ইনসাইড থট

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে সম্পর্কের মূল্যায়ন

প্রকাশ: ০৪:০০ পিএম, ০৪ জুলাই, ২০২৪


Thumbnail

২০১৮ সালে আমেরিকার হাওয়ায় দ্বীপে সেমিনারে অংশগ্রহণকালে ২৫ দিন অবস্থান এবং ২০২৪-এ নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলা যায়, মহাদেশটি বিশাল এবং সেখানকার নাগরিকরা আইন মেনে চলেন, আচরণে সভ্য ও সৌজন্যবোধে অনন্য। স্ট্যাচু অব লিবার্টি-এর সামনে দাঁড়ালে গণতন্ত্রের বিশাল জয়যাত্রাকে স্মরণ করা যায়। আর এলিস আইল্যান্ডের ইমিগ্রেশন মিউজিয়ামে ঘুরলে আমেরিকায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও ক্রমবিকাশটি আবিষ্কার করা সম্ভব।আমেরিকা কেবল উন্নত রাষ্ট্র নয় সেখানকার মানবসমাজ পৃথিবীর অন্য মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণও বটে। ১৫ লক্ষ বাঙালির বসবাসের সূত্রে মহাদেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ নিবিড়।    

প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্কের উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ স্রোতের বিপরীতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের টেনশন ও ভয়ের মধ্যে ৪ঠা জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৮তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে।বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচারে ভুল বোঝাবুঝি এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় কিংবা তাদের ভূখণ্ডে অস্ত্রধারীদের হামলায় নেতিবাচক দৃশ্যপট তৈরি করলেও স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য স্মরণ করে এই মহাদেশটি এগিয়ে চলেছে। আসলে আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে অনেকগুলো তাৎপর্যবহ দিবস। মে মাসের শেষ সোমবার পালন করা হয় ‘স্মৃতি দিবস’। এই দিনে সামরিক সেবা দিতে গিয়ে যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্মরণ করা হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার পালন করা হয় ‘শ্রমিক দিবস’। ১৭ সেপ্টেম্বর ‘সংবিধান বার্ষিকী দিবস’ উদযাপিত হয়। ‘থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’ পালন করা হয় নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার। ফসল সংগ্রহ উদযাপনে এই দিবস পালন করা হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই। ‘প্রেসিডেন্ট ডে’ পালন করা হয় ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সোমবার। দিনটি পালন করা হয় জর্জ ওয়াশিংটন এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের জন্মদিন স্মরণে। ১১ নভেম্বর পালিত হয় ‘সেনা দিবস’। জানুয়ারির তৃতীয় সোমবার বেসামরিক অধিকার আন্দোলন নেতাদের অবদান স্মরণে বেসামরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে স্মরণ করা হয়।

তবে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের মতোই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসটি অত্যন্ত মর্যাদা সহকারে ও উৎসব মুখরিত পরিবেশে উদযাপিত হয়। ২৪৭ বছর আগে ১৭৭৬ সালের ২ জুলাই ইংল্যান্ডের শাসন থেকে পৃথক হওয়ার জন্য ভোট দেয় আমেরিকার দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস। এর দুইদিন পর ৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন আসে কংগ্রেসের হাত ধরে। অবশ্য ব্রিটেনের সঙ্গে পৃথক হওয়ার জন্য চূড়ান্ত স্বাক্ষর ২ আগস্টে অনুষ্ঠিত হলেও প্রত্যেক বছর ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে আমেরিকা। আসলে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ের আগে ১৩টি উপনিবেশ রাজ্য একসঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে।

২.

আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধ ১৭৭৫ সালে শুরু হয়ে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলে। ১৭৭৫ সালে বিপ্লবী যুদ্ধের শুরু হয় ব্রিটিশ বাহিনী ও উপনিবেশের স্থানীয় সশস্ত্র বাসিন্দাদের মধ্যে একটি ছোট খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে। খণ্ডযুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল। এই যুদ্ধের ফলে অন্যান্য স্থানেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে ২৫০ জনের বেশি ব্রিটিশ সেনা হতাহত হয়, আর আমেরিকানরা হারায় ৯৩ জন বিপ্লবীকে। এর মধ্যে ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করার জন্য বৃহৎ আকারে সেনা সমবেত করে। মার্কিন বিদ্রোহী সেনাদের বিরুদ্ধে তারা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। এরপর ১৩ টি ব্রিটিশ কলোনির স্বাধীনচেতা মানুষেরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তারা স্বাধীনতার দাবিতে অস্ত্র হাতে নিবে। উপনিবেশগুলো হলো নিউ হ্যামশায়ার, ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলেয়ার, ম্যারিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়া। ১৭৭৬ সালের ২ জুলাই তারা সম্মিলিতভাবে ‘ইউনাইটেড অফ স্টেটস’ নামের দেশের ঘোষণা দেয়। ৪ জুলাই এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। ফ্রান্স, স্পেন ও ডাচ প্রজাতন্ত্র ১৭৭৬ সালের শুরুতে গোপনে বিপ্লবীদের রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। স্পেন স্থল ও নৌ ক্ষেত্রে মার্কিনিদের সহায়তা দিয়েু ব্রিটিশদের উত্তর আমেরিকা থেকে হটিয়ে দেয়। ১৭৮১ সালে ব্রিটিশরা ভার্জিনিয়া দখলের চেষ্টা চালায় কিন্তু ফরাসি নৌ বিজয়ের ফলে ফরাসি আমেরিকানরা ইয়র্কটাউন অবরোধ করে। এতে ৭০০০ এর বেশি ব্রিটিশ সৈনিককে বন্দি করা হয়। তার ফলে যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের ইচ্ছায় পরিবর্তন আসে। ১৭৮২ সাল পর্যন্ত সীমিত আকারে লড়াই চলতে থাকে। ১৭৮৩ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় পাওয়ার জন্য ২৫ হাজার বিপ্লবী আমেরিকানকে জীবন দিতে হয়। একইসঙ্গে ২৭ হাজার ব্রিটিশ ও জার্মান সেনার মৃত্যু ঘটে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভার্জিনিয়া উপনিবেশের জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন (আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট ১৭৮৯-১৭৯৭) ছিলেন প্রধান সেনাপতি। আর কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের পাঁচজনের একটি কমিটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করেন। টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সদস্য। টমাস জেফারসন ছিলেন মূল লেখক। রচিত ঘোষণাপত্রটি নিয়ে কংগ্রেসে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং পরিশেষে সেটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

‘প্রতিটি মানুষই সমান এবং একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বাণী রচিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিভিন্ন দেশের আরো অনেক সমশ্রেণির দলিল প্রণয়নে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং এর ধারণাসমূহ পরবর্তী সময়ে ক্যারিবিয়ান, স্প্যানিশ আমেরিকা, বলকান, পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত অনুসৃত হয়। অন্যদিকে আমেরিকার ইতিহাস থেকে বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদের শুধরে নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথা বাতিল করেন, ১৮৭০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার এবং ১৯২০ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের দিকে কালো লোকদের ভাল স্কুলে যাওয়ার, ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ও বাসে বসার অধিকার ছিল না। মার্টিন লুথার কিংয়ের আন্দোলনের ফলে তারা সব অধিকার লাভ করে। এসব ঘটনা বিশ্ববাসীকে মানুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।

৩.

২৪৮ বছরে উপনীত হয়ে স্বাধীনতা দিবসটি উদযাপনে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এসেছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জোয়ারে পুরানো অনেক কিছুই এখনো বহাল রয়েছে। সপ্তাহজুড়ে প্যারেডগুলো সম্পন্ন হয় সকালে, সন্ধ্যায় হয় আতশবাজি আর পারিবারিক পুনর্মিলনী; রাত্রি জেগে ওঠে সংগীতের মূর্ছনায়। কোনো কোনো শহরে সুউচ্চ টাওয়ার থেকে আলোক কিরণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রীষ্মের বাতাসে। দিবসটিতে আপনি শুনতে পাবেন দেশাত্মবোধক গান আর জাতীয় সংগীত, ‘গড ব্লেস আমেরিকা’, ‘আমেরিকা বিউটিফুল’, ‘দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড’ স্লোগান। কখনো বা প্রত্যন্ত অঙ্গরাজ্যের লোকায়ত সুরে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণাকালে ছিল ১৩টি রাষ্ট্র; বর্তমানে আমেরিকার স্টেট ৫০টি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ; যার জনসংখ্যা ৩২ কোটি ৫০ লাখের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্ব, দক্ষিণ, মধ্যপশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলগুলোর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য এবং রীতি। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ইংরেজরা। ব্রিটিশরা ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই সেখানে উপনিবেশ গড়ে তুলতে থাকে। এছাড়া স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (রেড ইন্ডিয়ান), ল্যাটিন আমেরিকান, আফ্রিকান এবং এশিয়ানরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে।

আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে কেন্দ্র থেকে প্রতিটি প্রান্ত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে থাকে ব্যস্ত। বছরের এ মাসে হয়ত একটানা তিনদিন ছুটি থাকে কিংবা গ্রীষ্মাবকাশ শুরু হয়। ১৭৭৯ সালের ৪ জুলাই ছিল রবিবার। এজন্য ৫ জুলাই ছুটি দেয়া হয়। ১৭৮১ সালের সর্বপ্রথম দিবসটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। অন্যদিকে দিবসটিতে ১৭৮৩ সালে নর্থ ক্যারোলিনায় যে সংগীতানুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল তা এখন পর্যন্ত প্রচলিত আছে। ১৮৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস দিবসটিতে বিনাবেতনে ছুটি মঞ্জুর শুরু করলেও ১৯৩৮ সালে সেটি প্রত্যাহার করে বেতনসহ দিবসটিতে ছুটি কার্যকর করা হয়। স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে উৎসবের নানামাত্রা।

এই দিবসে প্রায় চার কোটি ৮০ লাখ আমেরিকান নিজের বাড়ি থেকে শত মাইল দূরত্ব ভ্রমণ করে। স্বাধীনতা দিবসের ছুটির সঙ্গে আরো কিছু দিন ছুটির ব্যবস্থা করে নিয়ে পুরো ফ্যামিলিসহ ট্রেন, প্লেন বা অটোমোবাইল যোগে অন্যান্য স্টেটের দর্শনীয় বস্তুগুলো, যেমন নায়াগ্রা জলপ্রপাত, ডিজনি, ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক, স্যান্ডিয়েগো জু, সাউথ ডাকোটার মাউন্ট রাশমোর, হাওয়াই দ্বীপ, আলাস্কা ইত্যাদি দেখতে বের হয়। কেউ কেউ অন্যান্য দেশ যেমন, কানাডা, মেক্সিকো, ইউরোপ প্রভৃতি ভ্রমণ করে। অনেকে সাউথ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ব্রাজিলও যায়। অতি উৎসাহীরা আফ্রিকাতেও ঢুঁ মেরে আসে। বাচ্চাদের স্কুলের ছুটি থাকায় এ সময় অনেকে সপরিবারে তাদের নিজেদের আদি দেশ যথা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর, ফিলিপাইন ইত্যাদি বেড়িয়ে আসে। অনেকে স্থানীয় সিক্স ফ্ল্যাগ, সি ওয়ার্ল্ড, লোকাল জু, মিউজিয়াম দেখতে যায়। আবার কেউ কেউ অনেক দিন ধরে সরিয়ে রাখা নিজেদের বাড়ির বিভিন্ন অংশের বকেয়া মেরামত, পেইন্টিং, ডেক, রুম এডিশন, বেসমেন্ট ফিনিশিং ইত্যাদি কাজগুলো সম্পন্ন করে। সারা বছরের সবচেয়ে প্রত্যাশিত ছুটির দিনগুলোর মধ্যে ৪ জুলাইয়ের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষের ছুটির মৌসুমটি বলতে গেলে সবচেয়ে আনন্দঘন ও কর্মবহুল।

৪.

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা সরকারের নতুন পথযাত্রাকে সামনে রেখে আমেরিকা-বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরা দরকার।মনে রাখা দরকার, বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট মারফতে পাওয়া বিবরণ দিয়ে শেখ হাসিনার শাসনকালকে মূল্যায়ন করা হলে তা বিভ্রান্তির জন্ম দিবে। বরং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকালে কিংবা এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বিবেচনায় নিলে উন্নয়নশীল এই দেশটির মহিমান্বিত রূপ উন্মোচন করা সম্ভব হবে।এজন্য আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে গৌরবান্বিত একটি দেশ। যেমন ব্রিটিশদের কাছ থেকে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয় আমেরিকায় সেদিন উৎপাটিত হয়েছিল সব পরাধীনতার শৃঙ্খল, বহাল হয়েছিল বাকস্বাধীনতা, পত্রিকা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি কোনো আইন পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার স্বাধীনতা পেয়েছিল সবাই, আমেরিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ, তেমনি পরিস্থিতি আজ বাংলাদেশেও বিদ্যমান। অর্থাৎ নিজেকে প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন তথা গোটা মিডিয়ার যে স্বাধীনতা তাও স্বীকৃতি পেয়েছে শেখ হাসিনার শাসনকালে।এখন বাংলাদেশের যে কোনো ব্যক্তি জানেন ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কাউকে বাধ্য বা নিষেধ করবে না। যে যার ধর্ম পালন করবে। নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও একমাত্র শান্তির ভূমি। প্রায় আড়াই’শ বছর ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ আমেরিকায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে চলেছে যেমনটি গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশের অবস্থা। এজন্য নির্বাচনে জয়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হয় এরকম-‘আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। ...আমি এজন্য এসেছি যেন আমরা একসঙ্গে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই আমেরিকাকে গ্রেট করার জন্য কাজ করবো।’ বক্তব্যের এই স্পিরিট এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে।একই ধরনের চেতনা রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও।এজন্য বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সবসময়ের জন্য প্রশংসনীয়।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,


যুক্তরাষ্ট   স্বাধীনত দিবস   সম্পর্কের মূল্যায়ন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলার আত্মত্যাগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে ধাবিত করেছিল


Thumbnail

৪ঠা জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। ১৭৭৬ সালের এই দিনে আমেরিকার মহাদেশীয় ১৩টি উপনিবেশের নেতারা ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ১৭৭৭ সালের এই দিনে বোস্টন এবং ফিলাডেলফিয়ায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়।  

আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল কারণ তারা যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে কর বৃদ্ধি করে। ১৭৬০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৭৭০ এর দশকের প্রথম দিকে, ব্রিটিশদের দুটি যুদ্ধ করতে হয়েছিল, একটি পূর্ব বাংলায় এবং অন্যটি পশ্চিমে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের বিরুদ্ধে। দুটি যুদ্ধ চালানোর জন্য, ব্রিটিশ সরকার তহবিল পরিচালনার জন্য গুরুতর চাপের সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে, উপনিবেশগুলোতে কর বৃদ্ধি করে তারা। কিন্তু, আমেরিকান উপনিবেশের নেতারা অতিরিক্ত ট্যাক্স মেনে নিতে পারেনি, তাই তারা "প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোনো কর নয়" শিরোনামে আন্দোলন শুরু করেছিল। 

যেহেতু ব্রিটিশরা দুটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে অসুবিধায় পড়েছিল, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তার মন্ত্রিসভাকে যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য একটি সমাধান নিয়ে আসতে বলেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিটকে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশকে স্বাধীনতা প্রদান এবং বাংলায় তাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার সুপারিশ করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল যে সেই সময়ে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ক্যারিবিয়ান এবং কানাডার মিলিত অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করছিল। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ কোষাগার ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ক্যারিবিয়ান এবং কানাডা থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং রাজস্ব পেয়ে আসছিল। এর বিপরীতে, তারা বাংলা থেকে ১০০ গুণ বেশি রাজস্ব, বার্ষিক প্রায় ৪০,০০০,০০০ (৪০ মিলিয়ন) পাউন্ড স্টার্লিং পেয়েছিলেন। তাই, প্রধানমন্ত্রী ১৭৭৬ সালে আমেরিকান উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা প্রদান এবং বাংলায় তাদের পরাধীনতা তীব্র করার সিদ্ধান্ত নেন। 

আমেরিকানরা প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিটকে লোহার বিখ্যাত শিল্প শহর পিটসবার্গের নাম দিয়ে সম্মানিত করেছিল।  বিখ্যাত মার্কিন পণ্ডিত, এশিয়া ফাউন্ডেশনের জেমস নোভাক ১৯৯৩ সালে নিজের দেয়া এক মতামতে জানান, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলার আত্মত্যাগের ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা এসেছে।  

প্রায় ২০০ বছর পর, ১৯৭১ সালে, যখন বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন আমেরিকার আইন প্রণেতা, সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান, আমেরিকান পণ্ডিত, অধ্যাপক, ডাক্তার, আমেরিকান কূটনীতিকসহ বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। ঢাকায় অবস্থানরত আমেরিকান কূটনীতিক আর্থার কে. ব্লাড এবং তার সহকর্মীরা পাকিস্তানি গণহত্যা ও নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে মার্কিন সরকারের কাছে তার বিখ্যাত ব্লাড টেলিগ্রাম পাঠান।  হার্ভার্ডের অধ্যাপক জন এডওয়ার্ড ম্যাসন, প্রফেসর মার্গ্লিন এবং ডেভিড ডরফম্যান প্লাস প্রফেসর হানা এবং গাস পাপানেক, যারা পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তারাও ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বলেছিলেন, "স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে একটি বাস্তবতা।" প্রশ্ন হলো, কী মূল্যে, আর কত প্রাণের মূল্যে। 

জনপ্রিয় মার্কিন গায়ক এবং সঙ্গীতজ্ঞ জন হ্যারিসন, জোয়ান বায়েজ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, এবং অন্যান্য জনসচেতনতা বাড়াতে এবং শরণার্থীদের জন্য তহবিল বাড়ানোর জন্য নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার বাগানে একটি বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে। হাজারো মানুষের প্রতিধ্বনি তাদের, বাংলাদেশ, হে! বাংলাদেশ। 

যদিও নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন অনড় ছিল এবং তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশে) গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সমর্থন দেয়। মার্কিন আইন প্রণেতারা যেমন সেনেটর এডওয়ার্ড এম.কেনেডি, সেন সেক্সবে, সেনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল, রিচার্ড রিড, কংগ্রেসম্যান গ্যালাঘের, এবং অন্যান্যরা পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের চালান আটকানোর জন্য একের পর এক বিল এনেছেন। বাল্টিমোর এবং ফিলাডেলফিয়ার লংশোর পুরুষ ও মহিলারা তাদের শতাধিক ছোট নৌকা এবং ছাউনি নিয়ে পাকিস্তানের জন্য অস্ত্র বোঝাই জাহাজের পথ বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা তাদের জন্য গর্বিত। আমরা তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।

সুসংবাদটি হল, যদিও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল কিন্তু এরপরও  আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় লাভ করি। পরবর্তীতে মার্কিন সরকার শীঘ্রই আমাদের স্বীকৃতি দেয়। তারা ১৬ বারের মধ্যে ১৬বারই জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমাদের বিডকে সমর্থন করেছিল (একবার বিরত ছিল)। শুধু তাই নয়, আমাদের স্বাধীনতার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দাতা। এখন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী, এবং তারা আমাদের আরএমজির বৃহত্তম আমদানিকারক এবং সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। আমরা আমেরিকানদের মতোই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্ম, বাক ও মিডিয়ার স্বাধীনতার একই মূল্যবোধ এবং নীতিগুলি ভাগ করি। বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ প্রাণ দিয়েছে। 

আমেরিকানরা যখন ৪ঠা জুলাই তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে, তখর আমরাও আরও ভাল, আরও মানবিক, এবং সবার জন্য আরও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের জন্য তাদের উদযাপনে যোগ দেই।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   স্বাধীনতা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

সাহসিনীর বিদ্রোহ ও পদ্মা সেতু


Thumbnail

নির্মাণ শৈলীর অপূর্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত একটি সেতু দিয়ে ২০২২ সাল থেকে পদ্মা নদী পারাপারের অধিকার অর্জন করেছে বাঙালি জাতি যা ইতিহাসের অংশ হলেও মূলত একটি বিদ্রোহের ফসল। পুঁজিবাদের দেশি-বিদেশি অর্থনৈতিক প্রভু ও আন্তর্জাতিক পুঁজির তাঁবেদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ করেছিলেন শেখ হাসিনা। গুটি কয় অসাধু মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের সকল মানুষ শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। কেউ তাঁকে টলাতে পারেনি, এমনকি সাজানো, উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা কলঙ্কও দিয়েও নয়।

পঞ্চাশ বছর আগে সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করা এই সার্বভৌম বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন ইতিবাচক উন্নয়ন চক্রের আসনে কেবল বসেছে তখন একটি মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্ক চাপিয়ে দিল সে দেশের প্রধানমন্ত্রী যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তাঁর পরিবারের নানা স্তরের সদস্য, তাঁর সরকারের সহায়ক নানা পর্যায়ের পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে। কোন অভিযোগ শেষ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারেনি এমনকি আদালতে যেয়েও অভিযোগের মামলা খারিজের দায় নিয়ে সটকে পড়েছে, কিন্তু সাহসিনী বিদ্রোহী শেখ হাসিনা ছেড়ে দেননি। দুর্মুখের মুখে এঁটে দিয়েছেন পরাজয়ের কলঙ্ক টিকা, যা পরাজিত পুঁজিবাদী সমাজের নিয়ন্ত্রকদের যুগ যুগ ধরে বহন করে যেতে হবে ও আর কোনদিন তা মুছে ফেলার ক্ষমতাও তাদের হাতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। কারণ ‘বিদ্রোহী শেখ হাসিনা’ তাঁর দেশের সকল মানুষদের ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করে কারো কাছে হাত না পেতে নিজের দেশের টাকায় ‘পদ্মা সেতু’ গড়ে ফেলেছেন।

ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুকে একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সারা দুনিয়ার মোড়লেরা মিলেও তাঁকে থামাতে পারেনি। বাংলার ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার ব্রত’ একটি আন্তর্জাতিক অন্যায় হয়ে গেল! জেল-জুলুম আর একই রকম মিথ্যা কলঙ্ক, কী করে নাই সে চক্র? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবিচল একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে হলেও নিজের স্বাধিকার অর্জন করে নিজেই দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- সে অপমান আর পরাজয় বিরুদ্ধবাদী সমাজের এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ফলে পদ্মা সেতু যখন অনিবার্য প্রকল্প হলো তখন পরাজিত দেশি- বিদেশি সেই ‘পুরনো শকুনেরা’ সুযোগ নিতে চাইলো। পুঁজিবাদী সেইসব বিশ্ব মোড়লেরাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আবার এক হয়ে গেল কিন্তু সাহসিনীর নেতৃত্বের কাছে পরাস্ত হলো। ২৫ জুন ২০২২ বাংলাদেশের মানুষ মাতৃসমা পদ্মা নদীর বক্ষ চিরে ঠাই দেয়া সেতু পারাপারের অধিকার অর্জনের স্বাধীনতা উপভোগ করবে।

বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন পরিসীমা অর্জনের ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই এই লক্ষ্য অর্জনের সফল প্রক্রিয়া শুরু হয়। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষমতার পরিচয় দিতে শুরু করে। ২০১৫ সালে এমডিজি সূচক মূল্যায়ন করে পরের ধাপে এসডিজি- সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা অর্জনেও ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে ভালো করবে সেসবের লক্ষণ নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের হিসাব নিকাশ চলছিল। এর সাথে ছিল রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে কেমন করে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখা যায় সে সবের হিসাবও। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে, বিরুদ্ধবাদী অক্ষ শক্তি ২০০৯ সালেই তা টের পেয়েছিল। ফলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়, তীরবিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রথমে শেখ হাসিনার ঘর থেকেই, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের জড়িয়ে নানারকম মিথ্যাচার করে শেখ হাসিনার মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়। এরা জানে এই পরিবারের শক্তি সম্পর্কে তাই তাঁদের দুর্বল করার উদ্যোগ নিয়ে একে একে মন্ত্রী পরিষদের কোন কোন সদস্য, প্রশাসনের নিবেদিতপ্রাণ অফিসারদের ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে তাঁদের সর্বোপরি পুরো সরকারের মনোবলই দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়।

ইতিহাসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে এই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগ্রামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু পরিবার। মুক্তিযুদ্ধে এদের অংশগ্রহণ ও ত্যাগের বিবরণ অনুসরণীয়। বাঙালি মাত্রেই জানেন ১৯৭৫ সালের নির্মম পৈশাচিকতায় বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই ১৯জন সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছিল। নানা সময়ে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করার কাহিনী সুবিদিত। এই পরিবারের শক্তিকে ভয় পাবার প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা, যারা দুই পর্বে এই দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সুফল দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুত ও তা বাস্তবায়ন করেছেন। নেতৃত্ব শক্তিকে পৈশাচিক প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করতে পারার প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকা কোন কালেই ইতিহাসে ছিল না। মানুষের মুক্তির সংগ্রামের এই দুই দিশারীর পরিবারকে কলঙ্কিত ও নির্মূল করার এই প্রচেষ্টা খুবই সুপরিকল্পিত ছিল যা ‘৭৫ সালের ঘটনাবলীর সাথে মিলে যায়।

অপরদিকে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পরিষদের একজন সুপরিচিত, সৎ ও নির্মল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ড. মসিউর রহমান সততার শর্ত ভঙ্গ করেছেন মর্মে নানারকম কলঙ্ক চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হলো খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকেই আর এতে যোগ দিল দেশের ভেতরের অক্ষ শক্তির কিছু তাঁবেদার তথাকথিত সুশীল সমাজ। ভুল যুক্তির ফলে বলি দেয়া হল একজন মন্ত্রী ও সেতু বিভাগের সচিবকে। কিন্তু অটল শেখ হাসিনা কি তাঁর বিদ্রোহে সামান্য বিরতি দিয়েছেন? দেননি, আর সে কারণেই দেশ-বিদেশের সকল নেতিবাচক প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, পদ্মা সেতু আলোর মুখ দেখেছে।

ভারতবর্ষের, এমনকি বিশ্ব ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যতগুলো বিদ্রোহের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, শেখ হাসিনার এই বিদ্রোহের কথাও সেখানে লিখিত থাকবে। সে বিদ্রোহের ইতিহাস পাঠ করে জগতের মানুষ চিরকাল ন্যায়ের পক্ষে থাকার অনুপ্রেরণা পাবে।



পদ্মা সেতু   সাহসীনির বিদ্রোহ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সততার অনন্য দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতু


Thumbnail

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা হচ্ছে আজ। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গর্বের এবং অহংকারের। এই প্রক্রিয়ায় যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অবশ্যই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান ব্যক্তি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন পদ্মা সেতু বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর একটি লেখা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে আজকে এটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।

একটি সেতু শুধু দুটি বিচ্ছিন্ন এলাকাকেই যুক্ত করে করে না; সেই সঙ্গে গড়ে দেয় একটি জনপদের ভবিষ্যৎ, দেখায় সীমাহীন স্বপ্ন। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল পদ্মা সেতু যেন এর চেয়েও বেশি কিছু। অযথা ও কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী ঋণচুক্তি বাতিল করে নিলে একক নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো নির্মাণ করে রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর মধ্য দিয়েই তিনি উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে বার্তা দিয়ে বোঝালেন— এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়, সততা, একাগ্রতা এবং জনগণের ওপর অগাধ আস্থা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে তাঁকে প্রতিটি স্তরে সাহস যুগিয়েছে। তিনি জানেন কীভাবে শুদ্ধাচারের পথ অনুসরণ করে বড় বড় প্রজেক্টের কাজ ত্বরান্বিত করা যায়। তাই তো বিশ্ব দরবারে পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। নামকরণে ‘পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বিভীষণ’-এর যথার্থতা এ কারণেই যে, এই বিভীষণের মাস্টারমাইন্ড ও সেতুর অর্থায়ন বাতিলের মূল হোতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতিবাচক নানা ভূমিকার কথা এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২৮-০৪-২০১১ থেকে ০৬-০৬-২০১১ তারিখের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে পদ্মা সেতু ইস্যুতে ঋণচুক্তিসমূহ সম্পাদিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২৯-০৬- ২০১২ তারিখে কাল্পনিক, অমূলক ও ভিত্তিহীন দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ এনে এই ঋণচুক্তিসমূহ বাতিল করা হয়। ঠিক এর ১০ দিনের মাথায় ৯ জুলাই ২০১২ তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে যখন অশুভ শক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের মর্যাদা মাটির সাথে মেশাতে উদ্যত হয়েছিল, ঠিক তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের তর্জনী আরেকবার কন্যা শেখ হাসিনার তর্জনীতে ভর করে রুখে দিয়েছিলো সেই উদ্ধত ষড়যন্ত্রের কালো হাত। সেই তর্জনীর দেখানো পথেই শেখ হাসিনা তাঁর সততা, আত্মবিশ্বাস, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে গড়লেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

ব্রিটেনের স্বনামধন্য লেখক ডগলাস এভ্রেট তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,“There are some people who live in a dream world, and there are some who face reality; and then there are those who turn one into the other.” যার বাংলা অর্থ এমন— “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে।” আমাদের সেই বিজয়ের স্বপ্ন দেখানো মানুষটিই হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ ছিল। যথা— মূল সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদী শাসন এবং পরামর্শক নিয়োগ। মূল সেতু প্রাক যোগ্যতা নির্ধারণ প্রক্রিয়া ১১টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্য বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। ডিজাইনের আংশিক পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পুনরায় দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী কার্যক্রম শেষে দেখা যায়, পূর্বের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পুনরায় দরপত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়।

এই প্রক্রিয়া চলাকালীন অযোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর প্রাকযোগ্যতা দরপত্র বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পুনর্বিবেচনার পরামর্শ থাকায় মূল্যায়ন কমিটি অনুরোধটি আমলে নিয়ে পরপর দু’বার প্রতিষ্ঠানটিকে সুযোগ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতা নির্ধারণে প্রকৌশলীদের যে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিবরণ দিয়েছিল; তা যাচাইকালে ভুল ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞতার কথা বলে তারা যে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তার প্রমাণ আদতে তাদের কাছে ছিলই না। সেতু নির্মাণে মূল্যবান উপাদান হ্যামারের যে বর্ণনা তারা দিয়েছিল, তা অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সানফ্রান্সিসকোতে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে যাচাইকালে ধরা পড়ে। এই অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে তারা সদুত্তরও দিতে পারেনি; বিধায় তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অবশেষে তারা প্রাকযোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজেন্সিশিপ বাতিল করে দেয়। এতে রাগান্বিত হয়ে উক্ত কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকে ‘ভবিষ্যতে খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে’— এই হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।

পরবর্তীতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ে ফিফটিন গ্রুপ কর্পোরেশনের বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদেরকে ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ নিয়োগ দেয়া শর্তে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কথিত চিঠির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, এ ধরনের কোনো পত্র তারা পাননি এবং হেলাল উদ্দিনের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো পত্রও প্রেরণ করেননি। হেলাল উদ্দিন জানান, তার কাছে মূলকপি নেই; পত্রটি তিনি মেইলযোগে পেয়েছেন। তবুও তিনি কথিত প্রাপ্ত কপি জমা দেননি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে বারবার তল্লাশি চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল অর্থাৎ চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশন পত্রের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিস্মিত হয়। পত্রের কপি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সৃজিত প্যাডে সাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে পত্রটি তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগের সমর্থনে কোনো দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য না থাকায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।

এই অধ্যায় শেষ হতে না হতেই বিশ্বব্যাংক থেকে অভিযোগ করা হয়— পরামর্শক নিয়োগ পক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি অভিনব অভিযোগ। কেননা দুর্নীতির জন্য কখনও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয় না।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টির স্বার্থে দুদক যখন এটা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়; ঠিক তখনই বিশ্বব্যাংক জানায়, তাদের একটি তদন্ত দল দুদক তদন্ত দলের সঙ্গে একীভূত হয়ে কাজ করতে চায়। কিন্তু বিদেশস্থ কোনো তদন্ত সংস্থার সঙ্গে দুদকের কাজ করার সুযোগ আইনত না থাকায় আমরা অপারগতা প্রকাশ করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুদককে লজিস্টিক, প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে সহায়তার কথা জানায়। দুদক এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। এর প্রেক্ষিতেই আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর লুইস মোরেনো ওকাম্পো, যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান ও হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টংকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি এক্সপার্ট প্যানেল তৈরি করে।

বিশ্বব্যাংকের উক্ত তদন্ত দল ঢাকায় আসার প্রাক্কালেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পক্ষ থেকে আমাকে একদিন তার বাসায় সৌজন্য সাক্ষাতের কথা বলা হয়। আমি বিষয়বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেই সময়মতো সেখানে পৌঁছালে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী আমাকে স্বাগত জানান। আলোচনাকালে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। মাননীয় মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের বিষয়ে তার নেতিবাচক ধারনার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার অর্থ ছাড়া এই সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি এ-ও বলেন, দুদক বিশেষত আমি সহায়তা করলে বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠীদের কাছ থেকে পুনঃঅর্থ পাওয়া সম্ভব; সংস্থাগুলো তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয় বলেন, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বৈরি শক্তিকে পুনঃঅর্থায়নের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে দুদককে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমি উক্ত কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী মহোদয় স্পষ্টতই বলেন, বিশ্বব্যাংকের টিম আসার আগেই সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী আবুল হোসেনকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করাতে হবে। এ সময় আরও দুই-একজনকে গ্রেফতারের কথা বলে তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যেই মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদায় আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক চায়— আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পাশাপাশি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে অভিযান চালাতে হবে এবং এমএলএআর ভিত্তিতে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা স্থানান্তরের গতিবিধি জানা প্রয়োজন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে চার মাসের ছুটিতে পাঠানোর জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। কেননা তিনি দায়িত্ব পালনরত থাকলে তদন্তে তা প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে। আমি বিস্মিত হয়ে বলি— দুদকের সামনে এই মুহূর্তে এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, আইনেরও কোনো ভিত্তি নেই; যার ওপর নির্ভর করে এই কার্যক্রম চালাতে পারি। তখন তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সহজেই পুনঃঅর্থায়নের পথ বন্ধ হোক কিংবা পদ্মা সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হোক— আপনি কি সেটা চান? আমি উত্তরে বলি— ‘বেআইনী কোনো কাজে শুধু বিশ্বব্যাংকের অযাচিত অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়’। আমার আরও দুজন সহকর্মী আছেন, তাদের সঙ্গে আপনারা পরামর্শ করতে পারেন। তারা জানান, ‘আমরা তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই পরামর্শ করেছি।’ আমি উত্তরে বলি— মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের যে ঘোষণা দিয়েছেন; আমি তার সঙ্গে একমত। অপমানিত হয়ে কোনো দাতাসংস্থার কাছে অর্থ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমি অংশীদার হতে পারি না। আমার এই অপারগতার কারণে তারা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বলে মনে হয়।

এরই মধ্যে মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের ক্রমানুসারে এসএনসি-লাভালিন, কানাডা প্রথম; হেলকো গ্রুপ, ইউকে দ্বিতীয়; হাইপয়েন্ট রেন্ডার, ইউকে তৃতীয়; একোমনিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ওরিয়েন্ডেট কনসালটেন্ট ৫ম স্থানে নির্ধারিত হয়। ১০০ নম্বরের মধ্যে ০.০২৫ নম্বর বেশি পেয়ে কানাডার কোম্পানি এসএনসি লাভালিন প্রথম থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের কার্যাদেশের সুপারিশ করে। কিন্তু দুদক টিম জানতে পারে, বিশ্বব্যাংক এই কোম্পানিকে কাজের বিষয়ে সম্মতি দেয়নি। এখানে বলে রাখা দরকার— মূল্যায়ন কমিটিতে বিশ্বব্যাংকের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ড. দাউদ নামীয় ওই ব্যক্তি ছিলেন প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানান, পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিনকে নির্বাচন বিশ্বব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই করা হয়েছে।

এরই মধ্যে তথ্য পাওয়া যায়, এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার ওন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসে বিশ্বব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে ঘুষ প্রদানের ইচ্ছে-পোষন ও কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখার অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানে এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা যথাক্রমে বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ইসমাইল ও ভারতীয় বংশোদ্ভুত রমেশের ঘুষ গ্রহণের ইচ্ছে পোষণমূলক অনৈতিক কাজের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। তথ্যে আরও বলা হয়, রমেশ সাহার কাছে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে, যেখানে বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পদ্মা সেতু প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজনসহ আরও কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদেরকে প্রভাবিত করতে অর্থ খরচের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়। আমরা বিশ্বব্যাংককে রমেশ সাহা এবং তার ডায়েরি ও সংশ্লিষ্ট সাক্ষীগণের সাক্ষ্য প্রেরণের অনুরোধ করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক পত্রের উত্তর না দিয়ে একটি রেফারেল রিপোর্ট পাঠায়, যেখানে বর্ণিত বক্তব্যসমূহের সমর্থনে সাক্ষ্যের অভাব ছিল। আমরা মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট তথা এমএলএআর পদ্ধতিতে কানাডা সরকারের মাধ্যমে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ ও কানাডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কাছে তথ্য চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা আমাদের কাছে তথ্য পাঠায়নি। এমন অবস্থায় লুইস ওকাম্পো’র নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকের একটি এক্সপার্ট টিম বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনাকালে পরবর্তীতে তথ্য দেবে মর্মে গ্রেফতার, রিমান্ড ও কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিড়াপীড়ি করতে থাকে। তারা বলেন, সাকো কোম্পানীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করে এমএলএআর-এর মাধ্যমে তথ্য জানতে চাইলে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশের বিভিন্ন স্থানে যথা লন্ডন, কানাডা, আমেরিকাসহ আরও অন্যান্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া যাবে। তাদের বিশ্বাস—এই অর্থ বিদেশে লেনদেন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আনীত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় আমরা সাক্ষ্য- প্রমাণ ছাড়া এসব বিষয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় বলে জানালে বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম ক্ষিপ্ত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। পরে অনুরোধ করে তাদেরকে নিবৃত করা হয়। আমাদের অনুরোধে তারা কথা দেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা রমেশ সাহার ডায়েরিসহ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে পুনরায় মিলিত হবেন।

আমরা স্ব-উদ্যোগে কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছ থেকে কোনো প্রমাণ/নোটপ্যাড সংগ্রহ করতে না পারায় তৎকালীন মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হক ও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাডায় পাঠাই। প্রথমবার কোনো তথ্য না পেলেও দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিস থেকে সংগৃহীত সাক্ষ্যের ট্রান্সক্রিপ্ট পর্যালোচনা করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি; যাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতি বা ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রাপ্ত তথ্য গোপনে রাখা অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম পুনরায় বাংলাদেশে আসে এবং দুদকের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। দুই দিনব্যাপী আলোচনার প্রথম দিনে নৈশভোজ চলাকালীন লুইস ওকাম্পো ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈরি সম্পর্ক কেন— তাও জিজ্ঞেস করেন ওকাম্পো। একথাও বলেন, এই বৈরিতা নিরসন হলে সকল জটিলতার অবসান হবে বলে তার বিশ্বাস। আমি তাকে জানাই, নির্ধারিত বয়স উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং আইনের বিধান মত যোগ্য না হওয়ায় তাকে পদ ছাড়তে হয়েছে। ড. ইউনূস উচ্চ আদালতে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু তিনি বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল এমডি পদে বহাল ছিলেন। এ কথা বলার পর ওকাম্পো স্তম্ভিত হন এবং এ বিষয়ে আর কথা বাড়াননি।

তার সঙ্গে কথোপকথনে বিশ্বব্যাংকর ঋণচুক্তি বাতিলে ও কথিত দুর্নীতি অভিযোগ উত্থাপনে ড. ইউনূসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনুমিত হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রেরিত কয়েকটি ই-মেইল; যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক বিষয়বস্তু প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পাঠায়। সেই ই-ইমেইলের সেন্ডার নামটি ঘষামাঝা করে দেয় বিশ্বব্যাংক। ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছে এবং এখানে অর্থায়ন করা সঙ্গত হবে না’— ই-মেইল পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের কাছে ই-মেইলসমূহ যে ড. ইউনূসই পাঠিয়েছে, ওকাম্পের কথা ও উপরোক্ত ঘটনাসমূহ সেটাই সমর্থন করে।

এর আগে অবশ্য দুদকের গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত দু’জন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে আমরা জানতে পারি, আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনে মিলিত হওয়ার আগে তারা স্থানীয় প্রতিনিধি গোল্ড স্ট্যানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে বসেছিলেন। সেখানে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি তথা আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো’র মতিউর রহমান, আইনজীবী ব্যারিস্টার মঞ্জুর হোসেনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন এবং তারা এক্সপার্ট টিমকে ব্রিফ করেছিলেন বলে জানা যায়। তাদের আলোচনায় আমি আইনের যুক্তি উত্থাপন করলে এবং দুদকের তৎকালীন মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হক সমর্থন করায় লুইস ওকাম্পো আমাকে ও আনিসুল হককে রুঢ় ভাষায় আক্রমণ করে এবং ক্ষিপ্ত হয়।

যাই হোক, দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে বিশ্বব্যাংকের টিম ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়ার কথা জানিয়ে সভা ত্যাগ করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাড়ে। তারপরও আমরা দীর্ঘসময় তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অবশেষে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় আর কোনো উপাদান না পাওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠাই। স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত কার্যক্রম শেষে ৪-০৯-২০১৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়; যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়। দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার প্রতিবেদন দাখিলে প্রায় এক বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে ফলাফলের সাথে একমত হয়ে কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিজ একই বিষয়ে তাদের কাছে প্রেরিত অভিযোগে রায় প্রদান করে। রায়ে তারা সুস্পষ্টভাবে জানায় যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগটি ছিল অসত্য এবং নেয়াহেত গালগল্প ভিন্ন অন্যকিছু নয়। উক্ত আদালতও মামলাটি খারিজ করে দেয়।

পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিশ্লেষণে এবং বিশ্বব্যাংকের সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতার কারণে এটা সহজেই অনুমিত হয় যে, তথাকথিত ঘুষ লেনদেনে অভিপ্রায় সম্বলিত অদৃশ্য নোটপ্যাড, সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের পত্র প্রেরণসহ সবকিছুই ছিল সৃজিত, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; এর পেছনে ছিল অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী তাঁর অঙ্গীকার ও ঘোষণা অনুযায়ী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার উচ্চতর আসনে আসীন করেছেন।


পদ্মা সেতু   আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম   সমাপ্ত   এক অসাধারণ যুদ্ধ জয়ের গল্প   বিশ্বব্যাংক   দুর্নীতি   প্রধানমন্ত্রী   রাষ্ট্রপতি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে


Thumbnail

আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতন হলেও কোনোভাবেই প্লাস্টিককে দূরে রাখতে পারছি না। প্লাস্টিকের ব্যাগ হয়ে উঠছে নিত্যদিনের সঙ্গী। বাজার করা, ময়লা ফেলা, শুকনো খাবার সংরক্ষণ করা, ফ্রিজে খাবার রাখাসহ বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন প্রতিটি বাড়িতে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহারের পর এসব ব্যাগ আমরা যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি।

পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি সহজলভ্য বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, মজুত, পরিবহন, বিপণন, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

প্লাস্টিক দূষণের প্রতি শূন্য-সহনশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং কম্পোষ্টিং এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর ৩রা জুলাই আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস ২০২৪ সালের  প্রতিপাদ্য ব্যক্তি, ব্যবসা এবং প্রতিষ্ঠানকে টেকসই বিকল্প গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা। প্লাস্টিক ব্যবহার এবং বর্জ্য কমাতে নীতি পরিবর্তন এবং পদ্ধতিগত সমাধানের জন্য ওকালতি করা। প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করা। আজ বিশ্বের প্রায় ১৫০০টি সংস্থা আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস উদযাপন করছে। 

প্লাস্টিক ব্যাগ পরিবেশ দূষণের একটি প্রধান উৎস। তবে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি সুবিধাজনক এবং বহুল ব্যবহৃত অংশ। এগুলো পচনশীল নয়। প্লাস্টিক বিচ্ছিন্ন হতে ৫০০ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে, মাটি ও পানিতে জমা হতে পারে, বাস্তুতন্ত্র এবং সামুদ্রিক জীবের ক্ষতি করতে পারে। প্লাস্টিক নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আটকাতে পারে, পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে এবং পানি প্রবাহকে দূষিত করতে পারে। প্লাস্টিক দূষণ ভূমির উর্বরতা হ্রাস করে, বন্যপ্রাণীর ক্ষতিসাধন করে, সামুদ্রিক কচ্ছপ, মাছ এবং তিমিসহ ৭০০টির বেশি প্লাস্টিক খায় বা এতে জট পাকিয়ে যায়।

১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের একটি রাসায়নিক প্ল্যান্টে পলিথিন তৈরি করা হয়। এটি প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহারের জন্য গোপন সামরিক গ্লাভস তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকে সুইডেন এক পিস পলিথিন শপিং ব্যাগ পেটেন্ট করেছিল। যা পরবর্তীতে ইউরোপে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কাগজ এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য ব্যাগের তুলনায় প্লাস্টিক ব্যাগের সফল বাজারজাতকরণের পর, তাদের ব্যবহার দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেট প্যাসিফিক আবর্জনা প্যাচে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন এবং আরও অনেকগুলি সামুদ্রিক জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। 

প্লাস্টিক মুক্ত জুলাই হল একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানের অংশ হতে সাহায্য করে - যাতে আমরা সুন্দর, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পরিবেশে এই গ্রহে বসবাস করতে পারি। আন্দোলনটি প্লাস্টিক দূষণ সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে এবং মানুষ, পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য গ্রহটিকে নিরাপদ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কার্যক্রম হল ক্রেতাদের কেনাকাটা করার সময় প্লাস্টিকের ব্যবহার না চাইতে এবং ব্যবহার বন্ধ করতে উৎসাহিত করা। অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, পুনরায় ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহার করা।

অনেকেই বলে থাকেন, প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প এমন কী আছে, যা সহজলভ্য এবং প্রতিদিন ব্যবহারের উপযোগী? প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসাবে পরিবেশবান্ধব টেকসই উপকরণের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। যেমন, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা, পাটের তৈরি ব্যাগ। কাগজ ও পাটের ব্যাগ পচনশীল এবং মাটিতে মিশে যায়। কাপড় ও পাটের ব্যাগ টেকসই এবং নিয়মিত পরিষ্কার করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, যা প্রতি মিনিটে প্রায় এক মিলিয়ন। প্লাস্টিক ব্যাগ বন্যপ্রাণীর জন্য বড় হুমকি। প্রাণীরা প্রায়ই প্লাস্টিকের ব্যাগকে খাবারের জন্য ভুল করে, যার ফলে শ্বাসরোধ, অনাহার এবং মৃত’্যর কারণ হতে পারে। সামুদ্রিক প্রাণীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ইউরোপিয়ান  এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি অনুসারে সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষের প্রায় ৮০% প্লাস্টিক।

প্লাস্টিকের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে ল্যান্ডফিল বর্জ্যের একটি প্রধান অবদানকারী। প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি একবারে ভেঙ্গে গেলে পচে যেতে শত শত বছর সময় নেয় বলে এই সমস্যাটি আরও জটিল। এর মানে হল যে একবার একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ফেলে দেওয়া হলে এটি সম্ভবত বহু শতাব্দী ধরে একটি ল্যান্ডফিলে বসে থাকবে, মূল্যবান স্থান দখল করবে এবং পরিবেশ দূষণে অবদান রাখবে।

প্লাস্টিকের ব্যাগ নদী, হ্রদ এবং সমুদ্র দূষণের জন্য কুখ্যাত অবদানকারী। এগুলো প্রায়শই মানুষের ডাম্পিং বা বাতাস বা পানি প্রবাহের মাধ্যমে সমুদ্রে গিয়ে শেষ হয়। পানিতে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলিতে ভেঙ্গে যায়, যা সামুদ্রিক জীব দ্বারা গৃহীত হয়, খাদ্য শৃঙ্খলেও প্রবেশ করে এবং সম্ভাব্যভাবে মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।এই দূষণ জলজ বাসস্থানকে ব্যাহত করে এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।

প্লাস্টিকের ব্যাগের উৎপাদন, পরিবহন এবং নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ঘটায়। যখন প্লাস্টিকের ব্যাগ ফেলে দেওয়া হয় এবং ভেঙ্গে যায়, তখন তা মিথেন নির্গত করে, একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও খারাপ করে তোলে। প্লাস্টিকের ব্যাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। প্লাস্টিক থেকে রাসায়নিক এবং বিষাক্ত পদার্থ খাদ্য ও পানীয়তে প্রবেশ করতে পারে, যা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক  উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ধারা ৬ক এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। 

সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ আইন দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমানে সারা দেশে পলিথিনের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর হয়তো ভুলেই গেছে যে, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং সেই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব অধিদপ্তরের। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় বর্তমানে আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা। পাশা পাশি রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব।

আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহার  হ্রাস, পুনর্ব্যবহার এবং প্লাস্টিক বর্জ্য কম্পোস্ট করার মতো সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্লাস্টিক মুক্ত আন্দোলনকে সমর্থন ও বেগবান করতে পারি। আমরা আমাদের বন্ধু এবং পরিবারকেও একই কাজে উৎসাহিত করতে পারি। এই পদক্ষেপগুলি  গ্রহণ করে  আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারি এবং একটি পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর গ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।


পলিথিন ব্যাগ   প্লাস্টিকের ব্যবহার   প্লাস্টিক দূষণ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সততার অনন্য দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতু


Thumbnail

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হচ্ছে আজ। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গর্বের এবং অহংকারের। এই প্রক্রিয়ায় যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অবশ্যই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান ব্যক্তি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন পদ্মা সেতু বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর একটি লেখা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে আজকে এটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।

একটি সেতু শুধু দুটি বিচ্ছিন্ন এলাকাকেই যুক্ত করে করে না; সেই সঙ্গে গড়ে দেয় একটি জনপদের ভবিষ্যৎ, দেখায় সীমাহীন স্বপ্ন। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল পদ্মা সেতু যেন এর চেয়েও বেশি কিছু। অযথা কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী ঋণচুক্তি বাতিল করে নিলে একক নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো নির্মাণ করে রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর মধ্য দিয়েই তিনি উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে বার্তা দিয়ে বোঝালেনএটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়, সততা, একাগ্রতা এবং জনগণের ওপর অগাধ আস্থা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে তাঁকে প্রতিটি স্তরে সাহস যুগিয়েছে। তিনি জানেন কীভাবে শুদ্ধাচারের পথ অনুসরণ করে বড় বড় প্রজেক্টের কাজ ত্বরান্বিত করা যায়। তাই তো বিশ্ব দরবারে পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। নামকরণেপদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বিভীষণ’-এর যথার্থতা কারণেই যে, এই বিভীষণের মাস্টারমাইন্ড সেতুর অর্থায়ন বাতিলের মূল হোতা . মুহাম্মদ ইউনূসের নেতিবাচক নানা ভূমিকার কথা এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২৮-০৪-২০১১ থেকে ০৬-০৬-২০১১ তারিখের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি এডিবির সঙ্গে পদ্মা সেতু ইস্যুতে ঋণচুক্তিসমূহ সম্পাদিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২৯-০৬- ২০১২ তারিখে কাল্পনিক, অমূলক ভিত্তিহীন দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ এনে এই ঋণচুক্তিসমূহ বাতিল করা হয়। ঠিক এর ১০ দিনের মাথায় জুলাই ২০১২ তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে যখন অশুভ শক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মর্যাদা মাটির সাথে মেশাতে উদ্যত হয়েছিল, ঠিক তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের তর্জনী আরেকবার কন্যা শেখ হাসিনার তর্জনীতে ভর করে রুখে দিয়েছিলো সেই উদ্ধত ষড়যন্ত্রের কালো হাত। সেই তর্জনীর দেখানো পথেই শেখ হাসিনা তাঁর সততা, আত্মবিশ্বাস, নিষ্ঠা দেশপ্রেমে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে গড়লেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

ব্রিটেনের স্বনামধন্য লেখক ডগলাস এভ্রেট তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,“There are some people who live in a dream world, and there are some who face reality; and then there are those who turn one into the other.” যার বাংলা অর্থ এমন— “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে।আমাদের সেই বিজয়ের স্বপ্ন দেখানো মানুষটিই হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ ছিল। যথামূল সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদী শাসন এবং পরামর্শক নিয়োগ। মূল সেতু প্রাক যোগ্যতা নির্ধারণ প্রক্রিয়া ১১টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্য বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। ডিজাইনের আংশিক পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পুনরায় দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী কার্যক্রম শেষে দেখা যায়, পূর্বের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পুনরায় দরপত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়।

এই প্রক্রিয়া চলাকালীন অযোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর প্রাকযোগ্যতা দরপত্র বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পুনর্বিবেচনার পরামর্শ থাকায় মূল্যায়ন কমিটি অনুরোধটি আমলে নিয়ে পরপর দুবার প্রতিষ্ঠানটিকে সুযোগ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতা নির্ধারণে প্রকৌশলীদের যে অভিজ্ঞতা যোগ্যতার বিবরণ দিয়েছিল; তা যাচাইকালে ভুল প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞতার কথা বলে তারা যে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তার প্রমাণ আদতে তাদের কাছে ছিলই না। সেতু নির্মাণে মূল্যবান উপাদান হ্যামারের যে বর্ণনা তারা দিয়েছিল, তা অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সানফ্রান্সিসকোতে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে যাচাইকালে ধরা পড়ে। এই অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে তারা সদুত্তরও দিতে পারেনি; বিধায় তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অবশেষে তারা প্রাকযোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজেন্সিশিপ বাতিল করে দেয়। এতে রাগান্বিত হয়ে উক্ত কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকেভবিষ্যতে খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে’— এই হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।

পরবর্তীতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ে ফিফটিন গ্রুপ কর্পোরেশনের বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদেরকেসাইলেন্ট এজেন্টনিয়োগ দেয়া শর্তে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কথিত চিঠির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, ধরনের কোনো পত্র তারা পাননি এবং হেলাল উদ্দিনের কাছে সংক্রান্ত কোনো পত্রও প্রেরণ করেননি। হেলাল উদ্দিন জানান, তার কাছে মূলকপি নেই; পত্রটি তিনি মেইলযোগে পেয়েছেন। তবুও তিনি কথিত প্রাপ্ত কপি জমা দেননি। বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে বারবার তল্লাশি চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল অর্থাৎ চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশন পত্রের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিস্মিত হয়। পত্রের কপি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সৃজিত প্যাডে সাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে পত্রটি তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগের সমর্থনে কোনো দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য না থাকায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।

এই অধ্যায় শেষ হতে না হতেই বিশ্বব্যাংক থেকে অভিযোগ করা হয়পরামর্শক নিয়োগ পক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি অভিনব অভিযোগ। কেননা দুর্নীতির জন্য কখনও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয় না।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টির স্বার্থে দুদক যখন এটা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়; ঠিক তখনই বিশ্বব্যাংক জানায়, তাদের একটি তদন্ত দল দুদক তদন্ত দলের সঙ্গে একীভূত হয়ে কাজ করতে চায়। কিন্তু বিদেশস্থ কোনো তদন্ত সংস্থার সঙ্গে দুদকের কাজ করার সুযোগ আইনত না থাকায় আমরা অপারগতা প্রকাশ করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুদককে লজিস্টিক, প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে সহায়তার কথা জানায়। দুদক প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। এর প্রেক্ষিতেই আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর লুইস মোরেনো ওকাম্পো, যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টংকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি এক্সপার্ট প্যানেল তৈরি করে।

বিশ্বব্যাংকের উক্ত তদন্ত দল ঢাকায় আসার প্রাক্কালেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পক্ষ থেকে আমাকে একদিন তার বাসায় সৌজন্য সাক্ষাতের কথা বলা হয়। আমি বিষয়বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেই সময়মতো সেখানে পৌঁছালে মাননীয় অর্থমন্ত্রী পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী আমাকে স্বাগত জানান। আলোচনাকালে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। মাননীয় মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের বিষয়ে তার নেতিবাচক ধারনার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাংক দাতা সংস্থার অর্থ ছাড়া এই সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি - বলেন, দুদক বিশেষত আমি সহায়তা করলে বিশ্বব্যাংক দাতাগোষ্ঠীদের কাছ থেকে পুনঃঅর্থ পাওয়া সম্ভব; সংস্থাগুলো তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয় বলেন, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বৈরি শক্তিকে পুনঃঅর্থায়নের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে দুদককে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমি উক্ত কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী মহোদয় স্পষ্টতই বলেন, বিশ্বব্যাংকের টিম আসার আগেই সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী আবুল হোসেনকে গ্রেফতার রিমান্ডে নিয়ে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করাতে হবে। সময় আরও দুই-একজনকে গ্রেফতারের কথা বলে তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যেই মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদায় আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক চায়আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পাশাপাশি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে অভিযান চালাতে হবে এবং এমএলএআর ভিত্তিতে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা স্থানান্তরের গতিবিধি জানা প্রয়োজন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা . মসিউর রহমানকে চার মাসের ছুটিতে পাঠানোর জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। কেননা তিনি দায়িত্ব পালনরত থাকলে তদন্তে তা প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে। আমি বিস্মিত হয়ে বলিদুদকের সামনে এই মুহূর্তে এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, আইনেরও কোনো ভিত্তি নেই; যার ওপর নির্ভর করে এই কার্যক্রম চালাতে পারি। তখন তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সহজেই পুনঃঅর্থায়নের পথ বন্ধ হোক কিংবা পদ্মা সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হোকআপনি কি সেটা চান? আমি উত্তরে বলি— ‘বেআইনী কোনো কাজে শুধু বিশ্বব্যাংকের অযাচিত অনুরোধের প্রেক্ষিতে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় আমার আরও দুজন সহকর্মী আছেন, তাদের সঙ্গে আপনারা পরামর্শ করতে পারেন। তারা জানান, ‘আমরা তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই পরামর্শ করেছি।আমি উত্তরে বলিমাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের যে ঘোষণা দিয়েছেন; আমি তার সঙ্গে একমত। অপমানিত হয়ে কোনো দাতাসংস্থার কাছে অর্থ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমি অংশীদার হতে পারি না। আমার এই অপারগতার কারণে তারা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বলে মনে হয়।

এরই মধ্যে মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক কারিগরি আর্থিক মূল্যায়নের ক্রমানুসারে এসএনসি-লাভালিন, কানাডা প্রথম; হেলকো গ্রুপ, ইউকে দ্বিতীয়; হাইপয়েন্ট রেন্ডার, ইউকে তৃতীয়; একোমনিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ওরিয়েন্ডেট কনসালটেন্ট ৫ম স্থানে নির্ধারিত হয়। ১০০ নম্বরের মধ্যে .০২৫ নম্বর বেশি পেয়ে কানাডার কোম্পানি এসএনসি লাভালিন প্রথম থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের কার্যাদেশের সুপারিশ করে। কিন্তু দুদক টিম জানতে পারে, বিশ্বব্যাংক এই কোম্পানিকে কাজের বিষয়ে সম্মতি দেয়নি। এখানে বলে রাখা দরকারমূল্যায়ন কমিটিতে বিশ্বব্যাংকের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। . দাউদ নামীয় ওই ব্যক্তি ছিলেন প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানান, পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিনকে নির্বাচন বিশ্বব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই করা হয়েছে।

এরই মধ্যে তথ্য পাওয়া যায়, এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার ওন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসে বিশ্বব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে ঘুষ প্রদানের ইচ্ছে-পোষন কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখার অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানে এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা যথাক্রমে বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ইসমাইল ভারতীয় বংশোদ্ভুত রমেশের ঘুষ গ্রহণের ইচ্ছে পোষণমূলক অনৈতিক কাজের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। তথ্যে আরও বলা হয়, রমেশ সাহার কাছে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে, যেখানে বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় পদ্মা সেতু প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজনসহ আরও কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদেরকে প্রভাবিত করতে অর্থ খরচের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়। আমরা বিশ্বব্যাংককে রমেশ সাহা এবং তার ডায়েরি সংশ্লিষ্ট সাক্ষীগণের সাক্ষ্য প্রেরণের অনুরোধ করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক পত্রের উত্তর না দিয়ে একটি রেফারেল রিপোর্ট পাঠায়, যেখানে বর্ণিত বক্তব্যসমূহের সমর্থনে সাক্ষ্যের অভাব ছিল। আমরা মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট তথা এমএলএআর পদ্ধতিতে কানাডা সরকারের মাধ্যমে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ কানাডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কাছে তথ্য চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা আমাদের কাছে তথ্য পাঠায়নি। এমন অবস্থায় লুইস ওকাম্পো নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকের একটি এক্সপার্ট টিম বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনাকালে পরবর্তীতে তথ্য দেবে মর্মে গ্রেফতার, রিমান্ড কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিড়াপীড়ি করতে থাকে। তারা বলেন, সাকো কোম্পানীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করে এমএলএআর-এর মাধ্যমে তথ্য জানতে চাইলে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশের বিভিন্ন স্থানে যথা লন্ডন, কানাডা, আমেরিকাসহ আরও অন্যান্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া যাবে। তাদের বিশ্বাসএই অর্থ বিদেশে লেনদেন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আনীত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় আমরা সাক্ষ্য- প্রমাণ ছাড়া এসব বিষয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় বলে জানালে বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম ক্ষিপ্ত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। পরে অনুরোধ করে তাদেরকে নিবৃত করা হয়। আমাদের অনুরোধে তারা কথা দেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা রমেশ সাহার ডায়েরিসহ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে পুনরায় মিলিত হবেন।

আমরা স্ব-উদ্যোগে কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছ থেকে কোনো প্রমাণ/নোটপ্যাড সংগ্রহ করতে না পারায় তৎকালীন মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হক তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাডায় পাঠাই। প্রথমবার কোনো তথ্য না পেলেও দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিস থেকে সংগৃহীত সাক্ষ্যের ট্রান্সক্রিপ্ট পর্যালোচনা করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি; যাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতি বা ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রাপ্ত তথ্য গোপনে রাখা অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম পুনরায় বাংলাদেশে আসে এবং দুদকের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। দুই দিনব্যাপী আলোচনার প্রথম দিনে নৈশভোজ চলাকালীন লুইস ওকাম্পো . ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈরি সম্পর্ক কেনতাও জিজ্ঞেস করেন ওকাম্পো। একথাও বলেন, এই বৈরিতা নিরসন হলে সকল জটিলতার অবসান হবে বলে তার বিশ্বাস। আমি তাকে জানাই, নির্ধারিত বয়স উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং আইনের বিধান মত যোগ্য না হওয়ায় তাকে পদ ছাড়তে হয়েছে। . ইউনূস উচ্চ আদালতে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু তিনি বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল এমডি পদে বহাল ছিলেন। কথা বলার পর ওকাম্পো স্তম্ভিত হন এবং বিষয়ে আর কথা বাড়াননি।

তার সঙ্গে কথোপকথনে বিশ্বব্যাংকর ঋণচুক্তি বাতিলে কথিত দুর্নীতি অভিযোগ উত্থাপনে . ইউনূসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনুমিত হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রেরিত কয়েকটি -মেইল; যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক বিষয়বস্তু প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পাঠায়। সেই -ইমেইলের সেন্ডার নামটি ঘষামাঝা করে দেয় বিশ্বব্যাংক।পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছে এবং এখানে অর্থায়ন করা সঙ্গত হবে না’— -মেইল পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের কাছে -মেইলসমূহ যে . ইউনূসই পাঠিয়েছে, ওকাম্পের কথা উপরোক্ত ঘটনাসমূহ সেটাই সমর্থন করে।

এর আগে অবশ্য দুদকের গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত দুজন কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে আমরা জানতে পারি, আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনে মিলিত হওয়ার আগে তারা স্থানীয় প্রতিনিধি গোল্ড স্ট্যানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে বসেছিলেন। সেখানে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি তথা আইনজীবী . কামাল হোসেন, ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো মতিউর রহমান, আইনজীবী ব্যারিস্টার মঞ্জুর হোসেনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন এবং তারা এক্সপার্ট টিমকে ব্রিফ করেছিলেন বলে জানা যায়। তাদের আলোচনায় আমি আইনের যুক্তি উত্থাপন করলে এবং দুদকের তৎকালীন মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হক সমর্থন করায় লুইস ওকাম্পো আমাকে আনিসুল হককে রুঢ় ভাষায় আক্রমণ করে এবং ক্ষিপ্ত হয়।

যাই হোক, দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে বিশ্বব্যাংকের টিম ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়ার কথা জানিয়ে সভা ত্যাগ করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাড়ে। তারপরও আমরা দীর্ঘসময় তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অবশেষে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় আর কোনো উপাদান না পাওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠাই। স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত কার্যক্রম শেষে -০৯-২০১৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়; যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়। দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার প্রতিবেদন দাখিলে প্রায় এক বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে ফলাফলের সাথে একমত হয়ে কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিজ একই বিষয়ে তাদের কাছে প্রেরিত অভিযোগে রায় প্রদান করে। রায়ে তারা সুস্পষ্টভাবে জানায় যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগটি ছিল অসত্য এবং নেয়াহেত গালগল্প ভিন্ন অন্যকিছু নয়। উক্ত আদালতও মামলাটি খারিজ করে দেয়।

পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিশ্লেষণে এবং বিশ্বব্যাংকের সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতার কারণে এটা সহজেই অনুমিত হয় যে, তথাকথিত ঘুষ লেনদেনে অভিপ্রায় সম্বলিত অদৃশ্য নোটপ্যাড, সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের পত্র প্রেরণসহ সবকিছুই ছিল সৃজিত, মনগড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; এর পেছনে ছিল অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী সৎ, সাহসী দেশপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী তাঁর অঙ্গীকার ঘোষণা অনুযায়ী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার উচ্চতর আসনে আসীন করেছেন।


শেখ হাসিনা   পদ্মা সেতু  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন