এডিটর’স মাইন্ড

‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!’


প্রকাশ: 09/07/2022


Thumbnail

আগামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আশা করেছিলাম এবার ঈদ হবে উৎসবমুখর। কিন্তু বেশ কিছু কারণে উৎসব মলিন, বিবর্ণ। হঠাৎ লোডশেডিং যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে লোডশেডিংয়ের কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট জমানায় বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসত। বেশির ভাগ সময় দেশ ডুবে থাকত অন্ধকারে। সারা দেশে ১২ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাফল্যের একটি- বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি। আওয়ামী লীগ কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেনি, সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় যেখানে দেশের মাত্র ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, বর্তমানে প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে এখন ফ্রিজ, টিভি, এয়ারকুলার আর বিলাসিতা নয়। প্রত্যেক মানুষের জীবনযাপনের অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়েছে। মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এ সময় নতুন করে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা মানুষ মেনে নিতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে লোডশেডিংয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাজারে জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে লোডশেডিং মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে গত ১৩ বছরের সব অর্জন এ কদিনে যেন উবে গেছে। আগে কী ছিল, এ নিয়ে কেউ আলোচনায় আগ্রহী নয়। বর্তমান সংকট নিয়েই জনগণ উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, অসন্তুষ্ট। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শুধু যে বাসাবাড়িতে সমস্যা হচ্ছে, তা নয়। বরং তার চেয়েও বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে শিল্পকারখানা ও কৃষিতে। শিল্পোদ্যোক্তারা গ্যাস পাচ্ছেন না। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিতে সেচের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা না হলে খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হবে। শঙ্কার কালো মেঘ যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকটের অবয়ব ফুটে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংকট পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি হলো প্রবাসী আয়। গত অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, প্রবাসী আয় প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে। তবে ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ঈদের আগে পাঁচ দিনে ৫ হাজার কোটির বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কিন্তু এও আশা জাগাতে পারছে না। প্রতিটি ঈদেই প্রবাসী ভাইবোনেরা আত্মীয়-পরিজনের জন্য বাড়তি টাকা পাঠান। এটি ধারাবাহিকভাবে না এলে আমাদের রিজার্ভে চাপ বাড়বে। সরকার নতুন অর্থবছর শুরুই করেছে কৃচ্ছ্র নীতির মাধ্যমে। আগেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। নতুন অর্থবছরে গাড়ি কেনা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের যে চাপ বাড়ছে এটা আর কোনো গোপন বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, এ চাপ কত দিন থাকবে? অর্থনৈতিক সংকট আর কত গভীর হবে? করোনা-পরবর্তীতে এমনিতেই স্বল্প আয়ের মানুষ সংকটের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। এখন অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্তকেও অন্ধকার টানেলে নিয়ে গেল। আওয়ামী লীগ সরকার যে টানা ১৩ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে তার বড় কারণ অর্থনীতি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা, নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্কের পরও সাধারণ মানুষ এ সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। এর বড় কারণ আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ বছরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে। দেশে কর্মমুখরতা বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের স্বপ্নের সীমাটা আওয়ামী লীগ অনেক বাড়িয়েছে। ফলে এখনকার সংকটটা জনগণকে অস্থির করে তুলেছে। ১০ বছর আগে যে লোকটি মাসে ১০ হাজার টাকা উপার্জন করত এখন তার মাসিক আয় ১ লাখ টাকা। কিন্তু নানা সংকটে তার আয় কমে যখন ৫০ বা ৬০ হাজারে নেমেছে, তখন সে আর চলতে পারছে না। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে লোভ, দুর্নীতি বেড়ে গেছে। যে কোনো উপায়ে ধনী হওয়ার এক উদগ্র ভয়ংকর নেশা কারও কারও মধ্যে ঢুকে গেছে। এরা নানা প্রতারণায় জড়িয়ে সমাজকে আরও অসুস্থ করে তুলছে। অনলাইন কেনাকাটায় দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, পি কে হালদারের হাজার কোটি লোপাটের কাহিনি, বিদেশে অর্থ পাচার, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়- অসুস্থ সমাজের নোংরা অর্থনীতির চিত্র। সমাজের নীতি-নৈতিকতা পর্যুদস্ত হচ্ছে ভ্রষ্ট উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে। এজন্যই শিক্ষাঙ্গনগুলোয় ভয়ংকর চিত্র। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো, শিক্ষককে হত্যা- শিক্ষাঙ্গনের দুর্ভাগ্যজনক চেহারাকে উন্মোচন করেছে। এ চিত্র শুধু সবখানে নয়, সর্বত্র। মানুষ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। ১৩ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার আগে এ রকম সর্বগ্রাসী চাপে পড়েনি। চারপাশ যেন বৈরী হয়ে উঠেছে এ সরকারের জন্য। ১৩ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলতে গেলে একাই তিনি সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। বন্যা মোকাবিলা থেকে দুর্নীতি বন্ধ। কৃষির উৎপাদন থেকে শ্রমিকের মজুরি সবকিছুই দেখভাল করতে হচ্ছে তাঁকে। দেশের অবস্থা আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া শিশুদের একটা খেলার মাঠও বেদখল হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন তাই এখনো মানুষ কিছুটা হলেও আশাবাদী। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। তাঁরা কেন দায়িত্বে আছেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জনগণ ক্লান্ত।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, বিশ্বজুড়েই এখন টালমাটাল অবস্থা। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে এক অস্থির-অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। কোনো দেশই ভালো নেই। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বিশ্বে অন্যতম অনিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন সেখানে গুলিতে ঝরছে নিরীহ প্রাণ। বাদ যাচ্ছে না শিশুও। জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। এত আবেদনহীন প্রেসিডেন্ট কবে যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। ভারতে চলছে নানামুখী সংকট। রুপির রেকর্ড অবনমন হয়েছে ডলারের বিপরীতে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ সেক্যুলার ভারতের চেহারাটা ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। নূপুর শর্মা একাই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছেন। ইউরোপজুড়ে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে ইউরোপ। সত্তরের মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা দানা বেঁধে উঠছে। উত্তপ্ত এ বিশ্ব পরিস্থিতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ভাবে না। বুঝতেও চায় না। তারা চায় সুখে-শান্তিতে থাকতে। আয়-উন্নতি বাড়াতে। চায় সহনীয় দ্রব্যমূল্য। স্বস্তিদায়ক সামাজিক পরিবেশ। সন্তানের নিরাপদ শিক্ষা। দুর্ঘটনামুক্ত যাতায়াত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে মানুষকে বেশিদিন আশ্বস্ত রাখা যাবে না। এ আওয়ামী লীগ সরকারই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮-এর বিশ্বমন্দা সামাল দিয়েছে। করোনার বিশ্ব সংকটের মুখেও অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবার পারছে না কেন? এর কারণ মন্ত্রী ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সীমাহীন অযোগ্যতা এবং দুর্নীতি। আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং আরও কিছু বাস্তবতা। বিদ্যুৎ সংকটের কথাই যদি আমরা একটু আলোচনা করি তাহলে ব্যর্থতার উৎস খুঁজে পারব। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে সত্যি কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তার দিকে জোর দেয়নি। তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানে যত মনোযোগী ছিল ততই উপেক্ষিত ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সরকার বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-দর্শন ও আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে।

জাতির পিতা ১৯৭৫-এর ৯ আগস্ট বিশ্বখ্যাত শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে তাদের মালিকানাধীন পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির শেয়ার ৪.৫০ মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে নেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার এক মাইলফলক। আওয়ামী লীগ সরকার জ্বালানি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কৌশলের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। গত ১০ বছরে সরকার নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান, বিদ্যমান কূপগুলো আধুনিকায়নে মনোযোগী ছিল না। এলএনজি আমদানির এক জুয়ায় মত্ত ছিল। এটি পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক জোড়াতালি। গ্যাস আমদানিতে কমিশন বাণিজ্যের লোভনীয় হাতছানিও ঝুঁকিপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলারা সরকারকে প্ররোচিত করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে না, এটি জাতির পিতা উপলব্ধি করেছিলেন। আমলারা উপেক্ষা করেছেন। আমলাতন্ত্রের একটি প্রবণতা হলো, যে কোনো সমস্যার গভীরে না যাওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে সংকটের সমাধান খোঁজা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন পর্যন্ত মানা হয়নি। এখন যখন বিশ্ববাজারে এলএনজির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তখন আমদানি সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। নির্বাচনের আগে সরকারকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

শুধু বিদ্যুৎ কেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধŸগতির পেছনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা সরকারের অর্জন বিবর্ণ করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী কখন কী বলেন তা যদি পরে তিনি শুনতেন তাহলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতেন। খুব কম ক্ষেত্রেই মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাতে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। বরং তাঁরা সব সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ওপর। মন্ত্রীদের কাজ শুধু বক্তৃতা আর ফিতা কাটায় বন্দি হয়ে আছে। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এবারের মতো এত অনুজ্জ্বল মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগ আগে কখনো গঠন করেনি। মন্ত্রীরা পালাক্রমে বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারের রাজনৈতিক চেহারা নেই। আওয়ামী লীগ নেতারাই মনে করেন দেশ আমলারা চালাচ্ছেন। আমলারা ভবিষ্যৎ ভাবেন না। জনপ্রিয়তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। হেভিওয়েট জনপ্রিয় নেতারা সাইডলাইনে বসে তামাশা দেখছেন। নির্বাচন তাঁদের পরিকল্পনায় জায়গা পায় না। তাঁরা আজ এবং বর্তমান নিয়েই শুধু ভাবেন। নিজেদের স্বার্থ তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। আমলাদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি করছে। অনেকেই আখের গুছিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছেন। ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, পাতিনেতা এমনকি সিকিনেতাও জনগণকে চাকরবাকর ভাবতে শুরু করেছেন। বড় হলে উদার হতে হয়। নত হতে হয়। বিনয়ী হতে হয়। এটা আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ভুলে গেছেন। কোথাও কোথাও এমন উদ্ধত আচরণ করা হচ্ছে যে তাতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত, হতাশ। অন্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সমমনা দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ দূরত্ব তৈরি করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করার প্রবণতা বেড়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ একলা। দলে নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগীরা কোণঠাসা। কেউ কেউ হতাশ হয়ে দূরে সরে গেছেন। এ অবস্থায় ক্রমে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামাল দিতে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই প্রশাসননির্ভর। দুঃসময়ের কর্মীরা কি আবার কোনো সংকটে মাঠে নামবে? কেন নামবে? এসব প্রশ্ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের সফল কূটনীতি গত তিন বছরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কূটনীতির ভাষার বদলে একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাড়া-মহল্লার আড্ডার ভাষায় বয়ান দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ রকম একজন ‘আনডিপ্লোম্যাটিক’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কবে পেয়েছে বাংলাদেশ! যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আগামী নির্বাচন ঘিরে সরব। ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা একযোগে নির্বাচন কমিশনে গেছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন তাঁরা অংশগ্রহণমূলক চান। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ চান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কি বৃহত্তর গণতন্ত্রের পথে এগোবে নাকি কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার দিকে এগোবে।’ এর বিপরীতে বাংলাদেশের নীতি ও কৌশল ধোঁয়াশে, অস্পষ্ট।

সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের মাত্র দেড় বছর আগে এক উত্তাল সাগরে আওয়ামী লীগের অভিযাত্রা। সাগর ক্রমে বৈরী হয়ে উঠছে। ১৩ বছরের অর্জন যে এক লহমায় বিলীন হয়ে যায়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ নিয়ে আওয়ামী লীগ গর্ব করত। এখন এ বিদ্যুৎই যেন গলার ফাঁস হয়ে গেছে। ২০০১-২০০৮-এর অবস্থায় আবার ফিরে যাচ্ছি আমরা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কী ছিল তা এখন বলে লাভ নেই। খাম্বা কাহিনিতেও মানুষ সান্ত¡না খুঁজবে না। আজকের সংকটের সমাধান চায় মানুষ। ১৩ বছরে এ দেশের অর্জন অনেক। অবিশ্বাস্য। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল উন্নয়নের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে আছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু এসব অর্জন নিয়ে জনগণ উদ্বেলিত হবে না, যদি লোডশেডিং না থামে। যদি বাজারের আগুন বন্ধ করা না যায়। কিশোর গ্যাংয়ের দাপট না কমে। ক্ষমতাসীনদের অহংকার, দুর্নীতি, টাকা পাচার, সামাজিক অবক্ষয় মানুষকে অস্থির করে তুলছে। বাংলাদেশের জনগণের গোল্ডফিশ মেমোরি। অতীত খুব সহজেই, খুব দ্রুত ভুলে যায়। ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকার বেদনা ভুলে গেছে। তারেক জিয়ার হাওয়া ভবন ভুলে গেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ভুলে গেছে। বাংলা ভাই ভুলে গেছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র ভুলে গেছে। পূর্ণিমা-ফাহিমার ধর্ষণ ভুলে গেছে। মসজিদে ঢুকে হত্যা মনে রাখেনি। মনে রাখেনি দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের তান্ডব। অতীত নয়, বর্তমান নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। বর্তমান বাস্তবতায়ই মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকেই চলমান সংকটগুলোর সমাধান করতে হবে। আর এ সংকট এখন এ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে, তৃতীয় মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান অবস্থা দেখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু...’ গানটি মনে পড়ছে খুব বেশি করে। এ গানের একটি পঙ্ক্তি এ রকম ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!’

তবে আমাদের আশা-ভরসার জায়গা একটাই। শেখ হাসিনা। সব সংকট তিনি সমাধান করেন আপন মেধায়, দূরদর্শিতায়। যেখানে ঘোর অনিশ্চয়তার অন্ধকার সেখানে তিনি সম্ভাবনার আলো জ্বালান। বর্তমানে ধেয়ে আশা সমস্যাও তিনি সমাধান করবেন, এখনো দেশবাসী এটা বিশ্বাস করে। এজন্যই ক্ষোভ, দুঃখ-হতাশার পরও জনগণ অপেক্ষা করছে শেখ হাসিনার আরেকটি ম্যাজিকের। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের একমাত্র কান্ডারি। নিশ্চয়ই তিনি এ সংকটের উত্তাল তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেবেন সুবর্ণ বন্দরে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
Email: poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭