বাংলাদেশ বড় দুটি নদী দিয়ে বিভক্ত। সেতু দিয়ে এ দেশটাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর একটি যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু, অপরটি পদ্মা নদীর উপর নবনির্মিত 'পদ্মা সেতু'। যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অপরটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। এ বড় দুটি কাজই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বাঙালির গৌরবের প্রতীক ‘পদ্মা সেতু' এখন বাস্তবতা। অপেক্ষা উদ্বোধনের। আগামী ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। সম্প্রতি একটি টিভি অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান জানালেন পদ্মাসেতুর নেপথ্য কথা।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাপান সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি যেসব প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগের কথা বলেন, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু ছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে জাপানের অর্থায়নে ঐ সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পরে সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বাংলাদেশ সরকার প্রথমে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে অর্থায়নের জন্য অনুরোধ করেছিল। এ দুই প্রতিষ্ঠান প্রথমে অস্বীকৃতি জানায়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক মৌখিকভাবে এবং বিশ্বব্যাংক চিঠি দিয়ে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৯৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরকালে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরন করে জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে কয়েকটি প্রকল্পে অর্থায়ন করার জন্য অনুরোধ করেন। তার মধ্যে পদ্মা সেতুও ছিল। একই বছরের শেষ দিকে জাইকা এবং জাপানের কর্মকর্তারা জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের নাম জানতে চাইলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের জন্য গুরুত্বারোপ করেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, আমাদের সাধারণ মানুষের চারদিকে যা আছে, তার বাইরে দৃষ্টি যায় না। দেশের নেতৃত্ব যারা দেবেন, তাদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনন্য।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে বরিশাল-পটুয়াখালী-খুলনা-যশোহরের কথা চিন্তা করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। খুলনাতে যেতে ছয় ঘণ্টা লাগবে। তেমনি বরিশাল বা পটুয়াখালী যেতে ছয় বা সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগতে পারে। তাহলে রাজধানীতে সব মানুষ দ্রুত যেতে পারবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। ফলে ঐ সকল এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। ইত্যাদি বিবেচনায় পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নে জাপান আগ্রহী হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ফিরে এলো। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রথমে এটাকে ফিজিবিলিটি করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় বিশ্বব্যাংক, জাইকা এবং তার পরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকেরও কিছু অংশ ছিল।
পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক, জাইকা এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কতিপয় তথাকথিত সুশীলদের প্ররোচনায় দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনে ২০১২ সালের জুলাইয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে। তারই ধারাবাহিকতায় জাইকা এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও অর্থ সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রথম কাজ শুরু হয়।
কিন্তু একটু পেছন ফিরলে দেখা যায় এ সেতু ঘিরে চলে নানা ষড়যন্ত্র। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু, এ (সেতু) আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। জোড়াতালি দিয়ে বানানো সেতুতে, কেউ উঠবেও না‘।
রাজনৈতিক বিরোধিতার সুরে তাল মিলিয়ে কথা বলেন কয়েকজন সুশীলও। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার পদ্মা সেতু নিয়ে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে‘।
বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনুসকে সরিয়ে দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে,
গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ কুক্ষিগত করার হীন উদ্দেশ্যে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস উনার আমেরিকান বন্ধুদের সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংককে দিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করান এবং বিশ্বব্যাংক থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত ঋণ বাতিল করান। ‘এযেন নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা‘র মত।
সরকার সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করায় দুঃখ পান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
পদ্মা সেতুবিরোধী নানা মহলের সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে। শেষমেশ বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টাকে, দেড় মাস জেল খাটেন সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন সাহেব, ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি পদত্যাগই করতে হয় তখনকার মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবকে। দফায় দফায় তাদের হাজিরা দিতে হয় দুদকে।
সবশেষে আন্তর্জাতিক আদালতে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কল্পিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হতে সময় লাগেনি বেশিদিন। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দেন কানাডার আন্তর্জাতিক আদালত। রায়ে বলা হয়, ‘পদ্মা সেতুতের দুর্নীতির অভিযোগ গালগপ্প ছাড়া কিছুই নয়‘।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের সকল বেড়াজাল ছিন্ন করে, শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। উদ্ধোধনের অপেক্ষায় বাঙালির গৌরবের প্রতীক 'পদ্মা সেতু'
পদ্মা সেতু দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। গাড়ি পারাপারে টোল আদায়ের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতুর ব্যয় ওঠাবে সরকার। টোলের একটি প্রাথমিক হারও নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। তথ্যমতে, টোলের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তির স্বার্থে। সরকারের উচ্চ পর্যায় চাইলে এটা পরিবর্তন করতে পারে। তাই প্রস্তাবিত টোলের হার চূড়ান্ত বলা যাবে না।
কিন্তু এরই মাঝে ঐ একই গ্রুপ পুনরায় শুরু করেছেন সমালোচনা। দেশের উন্নয়ন যেন সহ্যই হয় না। এবার শুরু হয়েছে প্রস্তাবিত ‘টোল‘ নিয়ে সমালোচনা। কথায় আছে না ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা‘।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হলে কত টাকা টোল ধার্য করা উচিত, সে বিষয়ে দাতাদের শর্ত বা পরামর্শ থাকে। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নীতিমালা নেই। সাধারণত সেতু হওয়ার আগে ফেরিতে যে হারে টোল নেওয়া হয়, সেতুতেও সেই হারে টোল নির্ধারণ করে থাকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। সেতু নির্মাণের জন্য তাদের ঋণ হিসাবে টাকা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকার যথাসম্ভব টোলের হার সীমিত রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।
পদ্মা সেতু চালুর পর ১৫ বছরের জন্য সেতু বিভাগ একটি টোলের হার প্রস্তাব করেছে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানো হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেতু বিভাগের প্রস্তাবে।
সরকারের নির্ধারণ করা টোলের হার অনুসারে, বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যে টাকা লাগে, সেতু পার হতে এর চেয়ে গড়ে দেড় গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হবে। আর দ্বিতীয় দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের সঙ্গে তুলনা করলে তা হবে প্রায় দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতুর টোলের হার ঠিক আছে। এতে মানুষ যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি পচনশীল পণ্য পরিবহনেও ঝুঁকি কমবে।
এছাড়া ফেরিঘাটে টোলের বাইরে অদৃশ্য অনেক খরচ আছে। যেমন, লম্বা সময় ঘাটে আটকে থাকলে পরিবহনকর্মীদের একাধিক বেলা খাবারের খরচ হয়। আগে ফেরিতে ওঠার জন্য অবৈধভাবে অর্থ খরচ করতে হয়। সেতুতে তা হবে না। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়কপথে খুলনার দূরত্ব প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করলে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে ১৯০ কিলোমিটার। ৬৫ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাধারণত বেশির ভাগ বাস ডিজেলে চলে। এক লিটার ডিজেলের দাম ৮৫ টাকা। ৬৫ কিলোমিটার পথ কমে যাওয়ায় ঢাকা-খুলনা বাসে জ্বালানির খরচ কমবে প্রায় এক হাজার ৭৮৫ টাকা। ট্রাকে জ্বালানির খরচ কমবে এক হাজার ১৭০ টাকা, ট্রেইলারে দুই হাজার ৭৬৩ টাকা, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে ৫৭৯ টাকা এবং মোটরসাইকেলে জ্বালানির খরচ কমবে ১৩৪ টাকা।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোরের দূরত্ব বর্তমানের ২১২ কিলোমিটার থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে বাসে জ্বালানি বাঁচবে প্রায় ১৭ লিটার।
তবে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-বরিশাল যাতায়াতে দূরত্ব সাত কিলোমিটার বাড়বে। এতে বাসের জ্বালানি খরচ বাড়বে প্রায় ১৮০ টাকা।
সবকিছু বিবেচনা করে সরকার হয়তো নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে দেবে। তবে মালিকরা চাচ্ছেন ভাড়া বাড়ুক, যাতে পরিবহন ব্যবসা চালু থাকে।
সুতরাং বিআরটিএ যদি সঠিকভাবে বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, কিলোমিটার প্রতি ভাড়াটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে সব মানুষ পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে পারবে। সুফল ভোগ করতে পারবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের খরচ বঙ্গবন্ধু সেতুর চেয়ে বেশি। আবার এর দৈর্ঘ্যও বেশি। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু তৈরিতে সর্বশেষ হিসাব পর্যন্ত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এ কারণে পদ্মা সেতুতে টোল বেশিই হবে।