এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগ ছেড়ে রাজনীতিতে উদ্বাস্তু তারা

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ১৯ জুন, ২০২৪


Thumbnail

এক সময় তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। মেধাবী নেতা ছিলেন। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর তারা রাজনীতিতে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকেন। এখন নিজেরাই রাজনীতিতে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে মূলধারার নেতৃত্বের বাইরে যে কেউ টিকতে পারে না- এই সত্যটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এ রকম অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা তাদের নিজেদের ভুলে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজেরাই সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ আগামী ২৩ জুন তার ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। আওয়ামী লীগের এই প্লাটিনাম জয়ন্তীর সময় এই সমস্ত উদ্বাস্তু নেতাদের নিয়ে এই প্রতিবেদন।

ড. কামাল হোসেন: আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। জাতির পিতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন নেতা হিসেবে তরতর করে রাজনীতির সিঁড়িতে তার উত্তরণ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি ১৯৭১ এ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে তার ভূমিকা ছিল রহস্যময়। কিন্তু তারপরও শেখ হাসিনা তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ১৯৯১ নির্বাচনের পর ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যান। তিনি গণফোরাম নামের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দেন। কিন্তু এই গণফোরাম পর্বতের মূষিক প্রসবের মতোই রাজনীতিতে কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে গণফোরাম একটি অস্তিত্বহীন, গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিগণিত হয়। এখন বয়সের ভারে নুয়ে থাকা ড. কামাল হোসেন নিজেকে রাজনীতিতে থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। রাজনীতিতে প্রবল সম্ভাবনা এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিভ্রান্তি এবং ভুল রাজনীতির চোরাগলিতে নিজেকে অস্তিত্বহীন হিসেবে পরিণত করেছেন।

মোস্তফা মোহসীন মন্টু: মোস্তফা মোহসীন মন্টু ৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। বিশেষ করে ঢাকায় সংগঠন পুনর্গঠন এবং শক্তিশালী করার পিছনে মন্টুর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ লঙ্ঘন করে সন্ত্রাসী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিলে গণফোরাম গঠন করেছিলেন। গণফোরাম থেকে তিনি কিছুদিন আগে বহিষ্কৃত হয়ে নিজেই। একটি রাজনৈতিক দোকান খোলার চেষ্টা করছেন বটে, তবে সেই চেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। এই চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। 

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ একজন মেধাবী রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা এবং ৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ইমেজ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালে তিনি সংস্কারপন্থি হয়ে ওঠেন। এর আগেও তার বিভ্রান্তি হয়েছিল। তিনি আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে মিলে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। তবে এক এগারোতে তার বিভ্রান্তির কারণে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হন পাবনার আসন থেকে। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের আর থাকেননি। ২০১৮ নির্বাচনে তিনি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। গত নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র করে পরাজিত হন। রাজনীতিতে তিনি এখন উদ্বাস্তু। 

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ: আওয়ামী লীগের ৭৫ পরবর্তী ছাত্র নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করা হত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদকে। তিনি শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি যাদেরকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ছিল অন্যতম। কিন্তু তিনিও এক এগারোর সময় সংস্কারপন্থি হয়েছেন এবং সংস্কারপন্থি হওয়ার কারণেই তিনি পরবর্তীতে রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ২০১৮ নির্বাচনে তিনি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। এবার তিনি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। রাজনীতিতে তিনি এখন পথভ্রষ্ট এবং অস্তিত্বহীন। 

মাহমুদুর রহমান মান্না: মাহমুদুর রহমান মান্নাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অতিথি পাখি হিসেবে ছিলেন। একদা বাম রাজনীতি করা মান্নাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রত্যাশা থেকে তাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাহমুদুর রহমান মান্নাও এক এগারোর সময় সংস্কারপন্থি হয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি নাগরিক ঐক্য নামের একটি মুদির দোকানের মত রাজনৈতিক দল খুলে কোন রকম অস্তিত্ব টিকানোর চেষ্টা করছেন বটে। তবে আদর্শ বিবর্তিত সুবিধা ভোগী এই রাজনৈতিক নেতা এখন মূল্যহীন। 

এভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে যারা ছিটকে পড়েছেন তারা নিজেরাই রাজনীতিতে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছেন।

আওয়ামী লীগ   ড. কামাল হোসেন   সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ   মাহমুদুর রহমান মান্না  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কার ‘পুতুল’ বেগম জিয়া

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৫ জুলাই, ২০২৪


Thumbnail

বেগম জিয়ার ডাক নাম ‘পুতুল’। একসময় আপোষহীন নেত্রীর খেতাব পাওয়া এই রাজনীতিবিদ এখন নিজেই যেন ‘পুতুল’ হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। সপ্তাহ জুড়ে বিএনপির বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী ছিলো। শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পহেলা জুলাই মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর ৩ জুলাই জেলায় জেলায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসমস্ত সমাবেশ কতটা আন্তরিক বা কতটা আত্মরক্ষার কৌশল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বেগম জিয়া কি বিএনপির আন্দোলনের একমাত্র অস্ত্র? এই আন্দোলন করে কি বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব?

৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি এখন দিশেহারা। ক্ষত-বিক্ষত এবং আত্মবিশ্বাসহীন একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। নিজেদের ভুল তারা বুঝতে পারছে কিন্তু স্বীকার করছে না। দলটির ভেতর চলছে অন্তঃকলহ।  দলের মধ্যে নেই কোন সমন্বয়। সবকিছু হচ্ছে স্বৈরাচারী কায়দায়। এর মধ্যেই হঠাৎ করেই বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কেন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিএনপি মনে করছে এটাই তাদের আত্মরক্ষার সহজ পথ, দল গোছানোর সুযোগ। বেগম জিয়া অসুস্থ। তিনি হাসপাতালে। তার অসুস্থতা নিয়ে জনগণের আবেগকে উস্কে দিতে চায় বিএনপি। আর একারণেই খালেদা জিয়াকে তারা পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া আসলে বিএনপির পুতুল নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে ব্যবহার করছে?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেগম জিয়াকে গত ১৫ বছরে রাজনীতিতে ‘এতিম’ করেছে। বিশেষ অনুকম্পায় মুক্তি দিয়ে করুণাপাত্রে পরিণত করেছে। সরকার তার হাতের মুঠোয় খালদাকে নিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখছে। সরকারের করুণায় তার মুক্ত জীবন। আওয়ামী লীগ চাইলেই এখন কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারে বিএনপি’র নামমাত্র চেয়ারপার্সনকে। বেগম জিয়া যেন এক অর্থে আওয়ামী লীগের ‘পুতুল’।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিলো হঠাৎ করেই। তিনি রাজনীতিতে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম এর মতো করেই সবকিছু পেয়ে গেছেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আপোষহীন নেতার মর্যাদা পান বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, কোনরকম অতীত অভিজ্ঞতাহীন একজন গৃহবধূর রাজনীতিতে আসার প্রধান কারণ ছিলো জিয়ার ইমেজকে ব্যবহার করা। রাজনীতিতে এসে বেগম খালেদা জিয়া তার সীমাবদ্ধতাগুলো ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, একারনেই তিনি ‘পুতুল’ হিসেবেই রাজনীতিতে ছিলেন। কখনো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের  পরামর্শে, কখনো দলের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে, এভাবেই রাজনীতিতে মৌণব্রত পালন করে তিনি ক্রমশ শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি এবং ভোট ব্যাংকই ছিলো খালেদার সম্পদ। তারাই বেগম খালেদা জিয়াকে নেতা বানিয়েছেন। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই বেগম খালেদা জিয়া সবকিছু করেছেন। চিরকালই বেগম জিয়া ‘পুতুল’ই ছিলেন।

পাকিস্তান পন্থী ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী এবং ৭৫ এর খুনীরাই বেগম খালেদা জিয়াকে নেতার আসনে আসীন করেছিলেন। আর একারণে বেগম জিয়া সবসময় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এবং ৭৫ এর খুনীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি দেখিয়েছেন। তাদেরকে ছাড় দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সামনে গণতান্ত্রিক নেতা হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিলো। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি নিজেই কাজে লাগাননি।

একসময় বেগম খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হতো। কেউ কেউ এটাও প্রমাণের চেষ্টা করতেন বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয়। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধী, যারা ৭৫’র ষড়যন্ত্রের অংশীদার তারা সবসময় বেগম খালেদা জিয়াকে লাইম লাইটে আনার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে চিরস্থায়ী করতে পারে নি তারা। কারণ বেগম খালেদা জিয়া নিজের আলোয় আলোকিত ছিলেন না। নিজের মেধায় রাজনীতিতে বিকশিত হননি। রাজনীতিতে প্রজ্ঞাহীনতাই তাকে পরিত্যক্ত করেছে।

৮৬’র নির্বাচনে বেগম জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হয় তিনি যেন নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন। আর একারণে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তান পন্থীদের পরামর্শে নির্বাচন থেকে সরে আসেন। ঐ নির্বাচনে না যাওয়াটাই বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সাপে বর হয়েছে। ৯১ সালের নির্বাচনে একারণেই বিজয়ী হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৯১ এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির বিজয়ের প্রধান কারণ ছিলো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। আওয়ামী লীগকে তারা ভয় পেত। আওয়ামী লীগের উপর আস্থা রাখতে পারেনি। আর একারনেই একজন ‘পুতুল’ প্রধানমন্ত্রীকে তারা পছন্দের তালিকায় রেখেছিল। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সেই সব কাজই করেছেন যা তার প্রভুরা চেয়েছে। আর আর একারণেই তিনি ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ’ বাতিল করেননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন নি, ৭৫ এর খুনীদের কূটনৈতিক চাকরি থেকে অপসারণ করেননি।  ১৯৯৬ সালে তিনি তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। তখন তার ‘আপোষহীন’ তকমাটা খসে পড়েছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং পাকিস্তানপন্থী স্তাবকরা বেগম খালেদা জিয়াকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা থেকে সরে যাননি।

৯৬ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দলে যায় বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া হন বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা হয়ে তিনি শুধু সময়ের অপচয় করেছেন রাজনীতির পরিপক্কতা বা বিচক্ষণতার প্রমাণ রাখতে পারেননি। ২০০১ সালে আবার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই বেগম খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় আনা হয়। এবার তার উত্থানের পিছনে জামায়াতের অবদান আড়ালে ছিলো না। পুতুল নাচে যে পুতুলটি নাচে তার সুতোটা দেখা যায় না। কিন্তু ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পিছনে যে সুতো ছিলো তা সকলের কাছেই দৃশ্যমান হয়। এসময় বেগম খালেদা জিয়া দুই সুঁতোয় নাচতেন। একটি সুঁতো ছিলো আইএসআইয়ের হাতে, অন্যটি তারেক জিয়ার কাছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘হাওয়া ভবনের’ উত্থান ঘটে। বেগম খালেদা জিয়া হন নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী। হাওয়া ভবন থেকেই পরিচালিত হতো রাষ্ট্র। দু’টি সমান্তরাল সরকার দেশ শাসন করতো। এই শাসনামলে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ শে আগস্ট গ্রেণেড হামলার মতো অনেক নজীর বিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। বেগম খালেদা জিয়া পুত্র স্নেহে অন্ধ থেকে এসমস্ত ঘটনার দায় নিজের কাঁেধ নিয়েছেন, এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, একজন অন্ধ মা হতে পেরেছেন মাত্র। পুত্রের কাছে দেশকে বিসর্জন দিয়েছেন।

২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঘটনা তাতেই বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের পতনের সূচনা হয়েছিলো বলে আমি মনে করি। তিনি যে দেশ শাসনের জন্য অযোগ্য, অক্ষম এবং অদূরদর্শী এটি প্রমাণিত হয়েছে এসময়। আর বেগম খালেদা জিয়ার এই অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের কারণেই ২০০৭ সালে এক-এগারো আসে। গণতন্ত্র নির্বাসনে যায়।

মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলেই। এই সময় সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় যাতে সাবেক বিএনপি নেতা বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারেন। এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর সারাদেশ আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। শেষ পর্যন্ত কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এরপর ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের মতো একজন স্তাবক, মেরুদন্ডহীন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। যিনি হাওয়া ভবনের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতেন না। আর এরকম নীতিহীন, ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পক্ষপাতের কারণেই অনিবার্যভাবে এক এগারো এসেছে। ড. ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দলের থেকে তাকে মাইনাস করার চেষ্টা করা হয়।বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অধ্যায়ের আসল সমাপ্তি ঘটেছিলো এক এগারের মাধ্যমেই।

২০০৮ এর নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার দল শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। এসময় পাকিস্তানি প্রভুরা বেগম জিয়াকে ছুঁড়ে ফেলে। নিজেরাই সমস্যা আক্রান্ত হয়ে তারা বাংলাদেশে আগ্রহ হারায়। ফলে রাজনীতিতে দিশাহীন হয়ে পরেন বেগম জিয়া। নিতে থাকেন একের পর পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। বেগম খালেদা জিয়া কি নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বেগম জিয়া কি তার নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিন্দা জানিয়েছিলেন? বেগম খালেদা জিয়া কি নিজস্ব প্রজ্ঞায় ২০১৫ সালে লাগাতার অবরোধের ডাক দিয়ে গুলশানে তার কার্যালয়ে অবস্থান করেছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর- না। বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়ে এসব করানো হয়েছিলো। কারণ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও যোগ্যতা নাই। সব সিদ্ধান্ত ছিলো তারেক জিয়ার । আর তারেক জিয়ার এই অপরিপক্ক, ভ্রান্ত, উদ্ভট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। এমনকি ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া মামলার রায় হবার আগে লন্ডনে গিয়েছিলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেসময় তিনি যদি লন্ডনেই থাকতেন তাহলে রায়ের ফলাফল যাইহোক না কেন তাকে অন্তত কারাগারে যেতে হতো না। । কিন্তু তারেক জিয়া তাকে ‘পুতুল’ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আরো নির্দিষ্ট করলে বলা যায়, তারেক জিয়ার গিনিপিগ হিসেবেই তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন মামলার রায়ের আগে। বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের পরেই তারেক জিয়া বিএনপি দখল করেন। বিএনপির রত্ন ভান্ডারের চাবি চলে যায় তার কাছে। এখান থেকে চাঁদাবাজি, কমিটি বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে অগাধ সম্পদের মালিক হবার স্বর্ণদ্বার খুলে যায় তারেক জিয়ার সামনে। আর একারনেই তিনি নিজের মাকে জিম্মী করেন। এখন যখন বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর দাবি করা হয়, তখন প্রশ্ন আসে, ২০১৮ সালে কেন তাকে লন্ডন থেকে দেশে আনা হলো?

বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মুক্তির জন্য বিএনপি কি করেছে? বিএনপির নেতারা বলেছিলো যে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবে। কিন্তু আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার আইনি লড়াইও থমকে রয়েছে। বিএনপির বেগম খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে বিএনপি কতটা আন্তরিক সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার জামিনের জন্য আদালতে যাচ্ছে না কেন আইনজীবীরা? বেগম জিয়ার এই পরিণতির জন্য কে কতটুকু দায়ী, তা নির্মোহভাবে হিসেব করতে হবে। সরকার ২০২০ সালের মার্চে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় জামিন দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে বিদেশ পাঠানোর জন্য প্রয়োজন আইনী লড়াই করা। সে লড়াইয়ে বিএনপি কেন দ্বিধাম্বিত?

বেগম জিয়া আসলে তারেক জিয়ার পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তারেক জিয়ার রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যবহার করে বিএনপি একদিকে যেমন তার হতাশা কাটাতে চাচ্ছে অন্যদিকে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছে। আবার বেগম খালেদা জিয়ার যদি কিছু হয় তাহলে সবচেয়ে লাভবান হবে তারেক জিয়া। একদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন হওয়াটা তার জন্য চিরস্থায়ী হবে। অন্যদিকে এই ইস্যুতে বিএনপিকে হয়তো কিছুদিন সচল রাখতে পারবেন। কিন্তু মাকে পণ বানিয়ে কিংবা কূটচাল ব্যবহার করে রাজনীতিতে সাময়িকভাবে জয়ী হওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী অর্জন থাকে শূণ্য। রাজনীতিতে নিজস্ব প্রজ্ঞায় আলোকিত না হলে ‘পুতুল’ হয়েই থাকতে হয়।

 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


শনিবারের কলাম  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

উপসর্গ পুরোনো, লক্ষণ ভালো নয়

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০২ জুলাই, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের আগে দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। ক্ষমতার পালাবদলের আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হাহাকার হয়। জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার একটা চেষ্টা চলে। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেভাবেই সরকার বদল হোক, তার আগে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে সামনে আসে।

১৯৭৪ সালে সাজানো দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণবাহিনীর পরিকল্পিত সন্ত্রাস আগস্ট ট্র্যাজেডির পটভূমি তৈরি করেছিল। সময় সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ছিল খাদ্য সংকটের ফুলানো-ফাঁপানো খবর। কালোবাজারি, মজুতদারদের কাহিনি ছাড়া কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশিত হতো না। সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ৭৪-এর জানুয়ারি থেকে ৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি প্রতিটি বক্তব্যেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষএরা কিন্তু অসৎ নয়। ব্ল্যাক মার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাক মার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া করেছে তারাই বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই।

১৯৭৫-এর ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব। প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষকে ভালোবাসব।

কিন্তু সরকারের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজরা জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দেননি। আর কারণেই তিনি তাদের প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। কয়েকজন খারাপ লোক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত করেছিলেন। তাদের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের ষড়যন্ত্রের কাছেই পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটে ইতিহাসের বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনা। সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশজুড়ে অস্থিরতাএমন একটি আবহ সৃষ্টি করেই ৭৫-এর খুনি, ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিল। আর অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ। গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়নি।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগে দেশে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কারা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৮০ সালের শেষ দিক থেকেই শুরু হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর সিমেন্টের মূল্য বৃদ্ধি হয়, সেপ্টেম্বর দাম বাড়ে গুঁড়া দুধের। ১৮ সেপ্টেম্বর রেশনে চিনির দাম বাড়ে ৫০ শতাংশ, অক্টোবরে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ানো হয়। ১৯৮১-এর এপ্রিলে রেশনে চাল গমের দাম বাড়ে। লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে স্বৈরাচারের শক্ত শিকলও আলগা হয়ে যায়। ১৯৮০ সালে রংপুর কারাগারে বিদ্রোহ শুরু হয়, পরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। জিয়া নিহত হওয়ার অল্প দিন আগে ১৯৮১ সালের এপ্রিল দুর্নীতির দায়ে এক মন্ত্রী তিন প্রতিমন্ত্রীকে সরিয়ে দেন। এর পরই ঘটে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থান। ১৯৮১-এর ৩০ মে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নিহত হন। যেভাবে এবং যে পথে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই পথেই তিনি বিদায় নেন।

জিয়াউর রহমানের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপি সরকার। বিচারপতি সাত্তারের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই শুরু হয় দুর্নীতির নানারকম আলোচনা। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ আসে বিচারপতি সাত্তারের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। সময় ইমদাদুল হক ইমদুর ঘটনায় সরকারের ভিত নড়ে যায়। ইমদাদুল হক ইমদু একসময় জাসদ করতেন। তিনি ঢাকার কালীগঞ্জ থানা গণবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। কালীগঞ্জে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্ত ছিল না। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সম্পত্তি দখল, অপহরণ, খুনের অভিযোগ ছিল অনেক। যুব উন্নয়নমন্ত্রী আবুল কাশেম সরকারের বাসা থেকে ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাশেমের বিরুদ্ধে ইমদুকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঘটনা গোটা সরকারকে বিব্রত করে। একজন মন্ত্রীর বাসায় দাগি খুনি এবং আসামি কীভাবে থাকে, সে নিয়ে হৈচৈ হয়। অনেকে মনে করেন, ১৯৮২ সালে ইমদুর ঘটনায় বিচারপতি সাত্তারের সরকারের পতন ডেকে আনে। এর আগে যুবমন্ত্রী কাশেম ১১ ফেব্রুয়ারি সাত্তারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। পত্রিকাগুলোয় ইমদুর অপরাধের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বাড়ে ব্যাপকভাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পতন ঘটে সাত্তার সরকারের। অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। স্থগিত করা হয় সংবিধান।

এরশাদের বছরের স্বৈরশাসন যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব তার দুর্নীতির আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়ে তিনি সততা প্রমাণ রাখতে চান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে শুরু করেন দুর্নীতির মহোৎসব। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সে সময় শৃঙ্খলিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদ সরকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। সে সময় বিদেশি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে দরিদ্র দেশের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রপতি কিংবা মরিয়ম মমতাজের সঙ্গে এরশাদের প্রেমকাহিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ফেয়ার ফ্যাক্স রিপোর্টে আসে এরশাদের দুর্নীতির আদ্যোপান্ত। চিনি চুরি, গম লুট করে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা দেশে। উপজেলা পদ্ধতি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরশাদ সার্বজনীন দুর্নীতির স্কিম চালু করেন। তৈরি হয় উপজেলা টাউট দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী। সময় এরশাদের বান্ধবী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান পত্নী জিনাত হোসেইনের ক্ষমতার দাপট, দুর্নীতি, বিভিন্ন মন্ত্রী এবং এরশাদের একান্ত অনুগতদের অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয় যে, জনগণ এরশাদকে একজন দুর্নীতিবাজ এবং লম্পট হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। ৯০- কুয়েত যুদ্ধের পটভূমিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে হুহু করে। সঙ্গে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দুর্নীতির জন্যই এসব মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। তারা রাজপথে নেমে আসে। স্বৈরাচারের পতন ঘটায়।

১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে নাটকীয়ভাবে। বিএনপি আমলে দুর্নীতির বিভিন্ন খবর আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ড্যান্ডি ডায়িং কেলেঙ্কারি, কোকো লঞ্চ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, সাইদ ইস্কান্দারের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নেওয়া, সার কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা দুর্নীতির খবর বিএনপি সরকারকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। জনগণও বিএনপি সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্নীতিতে খালেদা জিয়া আর এরশাদ সমান হয়ে যান। খালেদা জিয়ার ভাই-বোনদের দুর্নীতির চর্চা হয় চায়ের আড্ডায়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের প্রধান কারণ ভোট চুরি আর দুর্নীতি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে দীর্ঘ ২১ বছর পর। আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার প্রথম দিকের দিনগুলো ছিল অত্যন্ত চমৎকার। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একটি নতুন উন্নয়নের ধারা সূচনা করেছিল। বিশেষ করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি বণ্টন, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাফল্য ছিল অসাধারণ। একটি বাড়ি, একটি খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে এসে নানারকম দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ ফলাও করে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির দুর্নীতি সন্ত্রাসের গল্প আলোচিত হতে থাকে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। সময় আওয়ামী লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলের জমি দখল, ঢাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এক এমপির অস্ত্র হাতে মিছিলের ছবি। ফেনীতে জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের তাহের, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের নানারকম খবর গণমাধ্যমে আসতে থাকে রং মাখিয়ে। বিব্রত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এসব অর্ধেক সত্য, অর্ধেক কল্পিত সংবাদ অনেকে বিশ্বাস করে। এর প্রভাব পরে ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে অবশ্য আর অপেক্ষা করেনি। প্রথম দিন থেকেই হাওয়া ভবনের দুর্নীতি সারা দেশে টক অব দ্য কান্ট্রি-তে পরিণত হয়েছিল। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে লুণ্ঠন এবং অনিয়মের এক নজিরবিহীন ঘটনা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় সময়। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব অপসারিত হন শুধু দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধান করতে চেয়ে। সরকারি চাকরিতে বদলি-নিয়োগ, টেন্ডার ইত্যাদি সবকিছু দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা কেলেঙ্কারি, খাম্বা কেলেঙ্কারিসহ হাজারো দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে। বিএনপি অবশ্য এসব মোটেও আমলে নেয়নি, পাত্তাও দেয়নি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার বিএনপি সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। হারিস চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, গিয়াস উদ্দীন আল মামুনের মতো দুর্নীতির শিরোমণি দুর্বৃত্তরা জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছিলেন এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকএরকম একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। সময় বাজারে প্রথম সিন্ডিকেট চালু হয়। সয়াবিন, লবণ কিংবা চিনি বাজার থেকে উধাও করে দাম বৃদ্ধির এক কৌশল শুরু হয়। কারসাজি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ফুঁসে ওঠে মানুষ।

২০০৭ সালে নানা নাটকের পর . ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলের নেতাদের দুর্নীতির সত্য-মিথ্যার মিশেলে রগরগে কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষ করে বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোতে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের এক খেলা শুরু হয়। এই চরিত্র হননের মিশনের মধ্য দিয়েই এক-এগারো সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজএটি প্রমাণের চেষ্টা চলে ফখরুদ্দীন সরকারের দুই বছর। এই অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে নিজেরাই দুর্নীতির নেশায় আসক্ত হন। ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করে চাঁদাবাজি, জোর করে অর্থ আদায় সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। রীতিমতো লুটেরা শাসন কায়েম করেছিল . ফখরুদ্দীন-মইন সরকার। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে হুহু করে। পণ্যের বাজারে সৃষ্টি হয় নজীরবিহীন সংকট। গণআক্রোশের আঁচ পেয়ে নির্বাচন দিয়ে কোনোমতে বিদায় নেয় এই সরকার।

টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি তার নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু পণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য নেই এখনো। এর মধ্যে মতি, বেনজীরদের কাহিনি নিয়ে চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। তাদের অপকর্মের দায় সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ এর মাধ্যমে সরকারকেই দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা করছে। ব্যক্তির দুর্নীতির দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হচ্ছে সে ব্যবস্থাগুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে না। কেউ বলছে না, অতীতে কোনো সরকার এভাবে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিংবা দলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিকে প্রশংসা করা হচ্ছে না। এর ফাঁকফোকর আবিষ্কারে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। অগণতান্ত্রিক শক্তি বিরাজনীতিকরণের জন্য সবসময় এই পথই বেছে নেয়। আর কারণেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এখনই। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। থাকতে হবে পক্ষপাতহীন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যেমন চলবে, তেমনি দুর্নীতির যে কল্পকাহিনিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তারও উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। কারণ এই উপসর্গ পুরোনো, লক্ষণগুলো ভালো নয়।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


দুর্নীতি   দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি   সরকার   লক্ষণ   ষড়যন্ত্র  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অভিযান শুরু হলেই, দুর্নীতিবাজরা ‘নিখোঁজ’ হয়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২৮ জুন, ২০২৪


Thumbnail

ছোট বেলায় অনেকগুলো প্রবাদের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম। ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য কিছু পরিচিত বাক্য দেয়া হতো। সে বাক্যগুলো ছিলো বেশ মজার। ছোট বেলার দুষ্টুমি ভরা অবসরে সে বাক্যগুলো নিয়ে নানারকম চর্চা হতো। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’ এমন বাংলার ইংরেজি কি হবে তা নিয়ে শিক্ষকের কানমলা খায়নি এমন বালক খুবই কমই ছিলো আমাদের সময়। সেসময় বিভিন্ন প্রবাদের সঙ্গেও আমাদের পরিচিত ঘটেছিল। প্রবাদগুলোর মধ্যে আজ একটি বেশ মনে পড়ছে। প্রবাদটি হলো ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। তবে, এখন যদি কেউ প্রবাদ-প্রবচন লেখেন তাহলে লিখতে পারেন ‘অভিযান শুরু হলেই দুর্নীতিবাজরা নিখোঁজ হয়।’ 

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণমাধ্যমের পাতা জুড়ে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তদের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে। কার কত সম্পদ সেই হিসেব কষতে গিয়ে অনেকে হিমশিম খাচ্ছেন। একজন মানুষ এক জীবনে কীভাবে এতো সম্পদের মালিক হতে পারে তা নিয়েও অনেকের কপালে চোখ উঠে গেছে। কিন্তু এ সমস্ত দুর্নীতিবাজদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। কেউই আইনের আওতায় আসেনি। তারা এখন দূর দেশে অবস্থান করছেন। কেউ মাথা ন্যাড়া করে পালিয়েছেন, কেউ বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানে বহাল তবিয়তে নতুন পরিচয় নিয়েছেন। এখান থেকেই ধারনা করা যায়, দেশে তাদের যে সম্পদ ছিলো তা খুবই নগন্য, তুচ্ছ এবং এই পরিমাণ সম্পদ ফেলে দিলেও তাদের কোন ক্ষতি হতো না। বরং বিদেশে যে সম্পদ আছে সেই সম্পদই তাদের আসল সম্পদ। সেই সম্পদ থেকে জনগণের দৃষ্টি আড়ালের জন্যই তারা দেশে কিঞ্চিত সম্পদ রেখেছিলেন। বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদ দিয়ে তারা এবং তাদের চৌদ্দ পুরুষ আরাম আয়েশে খেতে পারবে। এখন তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বেনজীরকে নিয়ে কথা হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। প্রথমে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকা বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশ করে। তাও মাস তিনেক আগে। এই সংবাদ প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কিছুই করেনি। হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলো। যেন এধরনের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করাটা এক ধরনের অন্যায়। কেউ কেউ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ধৃষ্টতার সীমা লঙ্ঘন করলো কিনা সে প্রশ্নও তুলেছিল। এনিয়ে কোন মহলেরই কোন ধরনের তৎপরতা না দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা মনে করেছি, এটিও আর দশটি খবরের মতো একটি খবর, যে খবর কাউকে স্পর্শ করবে না, কাউকে তাড়িত করবে না। কিন্তু বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালো। প্রথমবারের এমপি ব্যারিস্টার সুমন বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি এব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত দাবি করলেন। ব্যারিস্টার সুমনের সাহসী উদ্যোগের ফলে হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিলেন, দুদক যেন দ্রুততম সময়ে এবিষয়টি তদন্ত করে। দুই মাস সময়ের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্ত নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেয়া হলো। হাইকোর্টের এই নির্দেশের পরই দুর্নীতি দমন কমিশন নড়ে-চড়ে বসলো। তাহলে দুদকের কাজটা কি? যখন কালের কণ্ঠে সিরিজ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হলো তখন কেনো দুর্নীতি দমন কমিশন চুপচাপ বসে থাকলো, তারা কেন কিছুই করলো না? দুর্নীতি দমন কমিশন কি চোখ-কান বন্ধ রেখে  কাজ করে? কারণ বেনজীর আহমেদের এই দুর্নীতির খবর সকলেই জানতো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার আগে থেকেই জানা ছিলো যে, চাকরী জীবনে বেপরোয়াভাবে লুণ্ঠন করেছেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার প্রতারণা মূলক পরিচয়ে নেয়া একাধিক পাসপোর্ট জালিয়াতির খবরও দুর্নীতি দমন কমিশন রাখতে পারেনি। তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজটি কি সেটি একটি বড় প্রশ্ন। পাসপোর্ট অধিদপ্তর বা অন্যরাও কি ঘুমিয়েছিলো? যতক্ষণে দুর্নীতি দমন কমিশন নড়ে-চড়ে বসলো, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তদন্ত শুরু করলো। ততক্ষণে ‘চোর’ পালিয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পত্তি ক্রোক করলো। ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করলো। ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে দেখা গেলো ব্যাংক একাউন্ট খালি। সব টাকা তিনি আগেই উঠিয়ে নিয়েছেন। এরপর শুরু হলো বেনজীর আহমেদকে সমনের নাটক। তাকে ডাকা হয় তিনি আসেন না। দুই বার দুর্নীতি দমন কমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি লাপাত্তা হয়ে থাকলেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কি জানতো না যে বেনজীর আহমেদ পালিয়ে গেছেন? প্রথমেই তাকে আইনের আওতায় আনা হলোনা কেন? তার বিদেশ যাবার পথ কেন বন্ধ করা হলোনা?

যা কিছু হচ্ছে তার সবই কি আসলে নাটক? বেনজীর আহমেদ যখন বুঝতে পেরেছেন তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তার অবৈধ সম্পদের খবর সকলেই জেনে ফেলেছে, তার গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে তখন তিনি সটকে পরেছেন। শুধু সটকেই পরেননি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উঠিয়েছেন, সরিয়েছেন। হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকা তিনি বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন, স্বপরিবারে বিদেশেও চলে গেছেন। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কি করলো? তারা কি প্রকারান্তরে বেনজীরকে পালাতে সহযোগিতা করলো না? চোর পালিয়ে যাওয়ার পর এখন আলোচনা, উত্তেজনা, সাজ-সাজ রব করে কি হবে? এখন কি বেনজীরকে ধরা যাবে? বেনজীর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে বেনজীর এখন তুরস্কে অবস্থান করছে। কেউ বলছেন, সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। কারও কারও মতে তিনি দুবাইয়ে । যেখানেই থাকুন না কেন তিনি বিদেশি পাসপোর্ট যে নিয়েছেন তা হলফ করেই বলা যায়। কারণ বেনজীর আহমেদ বিদেশি পাসপোর্ট এবং বিদেশি নাগরিকত্ব নেয়ার জন্যই তার চাকরি জীবনেও কখনো সরকারি পাসপোর্ট গ্রহণ করেননি। নিজের পেশাগত পরিচয় নিয়েও তিনি প্রতারণা করেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি জালিয়াতি করেছেন। সংশ্লিষ্ট সবাই শুধু তামাশা দেখেছে।

আমাদের দেশের পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে নিয়ে অনেক কথাই শুনি। কিন্তু এসব কথা আমলে নিতে ইচ্ছে করে না। পাসপোর্ট অধিদপ্তর কীভাবে একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে বেসরকারি চাকরিজীবি হিসেবে পাসপোর্ট দেয়। এই যদি হয় আমাদের ‘সিস্টেম’ তাহলে পুরো সিস্টেমটিই পঁচে গেছে, ঘুঁণে ধরে গেছে। এটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান গুলোর ব্যপারে অনাস্থা তৈরি হবে। যা হচ্ছেও। 
মতিউরকে নিয়েও একই অবস্থা। ‘ছাগলকাণ্ডে’ মতিউর যখন হুংকার দিয়ে উঠলেন, বললেন ‘ইফাত আমার ছেলে নয়’ তখনই বোঝা গিয়েছিলো ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’। মতিউরের নিশ্চয়ই অন্য কোন দুরভিসন্ধি আছে। এরপর মতিউরকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখা শুরু হলো। একসময় জানা গেল মতিউর রহমান দেশে নেই। কেউ বলছেন তিনি মাথা ন্যাড়া করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। কেউ বলছেন বহাল তবিয়তেই বীরের বেশে তিনি তার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য তার কোন বাঁধা ছিলো না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা একজন ব্যক্তিকে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বিদেশে যেতে পারবেন। তবে সরকারি চাকরিজীবি বলে কথা। মতিউর রহমান যদি বিদেশে যেতে চান তাহলে তাকে সরকারের অনুমতি নিতে হবে, তার বিদেশ যাওয়া সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তিনি বা কোন সরকারি কর্মচারীই বিদেশ যেতে পারবেন না। মতিউর রহমান সেরকম কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। তাহলে তো আমরা জানতাম। এতো বড় পদের একজন কর্মকর্তা সরকারের অনুমোদন ছাড়া যদি দেশ ত্যাগ করতে পারেন, তাহলে এদেশে সব সম্ভব।

বেনজীরের সাথে মতিউর রহমানের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। বেনজীর চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তিনি একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি যেকোন সময়, যেকোন ভাবে বিদেশ যেতে পারেন। তার বিদেশি পাসপোর্ট ছিলো বিদেশি পাসপোর্ট নিয়েও তিনি বিদেশে যেতে পারেন। কিভাবে তিনি বিদেশে গেছেন তা তদন্তের দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। কিন্তু মতিউর রহমান একজন সরকারি চাকরিজীবি। উচ্চপদে আসীন ব্যক্তি। তিনি দেশত্যাগ করেন কিভাবে? তাহলে কি মতিউর রহমানও কি জালিয়াতি করে পাসপোর্ট গ্রহণ করেছিলেন? সেই পাসপোর্ট দিয়ে কি তিনি সটকে পড়েছেন? মতিউর রহমান যদি শেষ পর্যন্ত বিদেশ গিয়ে থাকেন তাহলে এটি হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আরেকটি পরাজয়। নাকি সরকারের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজরা তার পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করছে? এরকম দুর্বৃত্তরা যদি বিচারের আগে এভাবে দেশ থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে সেটি এটি খারাপ উদহারণ হবে। এধরনের খারাপ উদহারণ অবশ্য আমাদের সামনে আগেও এসেছে। পি কে হালদারের কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো, পি কে হালদারের সম্পত্তি যখন ক্রোক করার নির্দেশ দেয়া হলো তার আগেই তিনি দেশত্যাগ করলেন। পরবর্তীতে তথ্য উদ্ধার করা হয় কিভাবে এবং কার সহযোগিতায় তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। পি কে হালদারের দেশত্যাগের বিষয়টি তাও জানা গিয়েছিল, কোন বর্ডার দিয়ে তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন সে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বেনজীর এবং মতি যেন ‘ইনভিজিবল ম্যান’। তারা ‘অদৃশ্য মানব’ হয়ে গেছেন। তারা কিভাবে দেশত্যাগ করেছিলেন সে খবর কারো কাছে নেই। আমাদের দেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। এ দেশ থেকে একজন নাগরিকের বাইরে যেতে হলে সুনির্দিষ্ট কতোগুলো নিয়ম-কানুন মানতে হয়। সীমান্ত পার হতে গেলে ইমিগ্রেশনের শরণাপন্ন হতে হয়। তাহলে এই সবকিছু ফাঁকি দিয়ে বেনজীর-মতিউররা কিভাবে দেশত্যাগ করেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। নাকি একটি সংঘবদ্ধ চক্র দুর্নীতিবাজদের লালন করে বা দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রয়েছে বিভিন্ন মহলের। এখন যা হচ্ছে, বেনজীর ও মতিউরের সম্পদের হিসেব গ্রহণ করা বেনজীর-মতিউর রহমানের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা, তার বিদেশ যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা সে সবই সাজানো নাটক কিনা বা পাতানো খেলা কিনা তা প্রমাণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। কারণ যেসমস্ত ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদের বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেসমস্ত ব্যক্তিরা কেউই দেশে থাকছেন না। এ যেন এক অদ্ভুত ম্যাজিক। যখনই কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে এবং প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা রয়েছে, তখনই তিনি ‘উধাও’ হয়ে যাচ্ছেন। এই উধাও কিভাবে হচ্ছেন, কারা করছেন ‘উধাও’ সেটি খুঁজে বের করা দরকার। কারণ একজন এরকম দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের জন্য অত্যন্ত জরুরী। না হলে কদিন পর মানবাধিকার ব্যবসায়ীরা দাবী করবেন বেনজীর-মতিকে গুম করা হয়েছে। গুম দিবসে তাদের ছবি দিয়ে পোষ্টার হবে। মতি এবং বেনজীররা যদি আইনের ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে তাহলে অন্যদের মধ্যেও একই প্রবণতা দেখা যাবে। আরেকটি আতংকের দিক রয়েছে। এর ফলে অর্থ পাচার বাড়বে। যারা দুর্নীতিবাজ, যারা এখন বিপুল বিত্তের মালিক তারা দেশে সম্পদ কেনার দিকে আর মনোযোগী হবে না। সব টাকা বিদেশে পাচার করবেন। তারা বেনজীর এবং মতির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। তারা বুঝবেন যে, টাকা দেশে রাখলে বিপদ আছে, টাকাগুলো বাজেয়াপ্ত হতে পারে, দুর্নীতি দমন কমিশন তার হিসেব তলব করতে পারে। নানা রকম ঝুট ঝামেলা। এসব ঝুট-ঝামেলার থেকে টাকা সরিয়ে দিবেন তারা দুবাই, সিঙ্গাপুর অথবা মালয়েশিয়াতে, কিংবা বেগম পাড়ায়। ঝামেলা হলেই তারা সটকে পড়বেন নিরাপদ স্থানে। ইদানিং অনেক আমলা স্বেচ্ছা নির্বাসনে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। এরা দাপুটে সচিব ছিলেন। এখন এদের কেউ কানাডা, কেউ ইংল্যান্ডে অবসরে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। দুর্নীতিবাজরা দেশ ত্যাগ করছেন, এ খবরে খুশী হতে পারছি না। কারণ তারা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের রত্ন ভান্ডার। মতি এবং বেনজীরের ঘটনা দুর্নীতিবাজদের নিরুৎসাহিত করবে না করছেও না। দুর্নীতিবাজদের বরং এটি উৎসাহিত করবে। দুর্নীতিবাজরা এখন মনে করছে টাকা লুণ্ঠন করে দেশে রাখা নিরাপদ নয়, বিদেশে পাচার করাটা সর্বোত্তম। আর এই সর্বনাশী তৎপরতার ফলে দেশের অর্থনীতির আরো বারোটা বাড়বে। ধরার আগেই যদি চোর পালিয়ে যায় তাহলে সেই চোর হয়ে উঠে বিপদজ্জনক। আমরা সেইরকম বিপদজ্জনক চোরদেরকে নিজের অজান্তে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে আমাদেরকে। অন্তত একজন স্বীকৃত দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই। 
 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আমলাদের দুর্নীতি কেন হিসেবের বাইরে?

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৭ জুন, ২০২৪


Thumbnail

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের বিবরণ দেখিয়ে জনগণ শীর্ষে উঠছে। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির বিবরণে মানুষ হতবাক। তাদের যে অঢেল সম্পদ রয়েছে সেই সম্পদের হিসেব কষতে কষতে মানুষ যেন অঙ্কই ভুলে গেছে। এরকম বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে যে, সরকারি কর্মচারী বা সরকারি চাকরি কি তাহলে সোনার হরিণ? সরকারি চাকরি পেলেই কি তাহলে আলাদিনের চেরাগ পাওয়া যায়? 

কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে, সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন ক্যাডারে কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হলেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতিবাজ তাদের দুর্নীতির কথা গণমাধ্যমে আসছে না। এটির একাধিক কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হল যে, প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতা এবং প্রভাব। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের দ্বারা এবং অন্যান্য জায়গায় তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই যে তাদের দুর্নীতির কাহিনী গণমাধ্যমে আসছে না। অথচ অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, বেনজীর আহমেদ বা মতিউর রহমানের দুর্নীতি প্রশাসন ক্যাডারের অনেক সাবেক কর্মকর্তার দুর্নীতি তার চেয়েও বেশি। তারা কৌশলে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র গুলো বলছেন, সাবেক একজন সচিব যিনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি এখন স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাস করছেন। সেখানে তার বিপুল বিত্ত এবং বিনিয়োগের খবর পাওয়া যায়। 

সরকারি আরেকজন কর্মকর্তা যিনি ব্যাংকিং সেক্টরের দায়িত্ব পালন করতেন, তিনিও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। এখন তিনি লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনিও সেখানে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। 

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মন্ত্রী থাকাকালীন সময় বলেছিলেন যে, কানাডার বেগম পাড়ায় আমলাদের বাড়ি-ঘর বেশি। রাজনীতিবিদের বাড়ি-ঘর কম। 

বাংলা ইনসাইডারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত ১৭ জন সাবেক আমলার বাড়ি-ঘর রয়েছে কানাডার বিভিন্ন রাজ্যে। এই সমস্ত সম্পদগুলো তারা বৈধ ভাবে তৈরি করেছেন এমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্তত ৩ জন সাবেক আমলার খবর পাওয়া গেছে যারা দুবাইতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বানিয়েছেন এবং সেখানে তারা বিভিন্ন রকম ব্যবসা করছেন। বাংলাদেশে তারা খুব কম সময় থাকেন। বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মধ্যে একটা অদ্ভূদ জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে তারা দেশে কম সম্পদ রেখেছেন। তাদের বিত্ত সম্পদের একটা বড় অংশ বাইরে পাচার করে দিয়েছেন।

অনেকে মনে করেন বেনজীর আহমেদ বা মতিউর রহমান যেমন দেশে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা তেমনটি করেননি। বরং তারা তাদের সমস্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছেন বিদেশের মাটিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সাবেক আমলাদের। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছেন না, তাদের সম্পদ নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে না।

আমলা   দুর্নীতি   কানাডা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আবার চুক্তির হিড়িক: প্রশাসনে অস্বস্তি

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৬ জুন, ২০২৪


Thumbnail

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছিল। বেশ কয়েক জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অবসরের পর তাদের স্থলে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতিতে ফিরে গেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চলতি মাসে অন্তত দুটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। আরেকটি প্রজ্ঞাপন খুব শিগগিরই জারি হবে বলে জানা গেছে।

ইতোমধ্যে গত ৯ জুন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকারকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরীকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১ জুলাই থেকে তার এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কার্যকর হবে বলে দায়িত্বশীল সুযোগ নিশ্চিত করেছে। 

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে এক বছরের জন্য আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি হবে তার জন্য দ্বিতীয় মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এমনিতেই নেতিবাচক একটি মনোভাব রয়েছে। বিনা কারণে বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ফলে একদিকে যেমন প্রশাসনের জট তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে মেধাবী এবং তরুণরা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও মনে করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন যে, একজন সচিবের যখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় তখন সেই ধারাবাহিকতায় অন্তত ৭ থেকে ১০ জনের পদোন্নতি ব্যাহত হয়। এইভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রশাসনের তরুণ ক্যাডাররা। 

উল্লেখ্য যে, ১৫ তম ব্যাচের একজন দু জনকে ইতোমধ্যে সচিব করা হয়েছে। ১৫ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে এখন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্যদিকে ১৫ তম ব্যাচের একজন এবার সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে আরও কয়েকজনের সচিব হওয়ার কথা। কিন্তু এইভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জট আবার নতুন করে তৈরি হওয়ায় তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। এটি তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। 

প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, তারা মোটা দাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে। আবার যখন একজন সরকারি কর্মকর্তা তার চাকরির শেষ প্রান্তে উপনীত হচ্ছেন তখন তিনি চুক্তির জন্য মরিয়া হচ্ছেন। 

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের বিষয়টি আলাদা। এটি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়াধীন বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাজের ধরন একটি বিশেষায়িত এবং এই কাজের অভিজ্ঞতা দরকার। বাইরে থেকে হুট করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হলে তিনি যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করতে নাও পারেন। এ রকম বিবেচনা থেকেই হয়তো তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক বছর এই ‍চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলে মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, যিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি স্বাভাবিকভাবে মুখ্য সচিব হবেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কাজের গতিতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের সঙ্গে যুক্ত। এ রকম বিবেচনা থেকে হয়তো তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে অবসর দিয়ে বাইরে থেকে নতুন কাউকে মুখ্য সচিব করার ঝুকি নিতে চায়নি সরকার। কিন্তু অন্যান্য সচিবদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তুলেছে। এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে প্রশাসনে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ   প্রশাসন  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন