিণত হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশব্যাপী শুরু করে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন। আর এ কর্মসূচির কারণে ঘরহারা হয়ে পড়ে বহু মানুষ। বহু মানুষ প্রাণ দেয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ নিধনের চূড়ান্ত নীল-নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য আওয়ামী লীগের জনসভায় চালানো হয় নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা। কিন্তু তার পরও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি, বেঁচে যায় বাংলাদেশ।
২০০৭ সালে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আবার ষড়যন্ত্র হয়, ষড়যন্ত্র হয় গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সংস্কারপন্থিরা আওয়ামী লীগকে আবার বিভক্ত করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ নিয়ে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার অপচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে সফলভাবে।
২০০৭ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় বিপুলসংখ্যক গরিষ্ঠতা নিয়ে। এর পরই শুরু হয়েছে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। বাংলাদেশের ইতিহাস উন্নয়নের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস অগ্রযাত্রার ইতিহাস। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনুকরণীয় উদাহরণ। শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি শাসনকালে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। একদিকে যেমন তিনি মেগা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন; পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মাধ্যমে তিনি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন, ঠিক তেমনি ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে তিনি তথ্যপ্রযুক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা দেশে। যার সুফল ভোগ করছে প্রতিটি নাগরিক।
বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি, বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের সুফল পেয়েছে প্রতিটি মানুষ। আর এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। প্রান্তিক মানুষ পাচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলো আজ ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশে। গৃহহীনরা ঘর পাচ্ছে, কোনো মানুষ কর্মহীন থাকছে না।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ বাংলাদেশের সাফল্যের গল্পগুলো চর্চা হচ্ছে সারা বিশ্বে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আজ বাংলাদেশ অনুকরণীয় মডেল। সারা বিশ্বকে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়—এটি স্রেফ কথার কথা নয়, এটি বাস্তবতা। আর এ সবকিছুই শেখ হাসিনার প্রজ্ঞায় হয়েছে। নির্মোহভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তার সবকিছুই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ মানে মুক্ত মনের বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে আধুনিক প্রগতিশীল এক বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে শিক্ষিত-উদ্দীপ্ত, অগ্রসর এক বাংলাদেশ। আর এরকম একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে আমাদের দেশ। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশের জন্ম, আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশের বিকাশ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস যেন একাকার হয়ে গেছে, মিলেছে একবিন্দুতে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
বেগম
জিয়ার ডাক নাম ‘পুতুল’। একসময় আপোষহীন
নেত্রীর খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদ এখন
নিজেই যেন ‘পুতুল’ হয়ে
গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার
মুক্তির দাবিতে নতুন করে আন্দোলন
শুরু করেছে বিএনপি। সপ্তাহ জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন
ধরনের কর্মসূচী ছিলো। শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পহেলা
জুলাই মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর ৩ জুলাই
জেলায় জেলায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসমস্ত
সমাবেশ কতটা আন্তরিক বা
কতটা আত্মরক্ষার কৌশল তা নিয়ে
প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেগম জিয়া কি
বিএনপির আন্দোলনের একমাত্র অস্ত্র? এই আন্দোলন করে
কি বেগম জিয়াকে মুক্ত
করা সম্ভব?
৭
জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি এখন
দিশেহারা। ক্ষত-বিক্ষত এবং
আত্মবিশ্বাসহীন একটি রাজনৈতিক দলে
পরিণত হয়েছে। নিজেদের ভুল তারা বুঝতে
পারছে কিন্তু স্বীকার করছে না। দলটির
ভেতর চলছে অন্তঃকলহ।
দলের মধ্যে নেই কোন সমন্বয়।
সবকিছু হচ্ছে স্বৈরাচারী কায়দায়। এর মধ্যেই হঠাৎ
করেই বেগম খালেদা জিয়ার
মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কেন সেই প্রশ্ন
উঠতেই পারে। বিএনপি মনে করছে এটাই
তাদের আত্মরক্ষার সহজ পথ, দল
গোছানোর সুযোগ। বেগম জিয়া অসুস্থ।
তিনি হাসপাতালে। তার অসুস্থতা নিয়ে
জনগণের আবেগকে উস্কে দিতে চায় বিএনপি।
আর একারণেই খালেদা জিয়াকে তারা পুতুল হিসেবে
ব্যবহার করছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া
আসলে বিএনপির পুতুল নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী
লীগ তাকে ব্যবহার করছে?
ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ বেগম জিয়াকে
গত ১৫ বছরে রাজনীতিতে
‘এতিম’ করেছে। বিশেষ অনুকম্পায় মুক্তি দিয়ে করুণাপাত্রে পরিণত
করেছে। সরকার তার হাতের মুঠোয়
খালদাকে নিয়ে বিএনপিকে চাপে
রাখছে। সরকারের করুণায় তার মুক্ত জীবন।
আওয়ামী লীগ চাইলেই এখন
কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারে বিএনপি’র নামমাত্র চেয়ারপার্সনকে।
বেগম জিয়া যেন এক
অর্থে আওয়ামী লীগের ‘পুতুল’।
বেগম
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিলো হঠাৎ করেই।
তিনি রাজনীতিতে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম এর
মতো করেই সবকিছু পেয়ে
গেছেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ থেকে
রাজনৈতিক অঙ্গনে আপোষহীন নেতার মর্যাদা পান বেগম খালেদা
জিয়া। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, কোনরকম অতীত অভিজ্ঞতাহীন একজন
গৃহবধূর রাজনীতিতে আসার প্রধান কারণ
ছিলো জিয়ার ইমেজকে ব্যবহার করা। রাজনীতিতে এসে
বেগম খালেদা জিয়া তার সীমাবদ্ধতাগুলো
ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, একারনেই
তিনি ‘পুতুল’ হিসেবেই রাজনীতিতে ছিলেন। কখনো পাকিস্তানি গোয়েন্দা
সংস্থা আইএসআইয়ের পরামর্শে,
কখনো দলের সিনিয়র নেতাদের
পরামর্শে, এভাবেই রাজনীতিতে মৌণব্রত পালন করে তিনি
ক্রমশ শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। মূলত আওয়ামী লীগ
বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি এবং ভোট ব্যাংকই
ছিলো খালেদার সম্পদ। তারাই বেগম খালেদা জিয়াকে
নেতা বানিয়েছেন। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই বেগম খালেদা জিয়া
সবকিছু করেছেন। চিরকালই বেগম জিয়া ‘পুতুল’ই ছিলেন।
পাকিস্তান
পন্থী ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী
এবং ৭৫ এর খুনীরাই
বেগম খালেদা জিয়াকে নেতার আসনে আসীন করেছিলেন।
আর একারণে বেগম জিয়া সবসময়
স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এবং ৭৫ এর
খুনীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি দেখিয়েছেন। তাদেরকে ছাড় দিয়েছেন। বেগম
খালেদা জিয়ার সামনে গণতান্ত্রিক নেতা হওয়ার একটি
সুবর্ণ সুযোগ ছিলো। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি
নিজেই কাজে লাগাননি।
একসময়
বেগম খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হতো। কেউ
কেউ এটাও প্রমাণের চেষ্টা
করতেন বেগম খালেদা জিয়া
শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয়। যারা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধী, যারা ৭৫’র
ষড়যন্ত্রের অংশীদার তারা সবসময় বেগম
খালেদা জিয়াকে লাইম লাইটে আনার
চেষ্টা করতেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে
রাজনীতিতে চিরস্থায়ী করতে পারে নি
তারা। কারণ বেগম খালেদা
জিয়া নিজের আলোয় আলোকিত ছিলেন
না। নিজের মেধায় রাজনীতিতে বিকশিত হননি। রাজনীতিতে প্রজ্ঞাহীনতাই তাকে পরিত্যক্ত করেছে।
৮৬’র নির্বাচনে বেগম
জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হয় তিনি
যেন নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন।
আর একারণে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বেগম খালেদা জিয়া
পাকিস্তান পন্থীদের পরামর্শে নির্বাচন থেকে সরে আসেন।
ঐ নির্বাচনে না যাওয়াটাই বেগম
খালেদা জিয়ার জন্য সাপে বর
হয়েছে। ৯১ সালের নির্বাচনে
একারণেই বিজয়ী হয়েছেন বলে অনেকেই মনে
করেন। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায়, ৯১
এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বে বিএনপির বিজয়ের প্রধান কারণ ছিলো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। আওয়ামী লীগকে তারা ভয় পেত।
আওয়ামী লীগের উপর আস্থা রাখতে
পারেনি। আর একারনেই একজন
‘পুতুল’ প্রধানমন্ত্রীকে তারা পছন্দের তালিকায়
রেখেছিল। বেগম খালেদা জিয়া
প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি
সেই সব কাজই করেছেন
যা তার প্রভুরা চেয়েছে।
আর আর একারণেই তিনি
‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ’ বাতিল করেননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন নি,
৭৫ এর খুনীদের কূটনৈতিক
চাকরি থেকে অপসারণ করেননি। ১৯৯৬
সালে তিনি তীব্র গণআন্দোলনের
মুখে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে
বাধ্য হন। তখন তার
‘আপোষহীন’ তকমাটা খসে পড়েছিল। কিন্তু
তারপরও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং
পাকিস্তানপন্থী স্তাবকরা বেগম খালেদা জিয়াকে
মহিমান্বিত করার চেষ্টা থেকে
সরে যাননি।
৯৬
সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দলে
যায় বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া
হন বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু
বিরোধী দলের নেতা হয়ে
তিনি শুধু সময়ের অপচয়
করেছেন রাজনীতির পরিপক্কতা বা বিচক্ষণতার প্রমাণ
রাখতে পারেননি। ২০০১ সালে আবার
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের
মাধ্যমেই বেগম খালেদা জিয়াকে
ক্ষমতায় আনা হয়। এবার
তার উত্থানের পিছনে জামায়াতের অবদান আড়ালে ছিলো না। পুতুল
নাচে যে পুতুলটি নাচে
তার সুতোটা দেখা যায় না।
কিন্তু ২০০১ সালে বেগম
খালেদা জিয়ার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পিছনে যে সুতো ছিলো
তা সকলের কাছেই দৃশ্যমান হয়। এসময় বেগম
খালেদা জিয়া দুই সুঁতোয়
নাচতেন। একটি সুঁতো ছিলো
আইএসআইয়ের হাতে, অন্যটি তারেক জিয়ার কাছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের
মধ্য দিয়ে ‘হাওয়া ভবনের’ উত্থান ঘটে। বেগম খালেদা
জিয়া হন নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী।
হাওয়া ভবন থেকেই পরিচালিত
হতো রাষ্ট্র। দু’টি সমান্তরাল
সরকার দেশ শাসন করতো।
এই শাসনামলে দশ ট্রাক অস্ত্র
মামলা, ২১ শে আগস্ট
গ্রেণেড হামলার মতো অনেক নজীর
বিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। বেগম খালেদা জিয়া
পুত্র স্নেহে অন্ধ থেকে এসমস্ত
ঘটনার দায় নিজের কাঁেধ
নিয়েছেন, এসব অপকর্মে সহযোগিতা
করেছেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী
হতে পারেননি, একজন অন্ধ মা
হতে পেরেছেন মাত্র। পুত্রের কাছে দেশকে বিসর্জন
দিয়েছেন।
২০০১
সাল থেকে ২০০৬ সাল
পর্যন্ত ঘটনা তাতেই বেগম
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের পতনের সূচনা হয়েছিলো বলে আমি মনে
করি। তিনি যে দেশ
শাসনের জন্য অযোগ্য, অক্ষম
এবং অদূরদর্শী এটি প্রমাণিত হয়েছে
এসময়। আর বেগম খালেদা
জিয়ার এই অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের
কারণেই ২০০৭ সালে এক-এগারো আসে। গণতন্ত্র নির্বাসনে
যায়।
মূলত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে বিএনপি জামায়াত
জোট সরকারের আমলেই। এই সময় সংবিধান
সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির
চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় যাতে সাবেক
বিএনপি নেতা বিচারপতি কে
এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারেন। এ
ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর সারাদেশ আন্দোলনে
ফুঁসে ওঠে। শেষ পর্যন্ত
কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এরপর ড. ইয়াজ
উদ্দিন আহমেদের মতো একজন স্তাবক,
মেরুদন্ডহীন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। যিনি
হাওয়া ভবনের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতেন
না। আর এরকম নীতিহীন,
ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার
প্রধানের পক্ষপাতের কারণেই অনিবার্যভাবে এক এগারো এসেছে।
ড. ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বেগম জিয়াকে
গ্রেপ্তার করা হয়। তার
দলের থেকে তাকে মাইনাস
করার চেষ্টা করা হয়।বেগম খালেদা
জিয়ার রাজনৈতিক অধ্যায়ের আসল সমাপ্তি ঘটেছিলো
এক এগারের মাধ্যমেই।
২০০৮
এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার
দল শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়।
এসময় পাকিস্তানি প্রভুরা বেগম জিয়াকে ছুঁড়ে
ফেলে। নিজেরাই সমস্যা আক্রান্ত হয়ে তারা বাংলাদেশে
আগ্রহ হারায়। ফলে রাজনীতিতে দিশাহীন
হয়ে পরেন বেগম জিয়া।
নিতে থাকেন একের পর পর
এক ভুল সিদ্ধান্ত। বেগম
খালেদা জিয়া কি নিজের
রাজনৈতিক বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে ২০১৪ সালের নির্বাচন
বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বেগম জিয়া কি
তার নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
নিন্দা জানিয়েছিলেন? বেগম খালেদা জিয়া
কি নিজস্ব প্রজ্ঞায় ২০১৫ সালে লাগাতার
অবরোধের ডাক দিয়ে গুলশানে
তার কার্যালয়ে অবস্থান করেছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর-
না। বেগম খালেদা জিয়াকে
দিয়ে এসব করানো হয়েছিলো।
কারণ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত
নেয়ার ক্ষমতা ও যোগ্যতা নাই।
সব সিদ্ধান্ত ছিলো তারেক জিয়ার
। আর তারেক জিয়ার
এই অপরিপক্ক, ভ্রান্ত, উদ্ভট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।
এমনকি ২০১৮ সালে বেগম
খালেদা জিয়া মামলার রায়
হবার আগে লন্ডনে গিয়েছিলেন
পুত্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
সেসময় তিনি যদি লন্ডনেই
থাকতেন তাহলে রায়ের ফলাফল যাইহোক না কেন তাকে
অন্তত কারাগারে যেতে হতো না।
। কিন্তু তারেক জিয়া তাকে ‘পুতুল’
হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আরো
নির্দিষ্ট করলে বলা যায়,
তারেক জিয়ার গিনিপিগ হিসেবেই তিনি দেশে ফিরে
এসেছিলেন মামলার রায়ের আগে। বেগম খালেদা
জিয়ার গ্রেপ্তারের পরেই তারেক জিয়া
বিএনপি দখল করেন। বিএনপির
রত্ন ভান্ডারের চাবি চলে যায়
তার কাছে। এখান থেকে চাঁদাবাজি,
কমিটি বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে অগাধ সম্পদের মালিক
হবার স্বর্ণদ্বার খুলে যায় তারেক
জিয়ার সামনে। আর একারনেই তিনি
নিজের মাকে জিম্মী করেন।
এখন যখন বেগম জিয়াকে
বিদেশ পাঠানোর দাবি করা হয়,
তখন প্রশ্ন আসে, ২০১৮ সালে
কেন তাকে লন্ডন থেকে
দেশে আনা হলো?
বেগম
জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মুক্তির
জন্য বিএনপি কি করেছে? বিএনপির
নেতারা বলেছিলো যে তারা আন্দোলনের
মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে
মুক্ত করবে। কিন্তু আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে
পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার
আইনি লড়াইও থমকে রয়েছে। বিএনপির
বেগম খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে বিএনপি কতটা
আন্তরিক সে প্রশ্ন উঠতেই
পারে। তার জামিনের জন্য
আদালতে যাচ্ছে না কেন আইনজীবীরা?
বেগম জিয়ার এই পরিণতির জন্য
কে কতটুকু দায়ী, তা নির্মোহভাবে হিসেব
করতে হবে। সরকার ২০২০
সালের মার্চে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির
৪০১ ধারায় জামিন দিয়ে উদারতার পরিচয়
দিয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে
মুক্ত করে বিদেশ পাঠানোর
জন্য প্রয়োজন আইনী লড়াই করা।
সে লড়াইয়ে বিএনপি কেন দ্বিধাম্বিত?
বেগম
জিয়া আসলে তারেক জিয়ার
পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তারেক জিয়ার রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন
বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়াকে
ব্যবহার করে বিএনপি একদিকে
যেমন তার হতাশা কাটাতে
চাচ্ছে অন্যদিকে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ
করতে চাইছে। আবার বেগম খালেদা
জিয়ার যদি কিছু হয়
তাহলে সবচেয়ে লাভবান হবে তারেক জিয়া।
একদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন হওয়াটা তার জন্য চিরস্থায়ী
হবে। অন্যদিকে এই ইস্যুতে বিএনপিকে
হয়তো কিছুদিন সচল রাখতে পারবেন।
কিন্তু মাকে পণ বানিয়ে
কিংবা কূটচাল ব্যবহার করে রাজনীতিতে সাময়িকভাবে
জয়ী হওয়া যায়, কিন্তু
দীর্ঘস্থায়ী অর্জন থাকে শূণ্য। রাজনীতিতে
নিজস্ব প্রজ্ঞায় আলোকিত না হলে ‘পুতুল’
হয়েই থাকতে হয়।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের আগে দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। ক্ষমতার পালাবদলের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হাহাকার হয়। জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেভাবেই সরকার বদল হোক, তার আগে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে সামনে আসে।
১৯৭৪ সালে সাজানো দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণবাহিনীর পরিকল্পিত সন্ত্রাস আগস্ট ট্র্যাজেডির পটভূমি তৈরি করেছিল। এ সময় সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ছিল খাদ্য সংকটের ফুলানো-ফাঁপানো খবর। কালোবাজারি, মজুতদারদের কাহিনি ছাড়া কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশিত হতো না। এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ’৭৪-এর জানুয়ারি থেকে ’৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি প্রতিটি বক্তব্যেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ—এরা কিন্তু অসৎ নয়। ব্ল্যাক মার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাক মার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া করেছে তারাই বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই।’
১৯৭৫-এর ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষকে ভালোবাসব।’
কিন্তু সরকারের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজরা জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দেননি। আর এ কারণেই তিনি তাদের প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। কয়েকজন খারাপ লোক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত করেছিলেন। তাদের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের ষড়যন্ত্রের কাছেই পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটে ইতিহাসের বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনা। সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশজুড়ে অস্থিরতা—এমন একটি আবহ সৃষ্টি করেই ’৭৫-এর খুনি, ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিল। আর অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ। গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়নি।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগে দেশে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কারা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৮০ সালের শেষ দিক থেকেই শুরু হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ১৯৮০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিমেন্টের মূল্য বৃদ্ধি হয়, ৬ সেপ্টেম্বর দাম বাড়ে গুঁড়া দুধের। ১৮ সেপ্টেম্বর রেশনে চিনির দাম বাড়ে ৫০ শতাংশ, অক্টোবরে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ানো হয়। ১৯৮১-এর এপ্রিলে রেশনে চাল ও গমের দাম বাড়ে। লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে স্বৈরাচারের শক্ত শিকলও আলগা হয়ে যায়। ১৯৮০ সালে রংপুর কারাগারে বিদ্রোহ শুরু হয়, পরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। জিয়া নিহত হওয়ার অল্প দিন আগে ১৯৮১ সালের ৫ এপ্রিল দুর্নীতির দায়ে এক মন্ত্রী ও তিন প্রতিমন্ত্রীকে সরিয়ে দেন। এর পরই ঘটে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থান। ১৯৮১-এর ৩০ মে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নিহত হন। যেভাবে এবং যে পথে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই পথেই তিনি বিদায় নেন।
জিয়াউর রহমানের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপি সরকার। বিচারপতি সাত্তারের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই শুরু হয় দুর্নীতির নানারকম আলোচনা। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ আসে বিচারপতি সাত্তারের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এ সময় ইমদাদুল হক ইমদুর ঘটনায় সরকারের ভিত নড়ে যায়। ইমদাদুল হক ইমদু একসময় জাসদ করতেন। তিনি ঢাকার কালীগঞ্জ থানা গণবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। কালীগঞ্জে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্ত ছিল না। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সম্পত্তি দখল, অপহরণ, খুনের অভিযোগ ছিল অনেক। যুব উন্নয়নমন্ত্রী আবুল কাশেম সরকারের বাসা থেকে ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাশেমের বিরুদ্ধে ইমদুকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা গোটা সরকারকে বিব্রত করে। একজন মন্ত্রীর বাসায় দাগি খুনি এবং আসামি কীভাবে থাকে, সে নিয়ে হৈচৈ হয়। অনেকে মনে করেন, ১৯৮২ সালে ইমদুর এ ঘটনায় বিচারপতি সাত্তারের সরকারের পতন ডেকে আনে। এর আগে যুবমন্ত্রী কাশেম ১১ ফেব্রুয়ারি সাত্তারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। পত্রিকাগুলোয় ইমদুর অপরাধের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বাড়ে ব্যাপকভাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পতন ঘটে সাত্তার সরকারের। অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। স্থগিত করা হয় সংবিধান।
এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসন যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব তার দুর্নীতির আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়ে তিনি ‘সততা’র প্রমাণ রাখতে চান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে শুরু করেন দুর্নীতির মহোৎসব। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সে সময় শৃঙ্খলিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদ সরকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। সে সময় বিদেশি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে ‘দরিদ্র দেশের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রপতি’ কিংবা মরিয়ম মমতাজের সঙ্গে এরশাদের প্রেমকাহিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ফেয়ার ফ্যাক্স রিপোর্টে আসে এরশাদের দুর্নীতির আদ্যোপান্ত। চিনি চুরি, গম লুট করে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা দেশে। উপজেলা পদ্ধতি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরশাদ ‘সার্বজনীন দুর্নীতির স্কিম’ চালু করেন। তৈরি হয় উপজেলা টাউট দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী। এ সময় এরশাদের বান্ধবী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান পত্নী জিনাত হোসেইনের ক্ষমতার দাপট, দুর্নীতি, বিভিন্ন মন্ত্রী এবং এরশাদের একান্ত অনুগতদের অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয় যে, জনগণ এরশাদকে একজন দুর্নীতিবাজ এবং লম্পট হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। ’৯০-এ কুয়েত যুদ্ধের পটভূমিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে হুহু করে। সঙ্গে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দুর্নীতির জন্যই এসব মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। তারা রাজপথে নেমে আসে। স্বৈরাচারের পতন ঘটায়।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে নাটকীয়ভাবে। বিএনপি আমলে দুর্নীতির বিভিন্ন খবর আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ড্যান্ডি ডায়িং কেলেঙ্কারি, কোকো লঞ্চ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, সাইদ ইস্কান্দারের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নেওয়া, সার কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা দুর্নীতির খবর বিএনপি সরকারকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। জনগণও বিএনপি সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্নীতিতে খালেদা জিয়া আর এরশাদ সমান হয়ে যান। খালেদা জিয়ার ভাই-বোনদের দুর্নীতির চর্চা হয় চায়ের আড্ডায়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের প্রধান কারণ ভোট চুরি আর দুর্নীতি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে দীর্ঘ ২১ বছর পর। আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার প্রথম দিকের দিনগুলো ছিল অত্যন্ত চমৎকার। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একটি নতুন উন্নয়নের ধারা সূচনা করেছিল। বিশেষ করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি বণ্টন, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাফল্য ছিল অসাধারণ। একটি বাড়ি, একটি খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে এসে নানারকম দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ ফলাও করে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের ‘গল্প’ আলোচিত হতে থাকে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলের জমি দখল, ঢাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এক এমপির অস্ত্র হাতে মিছিলের ছবি। ফেনীতে জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের তাহের, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের নানারকম খবর গণমাধ্যমে আসতে থাকে রং মাখিয়ে। বিব্রত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এসব অর্ধেক সত্য, অর্ধেক কল্পিত সংবাদ অনেকে বিশ্বাস করে। এর প্রভাব পরে ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে অবশ্য আর অপেক্ষা করেনি। প্রথম দিন থেকেই হাওয়া ভবনের দুর্নীতি সারা দেশে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়েছিল। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে লুণ্ঠন এবং অনিয়মের এক নজিরবিহীন ঘটনা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এ সময়। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব অপসারিত হন শুধু দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধান করতে চেয়ে। সরকারি চাকরিতে বদলি-নিয়োগ, টেন্ডার ইত্যাদি সবকিছু দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা কেলেঙ্কারি, খাম্বা কেলেঙ্কারিসহ হাজারো দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে। বিএনপি অবশ্য এসব মোটেও আমলে নেয়নি, পাত্তাও দেয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার বিএনপি সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। হারিস চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, গিয়াস উদ্দীন আল মামুনের মতো দুর্নীতির শিরোমণি দুর্বৃত্তরা জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছিলেন এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক—এরকম একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। এ সময় বাজারে প্রথম সিন্ডিকেট চালু হয়। সয়াবিন, লবণ কিংবা চিনি বাজার থেকে উধাও করে দাম বৃদ্ধির এক কৌশল শুরু হয়। কারসাজি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ফুঁসে ওঠে মানুষ।
২০০৭ সালে নানা নাটকের পর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলের নেতাদের দুর্নীতির সত্য-মিথ্যার মিশেলে রগরগে কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষ করে বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোতে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের এক খেলা শুরু হয়। এই চরিত্র হননের মিশনের মধ্য দিয়েই এক-এগারো সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ—এটি প্রমাণের চেষ্টা চলে ফখরুদ্দীন সরকারের দুই বছর। এই অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে নিজেরাই দুর্নীতির নেশায় আসক্ত হন। ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করে চাঁদাবাজি, জোর করে অর্থ আদায় সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। রীতিমতো লুটেরা শাসন কায়েম করেছিল ড. ফখরুদ্দীন-মইন সরকার। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে হুহু করে। পণ্যের বাজারে সৃষ্টি হয় নজীরবিহীন সংকট। গণআক্রোশের আঁচ পেয়ে নির্বাচন দিয়ে কোনোমতে বিদায় নেয় এই সরকার।
টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি তার নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু পণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য নেই এখনো। এর মধ্যে মতি, বেনজীরদের কাহিনি নিয়ে চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। তাদের অপকর্মের দায় সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ এর মাধ্যমে সরকারকেই ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রমাণের চেষ্টা করছে। ব্যক্তির দুর্নীতির দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হচ্ছে সে ব্যবস্থাগুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে না। কেউ বলছে না, অতীতে কোনো সরকার এভাবে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিংবা দলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিকে প্রশংসা করা হচ্ছে না। এর ফাঁকফোকর আবিষ্কারে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। অগণতান্ত্রিক শক্তি বিরাজনীতিকরণের জন্য সবসময় এই পথই বেছে নেয়। আর এ কারণেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এখনই। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। থাকতে হবে পক্ষপাতহীন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যেমন চলবে, তেমনি দুর্নীতির যে কল্পকাহিনিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তারও উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। কারণ এই উপসর্গ পুরোনো, লক্ষণগুলো ভালো নয়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
দুর্নীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকার লক্ষণ ষড়যন্ত্র
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বেগম জিয়ার ডাক নাম ‘পুতুল’। একসময় আপোষহীন নেত্রীর খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদ এখন নিজেই যেন ‘পুতুল’ হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। সপ্তাহ জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী ছিলো। শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পহেলা জুলাই মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর ৩ জুলাই জেলায় জেলায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসমস্ত সমাবেশ কতটা আন্তরিক বা কতটা আত্মরক্ষার কৌশল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেগম জিয়া কি বিএনপির আন্দোলনের একমাত্র অস্ত্র? এই আন্দোলন করে কি বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব?
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের আগে দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। ক্ষমতার পালাবদলের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হাহাকার হয়। জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেভাবেই সরকার বদল হোক, তার আগে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে সামনে আসে।
ছোট বেলায় অনেকগুলো প্রবাদের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম। ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য কিছু পরিচিত বাক্য দেয়া হতো। সে বাক্যগুলো ছিলো বেশ মজার। ছোট বেলার দুষ্টুমি ভরা অবসরে সে বাক্যগুলো নিয়ে নানারকম চর্চা হতো। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’ এমন বাংলার ইংরেজি কি হবে তা নিয়ে শিক্ষকের কানমলা খায়নি এমন বালক খুবই কমই ছিলো আমাদের সময়। সেসময় বিভিন্ন প্রবাদের সঙ্গেও আমাদের পরিচিত ঘটেছিল। প্রবাদগুলোর মধ্যে আজ একটি বেশ মনে পড়ছে। প্রবাদটি হলো ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। তবে, এখন যদি কেউ প্রবাদ-প্রবচন লেখেন তাহলে লিখতে পারেন ‘অভিযান শুরু হলেই দুর্নীতিবাজরা নিখোঁজ হয়।’
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের বিবরণ দেখিয়ে জনগণ শীর্ষে উঠছে। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির বিবরণে মানুষ হতবাক। তাদের যে অঢেল সম্পদ রয়েছে সেই সম্পদের হিসেব কষতে কষতে মানুষ যেন অঙ্কই ভুলে গেছে। এরকম বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে যে, সরকারি কর্মচারী বা সরকারি চাকরি কি তাহলে সোনার হরিণ? সরকারি চাকরি পেলেই কি তাহলে আলাদিনের চেরাগ পাওয়া যায়?
টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছিল। বেশ কয়েক জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অবসরের পর তাদের স্থলে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতিতে ফিরে গেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চলতি মাসে অন্তত দুটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। আরেকটি প্রজ্ঞাপন খুব শিগগিরই জারি হবে বলে জানা গেছে।