ইনসাইড থট

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’


প্রকাশ: 20/03/2022


Thumbnail

আমি পশ্চিমা টিভি চ্যানেলগুলি ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করছি, সংবাদপত্র এবং মিডিয়া আউটলেটগুলি পড়ছি যা ইউক্রেন যুদ্ধের খবরে পূর্ণ; যারা জেলেনস্কিকে একজন নায়ক বানিয়েছে এবং পুতিনকে একজন শয়তান যুদ্ধাপরাধী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করছে। কে কষ্ট পাচ্ছে বা যুদ্ধের শিকার হচ্ছে? শুধুমাত্র নিরীহ ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ এবং এর অবকাঠামো ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার সাধারণ মানুষ ভুগছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও সমস্যার সম্মুখীন হবে। দ্য গার্ডিয়ান, যুক্তরাজ্যের একটি প্রগতিশীল সংবাদপত্র, তার সাপ্তাহিক জার্নালে "পশ্চিমী সভ্যতার উপর যুদ্ধ" (A War on Western Civilisation) কভার পৃষ্ঠার এই শিরোনামটি দিয়েছে। মনে হতে পারে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অন্যান্য যুদ্ধগুলি সভ্য বিশ্বে না হওয়ায়, তা নিয়ে অবাক বা চিন্তা করার কিছু নেই, সেই যুদ্ধগুলি ন্যায়সঙ্গত হতে পারে!! এটি দেখায় যে পশ্চিম মেডিয়া কতটা নিরপেক্ষ বা সত্যবাদী হতে পারে!! মাটির বা ক্ষেত্রের বাস্তবতা প্রতিফলিত করে, পূর্বের প্রেস গুলোর পশ্চিমা প্রেসের প্রচারণার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অর্থ বা ক্ষমতা নেই। নিজস্ব নিরপেক্ষ যাচাইকৃত খবরের জন্য প্রেস বা সাংবাদিক যুদ্ধক্ষেত্রে রাখার ক্ষমতা বা অর্থ কারোরই না থাকার কারনে বাংলাদেশের সংবাদপত্র গুলো হয় পশ্চিমা সংবাদপত্রের লেখা বিস্তারিতভাবে অনুলিপি করছে বা পশ্চিমা সংবাদপত্র থেকে যা পাচ্ছে তা বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো সত্যতা যাচাই করার কোনো ক্ষমতা না রেখেই সেসব তথ্য প্রতিফলিত করছে বা লিখছে। সব সংবাদপত্রে পশ্চিমা কাগজের মতামত লিখছে। যা দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা প্রেসের শক্তিকে প্রতিফলিত করে।

৯/১১ এর পরে, পশ্চিমের স্বঘোষিত সভ্য বিশ্ব এবং তার প্রচার যন্ত্রগুলি বিশ্বকে বিভক্ত করেছিল "হয় আপনি আমাদের সাথে বা তাদের সাথে" গ্রুপে। অন্য কথায় হয় তথাকথিত তাদের সভ্য জগৎ (তাদের পৃথিবী) অথবা তাদের চিহ্নিত দানবদের সাথে থাকা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে কোনো বিকল্প না থাকায়, তারা পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলাতে বাধ্য হয়েছিল বা তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা কি সত্যের প্রতিফলন করতে পেরেছি যখন কলিন পাওয়েল নিরাপত্তা পরিষদে টেস্টটিউব দেখিয়েছিলেন এবং মিথ্যাভাবে দাবি করেছিলেন যে ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে, কেউ কি এর বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস করেছিল? একটি দরিদ্র দেশ যারা এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, আমেরিকান প্রতিনিধি সেই দেশকে হুমকি দিয়ে বলেছিল যে "আপনার দেশ আজ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল একটি ভোট দিয়েছে"। এমনকি যখন শুধুমাত্র ফ্রান্স একটি ভেটো ক্ষমতার দেশ মার্কিন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল এবং “ ফ্রেঞ্চ ফ্রাইকে” “স্বাধীনতা ফ্রাই” বলে ডাকতে শুরু করে। আমরা কি একই অবস্থা বা একই খেলা আবার দেখছি না?! এটিই হল আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মানবতার প্রতি তাদের শ্রদ্ধার নামে তাদের খেলা। তাদের সমর্থনে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোও একই ভাবে তাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছে বা যাবে। বাস্তবতা হল যে কোন মূল্যে তারা তাদের স্বার্থ আর আধিপত্য রক্ষা করছে এবং করবে।

কয়েক দশকে ফিরে যাওয়া যাক। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশিরা তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি নিষ্ঠুর নৃশংস শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল এবং আমেরিকার সর্বশক্তিমান সপ্তম নৌবহর আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছিল সে সময়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনও সুপার পাওয়ার ছিল এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। সেই ভেটো এবং সেই সমর্থন ছাড়া আমাদের সংগ্রাম ও দুর্ভোগ অনেক দীর্ঘায়িত হতো। সেই সময়টা ছিল বাইপোলার ওয়ার্ল্ড। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন একটি স্বীকৃত শক্তি ছিল। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। চীন তখন প্রকৃতপক্ষে সর্বশক্তিমান পরাশক্তি ছিল না। বিশ্ব এক মেরুতে পরিণত হয় এবং পশ্চিমা আধিপত্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, শাসন ও মানবতার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা না করে এবং মিথ্যা অজুহাতে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া আক্রমণ ও দখল করা হয়েছিল। হাজার হাজার নিরীহ নারী, শিশু ও পুরুষকে হত্যা করা হয়। বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল কিছুই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা সার্বভৌম দেশ দখল করে রাখে। তখন রাশিয়া ও চীন ছিল নিড়ব দর্শক। অনেককেই জোর গলায় বলবে কেন বার বার অতীত নিয়ে আসি, বলবে চলুন বর্তমান নিয়ে কথা বলি এবং এগিয়ে যাই। তাহলে আমাদের কি ঔপনিবেশিক আমলের নৃশংসতা, ক্রীতদাসের ইতিহাস, জাপানে পারমাণবিক হামলা, নিরপরাধ ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার কথা ভুলে যেতে হবে? কখনো না। অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে কিভাবে সভ্যতাগুলো এগিয়ে যেতে পারে? ইউক্রেনের জন্য এখন আমাদের অগ্রাধিকার হল কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে একে অপরকে সম্মান করে সংঘাত বন্ধ করা, ধ্বংস বন্ধ করা এবং উভয় পক্ষের নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেওয়া বন্ধ করা। Sanction, SWIFT , dollar, সম্পত্তি দখলের হুমকি বা যুদ্ধ নয়, চাই শান্তি।

এখন আবার রাশিয়া, বিশেষ করে চীন এমন একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা স্বীকৃত ও পশ্চিমা শক্তি ভয় পাচ্ছে। একক সুপার পাওয়ারের আধিপত্য আর নেই। তাই একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে, আমরা কী চাই পশ্চিমা আধিপত্য সহ একটি একপোলার বিশ্ব? কিংবা আমরা চাই একটি বাইপোলার বা ত্রিমেরু বিশ্ব, যেখানে শক্তির ভারসাম্য থাকবে এবং আমাদেরকে বার বার বলির ভেড়ার বাচ্চা হিসাবে দেখা হবে না, আমরা কোনও পক্ষ নিতে বাধ্য হব না? একটা স্বাধীনদেশ হিসাবে আমাদের দেশ এবং এর জনগণের জন্য কোনটি সেরা তা বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। সব চাপ আর শক্তির বিরুদ্ধে ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা (BRICS ভক্ত দেশ), বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি দেশ নিরপেক্ষ থাকার জন্য তাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। কূটনীতি এবং আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাটি সমাধান করার এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কিছু দেশ আন্তর্জাতিক শাসন, সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের রক্ষার নামে উভয় পক্ষকে আরও বেশি সংখ্যক অস্ত্র দিয়ে একটি প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচছে। আমরা কি ভেবে দেখতে পারি এই যুদ্ধে কে বা কারা সব চেয়ে লাভবান হচ্ছে বা হতে পারে? কে কাকে আধিপত্য করতে চায়? স্বার্থবাদীরা কি আলোচনা ও কূটনীতিকে এগিয়ে যেতে দেবে এবং জীবন রক্ষা করবে ও ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করবে? এই সংঘাতে কেউ বিজয়ী হবে না কিন্তু ইউক্রেন ও রাশিয়ার নিরীহ মানুষ, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অধিকন্তু তেল, গ্যাস, সার, খনিজ ও শস্যের ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্যের কারনে মুদ্রাস্ফীতি এবং দৈনন্দিন পণ্যের মুল্য বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আরও বেশি লোককে হত্যা করতে পারে এবং তাদের আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।

জাতির পিতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শুরু করেন ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কুৎসিত দিক আর নিষ্ঠুরতা দেখেছি, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা সম্প্রীতির সাথে বাঁচতে চাই, দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে চাই, তাদের আশা ও সমৃদ্ধি দিতে চাই। আমরা সকলের কাছ থেকে চাইব আপনারও বাঁচুন আর আমাদেরকেও মর্যাদার সাথে বাঁচতে দিন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭