মন্তব্য করুন
বেগম
জিয়ার ডাক নাম ‘পুতুল’। একসময় আপোষহীন
নেত্রীর খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদ এখন
নিজেই যেন ‘পুতুল’ হয়ে
গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার
মুক্তির দাবিতে নতুন করে আন্দোলন
শুরু করেছে বিএনপি। সপ্তাহ জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন
ধরনের কর্মসূচী ছিলো। শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পহেলা
জুলাই মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর ৩ জুলাই
জেলায় জেলায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসমস্ত
সমাবেশ কতটা আন্তরিক বা
কতটা আত্মরক্ষার কৌশল তা নিয়ে
প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেগম জিয়া কি
বিএনপির আন্দোলনের একমাত্র অস্ত্র? এই আন্দোলন করে
কি বেগম জিয়াকে মুক্ত
করা সম্ভব?
৭
জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি এখন
দিশেহারা। ক্ষত-বিক্ষত এবং
আত্মবিশ্বাসহীন একটি রাজনৈতিক দলে
পরিণত হয়েছে। নিজেদের ভুল তারা বুঝতে
পারছে কিন্তু স্বীকার করছে না। দলটির
ভেতর চলছে অন্তঃকলহ।
দলের মধ্যে নেই কোন সমন্বয়।
সবকিছু হচ্ছে স্বৈরাচারী কায়দায়। এর মধ্যেই হঠাৎ
করেই বেগম খালেদা জিয়ার
মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কেন সেই প্রশ্ন
উঠতেই পারে। বিএনপি মনে করছে এটাই
তাদের আত্মরক্ষার সহজ পথ, দল
গোছানোর সুযোগ। বেগম জিয়া অসুস্থ।
তিনি হাসপাতালে। তার অসুস্থতা নিয়ে
জনগণের আবেগকে উস্কে দিতে চায় বিএনপি।
আর একারণেই খালেদা জিয়াকে তারা পুতুল হিসেবে
ব্যবহার করছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া
আসলে বিএনপির পুতুল নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী
লীগ তাকে ব্যবহার করছে?
ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ বেগম জিয়াকে
গত ১৫ বছরে রাজনীতিতে
‘এতিম’ করেছে। বিশেষ অনুকম্পায় মুক্তি দিয়ে করুণাপাত্রে পরিণত
করেছে। সরকার তার হাতের মুঠোয়
খালদাকে নিয়ে বিএনপিকে চাপে
রাখছে। সরকারের করুণায় তার মুক্ত জীবন।
আওয়ামী লীগ চাইলেই এখন
কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারে বিএনপি’র নামমাত্র চেয়ারপার্সনকে।
বেগম জিয়া যেন এক
অর্থে আওয়ামী লীগের ‘পুতুল’।
বেগম
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিলো হঠাৎ করেই।
তিনি রাজনীতিতে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম এর
মতো করেই সবকিছু পেয়ে
গেছেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ থেকে
রাজনৈতিক অঙ্গনে আপোষহীন নেতার মর্যাদা পান বেগম খালেদা
জিয়া। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, কোনরকম অতীত অভিজ্ঞতাহীন একজন
গৃহবধূর রাজনীতিতে আসার প্রধান কারণ
ছিলো জিয়ার ইমেজকে ব্যবহার করা। রাজনীতিতে এসে
বেগম খালেদা জিয়া তার সীমাবদ্ধতাগুলো
ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, একারনেই
তিনি ‘পুতুল’ হিসেবেই রাজনীতিতে ছিলেন। কখনো পাকিস্তানি গোয়েন্দা
সংস্থা আইএসআইয়ের পরামর্শে,
কখনো দলের সিনিয়র নেতাদের
পরামর্শে, এভাবেই রাজনীতিতে মৌণব্রত পালন করে তিনি
ক্রমশ শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। মূলত আওয়ামী লীগ
বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি এবং ভোট ব্যাংকই
ছিলো খালেদার সম্পদ। তারাই বেগম খালেদা জিয়াকে
নেতা বানিয়েছেন। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই বেগম খালেদা জিয়া
সবকিছু করেছেন। চিরকালই বেগম জিয়া ‘পুতুল’ই ছিলেন।
পাকিস্তান
পন্থী ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী
এবং ৭৫ এর খুনীরাই
বেগম খালেদা জিয়াকে নেতার আসনে আসীন করেছিলেন।
আর একারণে বেগম জিয়া সবসময়
স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এবং ৭৫ এর
খুনীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি দেখিয়েছেন। তাদেরকে ছাড় দিয়েছেন। বেগম
খালেদা জিয়ার সামনে গণতান্ত্রিক নেতা হওয়ার একটি
সুবর্ণ সুযোগ ছিলো। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি
নিজেই কাজে লাগাননি।
একসময়
বেগম খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হতো। কেউ
কেউ এটাও প্রমাণের চেষ্টা
করতেন বেগম খালেদা জিয়া
শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয়। যারা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধী, যারা ৭৫’র
ষড়যন্ত্রের অংশীদার তারা সবসময় বেগম
খালেদা জিয়াকে লাইম লাইটে আনার
চেষ্টা করতেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে
রাজনীতিতে চিরস্থায়ী করতে পারে নি
তারা। কারণ বেগম খালেদা
জিয়া নিজের আলোয় আলোকিত ছিলেন
না। নিজের মেধায় রাজনীতিতে বিকশিত হননি। রাজনীতিতে প্রজ্ঞাহীনতাই তাকে পরিত্যক্ত করেছে।
৮৬’র নির্বাচনে বেগম
জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হয় তিনি
যেন নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন।
আর একারণে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বেগম খালেদা জিয়া
পাকিস্তান পন্থীদের পরামর্শে নির্বাচন থেকে সরে আসেন।
ঐ নির্বাচনে না যাওয়াটাই বেগম
খালেদা জিয়ার জন্য সাপে বর
হয়েছে। ৯১ সালের নির্বাচনে
একারণেই বিজয়ী হয়েছেন বলে অনেকেই মনে
করেন। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায়, ৯১
এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বে বিএনপির বিজয়ের প্রধান কারণ ছিলো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। আওয়ামী লীগকে তারা ভয় পেত।
আওয়ামী লীগের উপর আস্থা রাখতে
পারেনি। আর একারনেই একজন
‘পুতুল’ প্রধানমন্ত্রীকে তারা পছন্দের তালিকায়
রেখেছিল। বেগম খালেদা জিয়া
প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি
সেই সব কাজই করেছেন
যা তার প্রভুরা চেয়েছে।
আর আর একারণেই তিনি
‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ’ বাতিল করেননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন নি,
৭৫ এর খুনীদের কূটনৈতিক
চাকরি থেকে অপসারণ করেননি। ১৯৯৬
সালে তিনি তীব্র গণআন্দোলনের
মুখে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে
বাধ্য হন। তখন তার
‘আপোষহীন’ তকমাটা খসে পড়েছিল। কিন্তু
তারপরও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং
পাকিস্তানপন্থী স্তাবকরা বেগম খালেদা জিয়াকে
মহিমান্বিত করার চেষ্টা থেকে
সরে যাননি।
৯৬
সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দলে
যায় বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া
হন বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু
বিরোধী দলের নেতা হয়ে
তিনি শুধু সময়ের অপচয়
করেছেন রাজনীতির পরিপক্কতা বা বিচক্ষণতার প্রমাণ
রাখতে পারেননি। ২০০১ সালে আবার
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের
মাধ্যমেই বেগম খালেদা জিয়াকে
ক্ষমতায় আনা হয়। এবার
তার উত্থানের পিছনে জামায়াতের অবদান আড়ালে ছিলো না। পুতুল
নাচে যে পুতুলটি নাচে
তার সুতোটা দেখা যায় না।
কিন্তু ২০০১ সালে বেগম
খালেদা জিয়ার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পিছনে যে সুতো ছিলো
তা সকলের কাছেই দৃশ্যমান হয়। এসময় বেগম
খালেদা জিয়া দুই সুঁতোয়
নাচতেন। একটি সুঁতো ছিলো
আইএসআইয়ের হাতে, অন্যটি তারেক জিয়ার কাছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের
মধ্য দিয়ে ‘হাওয়া ভবনের’ উত্থান ঘটে। বেগম খালেদা
জিয়া হন নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী।
হাওয়া ভবন থেকেই পরিচালিত
হতো রাষ্ট্র। দু’টি সমান্তরাল
সরকার দেশ শাসন করতো।
এই শাসনামলে দশ ট্রাক অস্ত্র
মামলা, ২১ শে আগস্ট
গ্রেণেড হামলার মতো অনেক নজীর
বিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। বেগম খালেদা জিয়া
পুত্র স্নেহে অন্ধ থেকে এসমস্ত
ঘটনার দায় নিজের কাঁেধ
নিয়েছেন, এসব অপকর্মে সহযোগিতা
করেছেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী
হতে পারেননি, একজন অন্ধ মা
হতে পেরেছেন মাত্র। পুত্রের কাছে দেশকে বিসর্জন
দিয়েছেন।
২০০১
সাল থেকে ২০০৬ সাল
পর্যন্ত ঘটনা তাতেই বেগম
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের পতনের সূচনা হয়েছিলো বলে আমি মনে
করি। তিনি যে দেশ
শাসনের জন্য অযোগ্য, অক্ষম
এবং অদূরদর্শী এটি প্রমাণিত হয়েছে
এসময়। আর বেগম খালেদা
জিয়ার এই অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের
কারণেই ২০০৭ সালে এক-এগারো আসে। গণতন্ত্র নির্বাসনে
যায়।
মূলত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে বিএনপি জামায়াত
জোট সরকারের আমলেই। এই সময় সংবিধান
সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির
চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় যাতে সাবেক
বিএনপি নেতা বিচারপতি কে
এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারেন। এ
ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর সারাদেশ আন্দোলনে
ফুঁসে ওঠে। শেষ পর্যন্ত
কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এরপর ড. ইয়াজ
উদ্দিন আহমেদের মতো একজন স্তাবক,
মেরুদন্ডহীন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। যিনি
হাওয়া ভবনের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতেন
না। আর এরকম নীতিহীন,
ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার
প্রধানের পক্ষপাতের কারণেই অনিবার্যভাবে এক এগারো এসেছে।
ড. ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বেগম জিয়াকে
গ্রেপ্তার করা হয়। তার
দলের থেকে তাকে মাইনাস
করার চেষ্টা করা হয়।বেগম খালেদা
জিয়ার রাজনৈতিক অধ্যায়ের আসল সমাপ্তি ঘটেছিলো
এক এগারের মাধ্যমেই।
২০০৮
এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার
দল শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়।
এসময় পাকিস্তানি প্রভুরা বেগম জিয়াকে ছুঁড়ে
ফেলে। নিজেরাই সমস্যা আক্রান্ত হয়ে তারা বাংলাদেশে
আগ্রহ হারায়। ফলে রাজনীতিতে দিশাহীন
হয়ে পরেন বেগম জিয়া।
নিতে থাকেন একের পর পর
এক ভুল সিদ্ধান্ত। বেগম
খালেদা জিয়া কি নিজের
রাজনৈতিক বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে ২০১৪ সালের নির্বাচন
বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বেগম জিয়া কি
তার নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
নিন্দা জানিয়েছিলেন? বেগম খালেদা জিয়া
কি নিজস্ব প্রজ্ঞায় ২০১৫ সালে লাগাতার
অবরোধের ডাক দিয়ে গুলশানে
তার কার্যালয়ে অবস্থান করেছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর-
না। বেগম খালেদা জিয়াকে
দিয়ে এসব করানো হয়েছিলো।
কারণ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত
নেয়ার ক্ষমতা ও যোগ্যতা নাই।
সব সিদ্ধান্ত ছিলো তারেক জিয়ার
। আর তারেক জিয়ার
এই অপরিপক্ক, ভ্রান্ত, উদ্ভট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।
এমনকি ২০১৮ সালে বেগম
খালেদা জিয়া মামলার রায়
হবার আগে লন্ডনে গিয়েছিলেন
পুত্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
সেসময় তিনি যদি লন্ডনেই
থাকতেন তাহলে রায়ের ফলাফল যাইহোক না কেন তাকে
অন্তত কারাগারে যেতে হতো না।
। কিন্তু তারেক জিয়া তাকে ‘পুতুল’
হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আরো
নির্দিষ্ট করলে বলা যায়,
তারেক জিয়ার গিনিপিগ হিসেবেই তিনি দেশে ফিরে
এসেছিলেন মামলার রায়ের আগে। বেগম খালেদা
জিয়ার গ্রেপ্তারের পরেই তারেক জিয়া
বিএনপি দখল করেন। বিএনপির
রত্ন ভান্ডারের চাবি চলে যায়
তার কাছে। এখান থেকে চাঁদাবাজি,
কমিটি বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে অগাধ সম্পদের মালিক
হবার স্বর্ণদ্বার খুলে যায় তারেক
জিয়ার সামনে। আর একারনেই তিনি
নিজের মাকে জিম্মী করেন।
এখন যখন বেগম জিয়াকে
বিদেশ পাঠানোর দাবি করা হয়,
তখন প্রশ্ন আসে, ২০১৮ সালে
কেন তাকে লন্ডন থেকে
দেশে আনা হলো?
বেগম
জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মুক্তির
জন্য বিএনপি কি করেছে? বিএনপির
নেতারা বলেছিলো যে তারা আন্দোলনের
মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে
মুক্ত করবে। কিন্তু আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে
পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার
আইনি লড়াইও থমকে রয়েছে। বিএনপির
বেগম খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে বিএনপি কতটা
আন্তরিক সে প্রশ্ন উঠতেই
পারে। তার জামিনের জন্য
আদালতে যাচ্ছে না কেন আইনজীবীরা?
বেগম জিয়ার এই পরিণতির জন্য
কে কতটুকু দায়ী, তা নির্মোহভাবে হিসেব
করতে হবে। সরকার ২০২০
সালের মার্চে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির
৪০১ ধারায় জামিন দিয়ে উদারতার পরিচয়
দিয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে
মুক্ত করে বিদেশ পাঠানোর
জন্য প্রয়োজন আইনী লড়াই করা।
সে লড়াইয়ে বিএনপি কেন দ্বিধাম্বিত?
বেগম
জিয়া আসলে তারেক জিয়ার
পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তারেক জিয়ার রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন
বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়াকে
ব্যবহার করে বিএনপি একদিকে
যেমন তার হতাশা কাটাতে
চাচ্ছে অন্যদিকে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ
করতে চাইছে। আবার বেগম খালেদা
জিয়ার যদি কিছু হয়
তাহলে সবচেয়ে লাভবান হবে তারেক জিয়া।
একদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন হওয়াটা তার জন্য চিরস্থায়ী
হবে। অন্যদিকে এই ইস্যুতে বিএনপিকে
হয়তো কিছুদিন সচল রাখতে পারবেন।
কিন্তু মাকে পণ বানিয়ে
কিংবা কূটচাল ব্যবহার করে রাজনীতিতে সাময়িকভাবে
জয়ী হওয়া যায়, কিন্তু
দীর্ঘস্থায়ী অর্জন থাকে শূণ্য। রাজনীতিতে
নিজস্ব প্রজ্ঞায় আলোকিত না হলে ‘পুতুল’
হয়েই থাকতে হয়।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের আগে দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। ক্ষমতার পালাবদলের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হাহাকার হয়। জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেভাবেই সরকার বদল হোক, তার আগে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে সামনে আসে।
১৯৭৪ সালে সাজানো দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণবাহিনীর পরিকল্পিত সন্ত্রাস আগস্ট ট্র্যাজেডির পটভূমি তৈরি করেছিল। এ সময় সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ছিল খাদ্য সংকটের ফুলানো-ফাঁপানো খবর। কালোবাজারি, মজুতদারদের কাহিনি ছাড়া কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশিত হতো না। এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ’৭৪-এর জানুয়ারি থেকে ’৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি প্রতিটি বক্তব্যেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ—এরা কিন্তু অসৎ নয়। ব্ল্যাক মার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাক মার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া করেছে তারাই বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই।’
১৯৭৫-এর ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষকে ভালোবাসব।’
কিন্তু সরকারের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজরা জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দেননি। আর এ কারণেই তিনি তাদের প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। কয়েকজন খারাপ লোক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত করেছিলেন। তাদের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের ষড়যন্ত্রের কাছেই পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটে ইতিহাসের বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনা। সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশজুড়ে অস্থিরতা—এমন একটি আবহ সৃষ্টি করেই ’৭৫-এর খুনি, ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিল। আর অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ। গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়নি।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগে দেশে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কারা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৮০ সালের শেষ দিক থেকেই শুরু হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ১৯৮০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিমেন্টের মূল্য বৃদ্ধি হয়, ৬ সেপ্টেম্বর দাম বাড়ে গুঁড়া দুধের। ১৮ সেপ্টেম্বর রেশনে চিনির দাম বাড়ে ৫০ শতাংশ, অক্টোবরে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ানো হয়। ১৯৮১-এর এপ্রিলে রেশনে চাল ও গমের দাম বাড়ে। লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে স্বৈরাচারের শক্ত শিকলও আলগা হয়ে যায়। ১৯৮০ সালে রংপুর কারাগারে বিদ্রোহ শুরু হয়, পরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। জিয়া নিহত হওয়ার অল্প দিন আগে ১৯৮১ সালের ৫ এপ্রিল দুর্নীতির দায়ে এক মন্ত্রী ও তিন প্রতিমন্ত্রীকে সরিয়ে দেন। এর পরই ঘটে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থান। ১৯৮১-এর ৩০ মে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নিহত হন। যেভাবে এবং যে পথে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই পথেই তিনি বিদায় নেন।
জিয়াউর রহমানের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপি সরকার। বিচারপতি সাত্তারের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই শুরু হয় দুর্নীতির নানারকম আলোচনা। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ আসে বিচারপতি সাত্তারের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এ সময় ইমদাদুল হক ইমদুর ঘটনায় সরকারের ভিত নড়ে যায়। ইমদাদুল হক ইমদু একসময় জাসদ করতেন। তিনি ঢাকার কালীগঞ্জ থানা গণবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। কালীগঞ্জে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্ত ছিল না। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সম্পত্তি দখল, অপহরণ, খুনের অভিযোগ ছিল অনেক। যুব উন্নয়নমন্ত্রী আবুল কাশেম সরকারের বাসা থেকে ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাশেমের বিরুদ্ধে ইমদুকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা গোটা সরকারকে বিব্রত করে। একজন মন্ত্রীর বাসায় দাগি খুনি এবং আসামি কীভাবে থাকে, সে নিয়ে হৈচৈ হয়। অনেকে মনে করেন, ১৯৮২ সালে ইমদুর এ ঘটনায় বিচারপতি সাত্তারের সরকারের পতন ডেকে আনে। এর আগে যুবমন্ত্রী কাশেম ১১ ফেব্রুয়ারি সাত্তারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। পত্রিকাগুলোয় ইমদুর অপরাধের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বাড়ে ব্যাপকভাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পতন ঘটে সাত্তার সরকারের। অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। স্থগিত করা হয় সংবিধান।
এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসন যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব তার দুর্নীতির আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়ে তিনি ‘সততা’র প্রমাণ রাখতে চান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে শুরু করেন দুর্নীতির মহোৎসব। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সে সময় শৃঙ্খলিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদ সরকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। সে সময় বিদেশি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে ‘দরিদ্র দেশের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রপতি’ কিংবা মরিয়ম মমতাজের সঙ্গে এরশাদের প্রেমকাহিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ফেয়ার ফ্যাক্স রিপোর্টে আসে এরশাদের দুর্নীতির আদ্যোপান্ত। চিনি চুরি, গম লুট করে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা দেশে। উপজেলা পদ্ধতি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরশাদ ‘সার্বজনীন দুর্নীতির স্কিম’ চালু করেন। তৈরি হয় উপজেলা টাউট দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী। এ সময় এরশাদের বান্ধবী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান পত্নী জিনাত হোসেইনের ক্ষমতার দাপট, দুর্নীতি, বিভিন্ন মন্ত্রী এবং এরশাদের একান্ত অনুগতদের অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয় যে, জনগণ এরশাদকে একজন দুর্নীতিবাজ এবং লম্পট হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। ’৯০-এ কুয়েত যুদ্ধের পটভূমিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে হুহু করে। সঙ্গে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দুর্নীতির জন্যই এসব মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। তারা রাজপথে নেমে আসে। স্বৈরাচারের পতন ঘটায়।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে নাটকীয়ভাবে। বিএনপি আমলে দুর্নীতির বিভিন্ন খবর আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ড্যান্ডি ডায়িং কেলেঙ্কারি, কোকো লঞ্চ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, সাইদ ইস্কান্দারের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নেওয়া, সার কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা দুর্নীতির খবর বিএনপি সরকারকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। জনগণও বিএনপি সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্নীতিতে খালেদা জিয়া আর এরশাদ সমান হয়ে যান। খালেদা জিয়ার ভাই-বোনদের দুর্নীতির চর্চা হয় চায়ের আড্ডায়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের প্রধান কারণ ভোট চুরি আর দুর্নীতি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে দীর্ঘ ২১ বছর পর। আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার প্রথম দিকের দিনগুলো ছিল অত্যন্ত চমৎকার। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একটি নতুন উন্নয়নের ধারা সূচনা করেছিল। বিশেষ করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি বণ্টন, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাফল্য ছিল অসাধারণ। একটি বাড়ি, একটি খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে এসে নানারকম দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ ফলাও করে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের ‘গল্প’ আলোচিত হতে থাকে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলের জমি দখল, ঢাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এক এমপির অস্ত্র হাতে মিছিলের ছবি। ফেনীতে জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের তাহের, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের নানারকম খবর গণমাধ্যমে আসতে থাকে রং মাখিয়ে। বিব্রত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এসব অর্ধেক সত্য, অর্ধেক কল্পিত সংবাদ অনেকে বিশ্বাস করে। এর প্রভাব পরে ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে অবশ্য আর অপেক্ষা করেনি। প্রথম দিন থেকেই হাওয়া ভবনের দুর্নীতি সারা দেশে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়েছিল। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে লুণ্ঠন এবং অনিয়মের এক নজিরবিহীন ঘটনা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এ সময়। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব অপসারিত হন শুধু দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধান করতে চেয়ে। সরকারি চাকরিতে বদলি-নিয়োগ, টেন্ডার ইত্যাদি সবকিছু দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা কেলেঙ্কারি, খাম্বা কেলেঙ্কারিসহ হাজারো দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে। বিএনপি অবশ্য এসব মোটেও আমলে নেয়নি, পাত্তাও দেয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার বিএনপি সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। হারিস চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, গিয়াস উদ্দীন আল মামুনের মতো দুর্নীতির শিরোমণি দুর্বৃত্তরা জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছিলেন এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক—এরকম একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। এ সময় বাজারে প্রথম সিন্ডিকেট চালু হয়। সয়াবিন, লবণ কিংবা চিনি বাজার থেকে উধাও করে দাম বৃদ্ধির এক কৌশল শুরু হয়। কারসাজি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ফুঁসে ওঠে মানুষ।
২০০৭ সালে নানা নাটকের পর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলের নেতাদের দুর্নীতির সত্য-মিথ্যার মিশেলে রগরগে কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষ করে বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোতে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের এক খেলা শুরু হয়। এই চরিত্র হননের মিশনের মধ্য দিয়েই এক-এগারো সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ—এটি প্রমাণের চেষ্টা চলে ফখরুদ্দীন সরকারের দুই বছর। এই অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে নিজেরাই দুর্নীতির নেশায় আসক্ত হন। ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করে চাঁদাবাজি, জোর করে অর্থ আদায় সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। রীতিমতো লুটেরা শাসন কায়েম করেছিল ড. ফখরুদ্দীন-মইন সরকার। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে হুহু করে। পণ্যের বাজারে সৃষ্টি হয় নজীরবিহীন সংকট। গণআক্রোশের আঁচ পেয়ে নির্বাচন দিয়ে কোনোমতে বিদায় নেয় এই সরকার।
টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি তার নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু পণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য নেই এখনো। এর মধ্যে মতি, বেনজীরদের কাহিনি নিয়ে চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। তাদের অপকর্মের দায় সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ এর মাধ্যমে সরকারকেই ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রমাণের চেষ্টা করছে। ব্যক্তির দুর্নীতির দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হচ্ছে সে ব্যবস্থাগুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে না। কেউ বলছে না, অতীতে কোনো সরকার এভাবে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিংবা দলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিকে প্রশংসা করা হচ্ছে না। এর ফাঁকফোকর আবিষ্কারে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। অগণতান্ত্রিক শক্তি বিরাজনীতিকরণের জন্য সবসময় এই পথই বেছে নেয়। আর এ কারণেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এখনই। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। থাকতে হবে পক্ষপাতহীন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যেমন চলবে, তেমনি দুর্নীতির যে কল্পকাহিনিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তারও উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। কারণ এই উপসর্গ পুরোনো, লক্ষণগুলো ভালো নয়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
দুর্নীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকার লক্ষণ ষড়যন্ত্র
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
দরিদ্র বাবা অর্থাভাবে সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন, অভাবের তাড়নায় সন্তানকে হাসপাতালে রেখে পালিয়েছেন মা—এমন খবর মাঝেমধ্যে আমরা গণমাধ্যমে পাই। এসব খবরে আমরা উদ্বিগ্ন হই, আতঙ্কিত হই। অনেকেই নানা টানাপোড়েনের কারণে সন্তানকে ফেলে দেন ডাস্টবিনে অথবা রেলস্টেশনে। অজ্ঞাতপরিচয় শিশুকে কুড়িয়ে পাওয়ার খবর আমাদের ব্যথিত করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিতরা তাদের প্রাণের ধন বিক্রি করে দেন বা অস্বীকার করেন। এটি একটি নির্মম বাস্তবতা। এটি হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কাম্য নয়। কিন্তু অবৈধভাবে ফুলেফেঁপে ওঠা ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও যে তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষা করার জন্য সন্তানকে অস্বীকার করেন—এ গল্প আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। মানুষ মাঝেমধ্যে অর্থলোভে পৈশাচিক, বীভৎস হয়ে যায়। তারা এত মানবিক বোধশূন্যহীন হয় যে, নিজের সন্তানকেই অস্বীকার করে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এ রকম একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম।
ঘটনার সূত্রপাত একটি ছাগলকে ঘিরে। ‘ছাগলকাণ্ডে’ এক দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেল। ঈদুল আজহার আগে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন মুসফিকুর রহমান ইফাত। শুরু হয় খোঁজ, কার ছেলে সে? শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তিনি এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে। এ নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম চর্চা হচ্ছে, ঠিক সে সময় বোমা ফাটান এনবিআরের এই কর্মকর্তা নিজেই। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, মুসফিকুর রহমান ইফাত নামে তার কোনো ছেলে নেই। ইফাতকে তিনি চেনে না বলেও হুংকার দেন। এ কথার পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মতিউর রহমান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, যারা অপপ্রচার করছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তখন সবার দৃষ্টি যায় ইফাতের দিকে। ছাগল নিয়ে থাকা এই মিষ্টি ছেলেটির বাবা তাহলে কে?
একজন বাবা তার সন্তানকে অস্বীকার করতে পারেন—এমন নির্মমতা আমাদের সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের বাবারা প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও নিজের জীবন উৎসর্গ করেন সন্তানদের জন্য। নিজেদের সব আনন্দ-বিলাসিতা ত্যাগ করে সন্তানকে মানুষ করতে চান। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে নিজেদের সব কিছু উজাড় করে দেন। সেখানে একজন বাবা সন্তানকে অস্বীকার করবেন কী করে? তাই শুরুতে মতিউরের কথাই সত্য বলে ধরে নিতে হয়। সন্তানকে কি কেউ অস্বীকার করে? আমরা মতিউরের ওপরই আস্থা রাখি। কিন্তু দুষ্ট ছাগলের ক্রেতা খুঁজতে খুলে যায় মতিউরের রত্নভান্ডার। এখন গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে যে, ইফাত মতিউর রহমানের সন্তান। তার দ্বিতীয় সংসারের প্রথম সন্তান ইফাত। ইফাতের মাধ্যমিক পরীক্ষার যে নম্বরপত্র, তাতেও দেখা যাচ্ছে তার বাবার নাম মতিউর রহমান। মতিউর রহমান তাহলে কেন অস্বীকার করলেন তার প্রিয় সন্তানকে? ছাগলকাণ্ডে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য বেরোচ্ছে, সেগুলো ভয়ংকর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরকেও হার মানিয়েছে তা। তার এই গুপ্তধনের খোঁজ যেন আমরা না পাই, সেজন্যই কি তিনি এই কাণ্ড করলেন?
আমি মতিউরের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি দিতে যাব না। কারণ, এটি ইতোমধ্যে কালবেলাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হচ্ছে। ১৫ লাখ টাকা দিয়ে যে কিশোর ছাগল কিনেছে, তা নিয়েও ঠাট্টা, রসিকতা আমি করব না। আমি শুধু একটি বিষয় নিয়ে বিব্রত, হতাশ, বিস্মিত। তা হলো একজন বাবা কতটা বর্বর, পৈশাচিক হলে তার অর্থ এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড গোপন করার জন্য নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে পারেন। টাকা থাকলে মানুষ কী না করে। একাধিক বিয়ে করে, উপপত্নী, বান্ধবী রাখে, বেপরোয়াভাবে সম্পদ ক্রয় করে দেশে-বিদেশে। মতিউর রহমান যেন সেরকমই একটি চরিত্র। তার প্রথম স্ত্রীর ঘরে সন্তানাদি আছে। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন ধানমন্ডিতে। সেখানে তিনি মাঝে মাঝে যান। ভাগ্যিস তিনি তৃতীয় বিয়ে করেননি। অথবা তিনি তৃতীয় বিয়ে করেছেন কি না, তা আমরা জানি না। এ রকম কত বৈধ-অবৈধ স্ত্রী তার আছে, সে বিতর্কেও আমি যাব না। আমার শুধু একটিই প্রশ্ন, মতিউর রহমান তার ছেলেকে কেন অস্বীকার করলেন? এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনেক রকম হতে পারে। আমরা যদি খুব সরলীকরণ ব্যাখ্যা দিতে যাই, তা হলে ব্যাখ্যাটি এ রকম দাঁড়ায়—মতিউর রহমান তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্যই পিতৃত্ব অস্বীকার করেছেন। মতিউর রহমান হয়তো ভেবেছেন, সব কিছু ম্যানেজ করা যাবে। তার যেসব কেচ্ছা-কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়, তিনি অতীতে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আগেও তার অবৈধ সম্পদ খুঁজেছে। সেটা ম্যানেজ করেছেন তিনি টাকার জোরেই। কাজেই তার সন্তান যে ছাগলকাণ্ড করেছেন, সেটাও তিনি ম্যানেজ করতে পারবেন বলে তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল। এ কারণেই তিনি তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সব কিছু অস্বীকার করেছেন। মানুষের দৃষ্টি সাময়িকভাবে আড়াল করার জন্যই তিনি সন্তানকে অস্বীকার করেছিলেন। এর দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তা হলো সন্তানকে যদি তিনি অস্বীকার করেন, তাহলে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ-খবর কেউ নেবে না। তাকে নিয়ে কেউ খোঁচাখুঁচি করবে না। ছাগলকাণ্ডেই বিষয়টি শেষ হবে। সবাই নতুন ইস্যুতে ঝুঁকবে। কিন্তু মানুষ যখন প্রচণ্ড দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়, বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হন, তখন তিনি বেপরোয়া হন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। বাস্তবতা থেকে তিনি নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেন। এ কারণেই তিনি অনুভব করতে পারেন না কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক। মতিউর রহমান মনে করেছিলেন, টাকা থাকলেই বোধহয় সব কিছু সামাল দেওয়া যায়। এ কারণেই তিনি ছেলেকে অস্বীকার করে সবাইকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ যুগে তথ্য গোপন আদৌ কি রাখা যায়! তথ্য গোপন রেখে বাঁচা যায়! মতিউর রহমান যে বিপুল সম্পদ-বিত্ত বানিয়েছেন সে বিপুল সম্পদ যে বৈধ পথে উপার্জন করেননি, তা সন্তানকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। মতিউর যদি বৈধ পথে অর্থ উপার্জন করতেন, তাহলে তার সন্তানের ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনা নিয়ে তিনি গর্বিত হতেন। যেভাবে তিনি অবলীলায় শেয়ারবাজারে তার অর্থপ্রাপ্তির বিবরণ দিচ্ছিলেন একটি টেলিভিশনে, সেভাবেই তিনি ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার একটা ব্যাখ্যা দিতেন। আম্বানির ছেলের বিয়েতে বিত্তের উৎসব হলো না, কার কী? এই ঢাকা শহরে কেউ কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে ভারতীয় তারকাদের নিয়ে এসে ফুর্তি করেন। এসব তো এখন সমাজে ‘জায়েজ’ হয়ে গেছে। এবার ঈদে কেউ কেউ কোটি টাকার গরু কিনেছে। অনেক বিত্তশালী অরুচিকরভাবে তাদের বিত্তের প্রকাশ ঘটান। এসব বিত্তের উৎকট বিলাস মানুষ নীরবে সহ্য করে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অদ্ভুত কিছু ব্যাপার লক্ষ করছি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন চাকরির নামে আলাদিনের চেরাগ পাচ্ছেন। সরকারি চাকরি পাওয়া মানে যেন দুর্নীতির লাইসেন্স পাওয়া। বিপুল বিত্তের মালিক হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ যেন এখন সরকারি চাকরি। কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে যাচ্ছেনই যেন বিত্তবান হওয়ার জন্য। অবৈধ পন্থায় সীমাহীন সম্পদের মালিক হওয়ার লোভে। ইদানীং সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রবল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য যেন সরকারি চাকরি পাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে গেলে দেখা যায়, লাইন ধরে শিক্ষার্থীরা সেখানে প্রবেশ করছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে যদি আপনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, কেন তারা লাইব্রেরিতে গেছেন? দেখবেন প্রায় সবাই লাইব্রেরিতে যাচ্ছেন বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখন উদ্যোক্তা হতে চান না, করপোরেট চাকরি করতে চান না, সৃজনশীলতা চান না। কবি, লেখক, গবেষক হওয়ার আগ্রহ খুব কম শিক্ষার্থীর। আমাদের তারুণ্যের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। এটির একটি বাস্তবভিত্তিক কারণও আছে। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিগুলো নিরাপদ, চিন্তামুক্ত জীবন দেয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মাইনে, একটি রুটিন জীবন এবং ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সে কারণেই হয়তো অনেকেই সরকারি চাকরিতে ঢোকেন। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে একটি অংশ বর্তমানে এখন বিদেশ চলে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় অংশ চাকরির জন্য হামলে পড়ছেন। হোক না তিনি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা কৃষিবিদ। তার শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য সরকারি চাকরি। সরকারি চাকরিতে ঢুকলেই যেন তার জীবন ধন্য হয়ে যায়। মা-বাবা মনে করেন তার সন্তান সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়েছে। আসলে তিনি মানুষ হচ্ছেন নাকি একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে পুনর্জন্ম নিচ্ছেন, সে বিতর্ক এখানে নাইবা করলাম। কদিন আগে একজন তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার হয়েছেন। ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে নিম্নপদে কেন গেলেন, সেটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। আমরা লক্ষ্য করি মেধাবী পরীক্ষার্থীরা যারা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ কাস্টম, আয়কর, এনবিআরের মতো জায়গাগুলোয় বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে এ ধরনের ক্যাডার সার্ভিসগুলোয় মেধাবীদের ঝোঁক যে কাউকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেই। কেন তারা এনবিআরের চাকরি চান, কেন কাস্টমের চাকরি চান, কেন একজন তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা সাব-রেজিস্ট্রার হতে চান? মতিউর রহমানের ঘটনায় সব প্রশ্নের উত্তর এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে। যে তরুণটি তথ্য ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে সাব-রেজিস্ট্রারে যোগদান করেছেন, তিনি মতিউর রহমান হতে চান। প্রচণ্ড বিত্তশালী একজন দুর্নীতিবাজ সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। যে তরুণরা এখন প্রশাসন ক্যাডার, তথ্য ক্যাডার, কৃষি ক্যাডার, স্বাস্থ্য ক্যাডারের চেয়ে কাস্টমস কর্মকর্তা, এনবিআর কর্মকর্তা হতে বেশি আগ্রহী, তাদের উদ্দেশ্য মতিউর রহমান হওয়া। এখন মতিউর রহমানরাই হচ্ছেন অনেকের অনুকরণীয়। এখন দুর্নীতিবাজদের দেখলে কেউ ঘেন্না করে না। দুর্নীতিবাজদের উদহারণ মনে করেন। এখন যার যত সম্পদ তিনিই সমাজে তত প্রতিপত্তিশালী। এখন যিনি যেই পরিমাণ বিত্তশালী, তা হোক বৈধ পথে কিংবা অবৈধ পথে, তিনিই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। টাকা থাকলে এখন সব কিছু হয়। মতিউর রহমান টাকার জোরে এখন দুই স্ত্রীকে আনন্দে রাখছেন। তার এক স্ত্রী রাজনীতিতেও নেমেছেন। মতিউর রহমান ভবিষ্যতে যে রাজনীতি করবেন না, তা কে নিশ্চিত করে বলবে। মতিউর রহমানের টাকা আছে। তাই টাকা দিয়ে তিনি ভবিষ্যতে মনোনয়ন কিনবেন। এমপি হবেন। মতি মন্ত্রী হলেও জাতি অবাক হবে না। কাজেই মতিউর রহমান কিছু তরুণকে উৎসাহী করবেন। যে তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছেন, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই একজন মতিউর রহমান হতে চাইবেন। তারা ড. আকবর আলী খান হতে চাইবেন না, ড. সাদাত হোসেন হতে চাইবেন না। কারণ মতিউর রহমানরা বিত্তশালী, দেশে-বিদেশে তার অঢেল সম্পদ। বেহেশতি সুখে টইটম্বুর তার জীবন। একজন ব্যবসায়ীকে টাকা উপার্জন করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঝুঁকি নিতে হয়। শ্রমিক সামাল দিতে হয়। প্রতিযোগিতা করতে হয়। কিন্তু মতিরা শুয়ে-বসে বাতাস থেকে টাকা উপার্জন করেন। বর্ষাকালে আমরা বৃক্ষরোপণ করি, কেউ ঔষধি গাছ রোপণ করি, কেউ ফলের চারা। মতিউর রহমান রোপণ করেছিলেন টাকার গাছ। একটা না অনেক টাকার গাছ। গাছ থেকে পাতার বদলে মতি টাকা পারেন। সেই টাকা দিয়ে হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন। গড়েছেন রত্নভান্ডার। কিন্তু মতির রত্নভান্ডারে ঢুকেছে দুষ্ট ছাগল। আর সবাই বিত্ত-বৈভবের কথা জেনে ফেলেছে তাতে। তবে মতিউর রহমানের বিশেষ কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। বিত্তশালী হলে সব কিছুকে অস্বীকার করা যায়। আইনকে অস্বীকার করা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনকে বাগে আনা যায়, প্রশাসনকে ম্যানেজ করা যায়, এমনকি গণমাধ্যমের মুখও বন্ধ করা যায়। কিছুদিন পর মতিউর রহমানকে নিয়ে হুলুস্থুল হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। মতিউর রহমান হয়তো সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলবেন। তার দ্বিতীয় ঘরের সন্তানরাও বিদেশে স্থায়ী হবেন। মতির রত্নভান্ডারের সন্ধান দিল যে ছাগল, এর কী হবে?
মন্তব্য করুন
বেগম জিয়ার ডাক নাম ‘পুতুল’। একসময় আপোষহীন নেত্রীর খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদ এখন নিজেই যেন ‘পুতুল’ হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। সপ্তাহ জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী ছিলো। শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পহেলা জুলাই মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর ৩ জুলাই জেলায় জেলায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসমস্ত সমাবেশ কতটা আন্তরিক বা কতটা আত্মরক্ষার কৌশল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেগম জিয়া কি বিএনপির আন্দোলনের একমাত্র অস্ত্র? এই আন্দোলন করে কি বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব?
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের আগে দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। ক্ষমতার পালাবদলের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হাহাকার হয়। জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেভাবেই সরকার বদল হোক, তার আগে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে সামনে আসে।
ছোট বেলায় অনেকগুলো প্রবাদের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম। ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য কিছু পরিচিত বাক্য দেয়া হতো। সে বাক্যগুলো ছিলো বেশ মজার। ছোট বেলার দুষ্টুমি ভরা অবসরে সে বাক্যগুলো নিয়ে নানারকম চর্চা হতো। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’ এমন বাংলার ইংরেজি কি হবে তা নিয়ে শিক্ষকের কানমলা খায়নি এমন বালক খুবই কমই ছিলো আমাদের সময়। সেসময় বিভিন্ন প্রবাদের সঙ্গেও আমাদের পরিচিত ঘটেছিল। প্রবাদগুলোর মধ্যে আজ একটি বেশ মনে পড়ছে। প্রবাদটি হলো ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। তবে, এখন যদি কেউ প্রবাদ-প্রবচন লেখেন তাহলে লিখতে পারেন ‘অভিযান শুরু হলেই দুর্নীতিবাজরা নিখোঁজ হয়।’
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের বিবরণ দেখিয়ে জনগণ শীর্ষে উঠছে। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির বিবরণে মানুষ হতবাক। তাদের যে অঢেল সম্পদ রয়েছে সেই সম্পদের হিসেব কষতে কষতে মানুষ যেন অঙ্কই ভুলে গেছে। এরকম বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে যে, সরকারি কর্মচারী বা সরকারি চাকরি কি তাহলে সোনার হরিণ? সরকারি চাকরি পেলেই কি তাহলে আলাদিনের চেরাগ পাওয়া যায়?
দরিদ্র বাবা অর্থাভাবে সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন, অভাবের তাড়নায় সন্তানকে হাসপাতালে রেখে পালিয়েছেন মা—এমন খবর মাঝেমধ্যে আমরা গণমাধ্যমে পাই। এসব খবরে আমরা উদ্বিগ্ন হই, আতঙ্কিত হই। অনেকেই নানা টানাপোড়েনের কারণে সন্তানকে ফেলে দেন ডাস্টবিনে অথবা রেলস্টেশনে। অজ্ঞাতপরিচয় শিশুকে কুড়িয়ে পাওয়ার খবর আমাদের ব্যথিত করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিতরা তাদের প্রাণের ধন বিক্রি করে দেন বা অস্বীকার করেন। এটি একটি নির্মম বাস্তবতা। এটি হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কাম্য নয়। কিন্তু অবৈধভাবে ফুলেফেঁপে ওঠা ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও যে তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষা করার জন্য সন্তানকে অস্বীকার করেন—এ গল্প আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। মানুষ মাঝেমধ্যে অর্থলোভে পৈশাচিক, বীভৎস হয়ে যায়। তারা এত মানবিক বোধশূন্যহীন হয় যে, নিজের সন্তানকেই অস্বীকার করে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এ রকম একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম।