কালার ইনসাইড

ভার্চুয়াল বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে চলচ্চিত্রের ক্ষতি করছি নাতো?


প্রকাশ: 05/08/2022


Thumbnail

বেশ লম্বা সময় ধরেই চলচ্চিত্রের অবস্থা বেশ খারাপ। নেই ভালো মানের সিনেমা, দর্শক হচ্ছেন হল বিমুখ। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। সবকিছু মিলিয়ে এক ক্রান্তিকাল পার করছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। তবে এইবার ঈদে অন্ধকারে কিছুটা আলোর দেখা মিলেছে। এবার ঈদে ছবি মুক্তির পর বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে দর্শক মহলে।

প্রেক্ষাগৃহগুলো অধিকাংশই হাউজ ফুল। টিকেট বুকিং হয়ে থাকছে অগ্রিম। অনেকেই টিকিট না পেয়ে ব্ল্যাকেও টিকেট কিনছেন। সিনে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরে আসছে। তবে এত আনন্দের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা। সিনেমার এই সুসময়কে অনেকাংশেই ম্লান করে দিচ্ছে ভার্চুয়াল বাকবিতণ্ডা। গত রোজার ঈদে চলচ্চিত্রের নানা ফেসবুক গ্রুপে ভক্তদের বাকবিতণ্ডা থাকলেও এবার সেই কাতারে নাম লিখিয়েছেন তারকারাও।

দীর্ঘ আট বছর পর অনন্ত জলিল ও বর্ষা জুটি নতুন সিনেমা নিয়ে হাজির হয়েছেন। গত ১০ জুলাই দেশের ১১৫টি হলে মুক্তি পেয়েছে তাদের অভিনীত ‘দিন দ্য ডে’ সিনেমাটি। মুক্তির পর থেকেই প্রতিদিন বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। অনন্তের প্রতিটি সিনেমার নায়িকা কেন বর্ষা, এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আর সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বর্ষা বলেন, কী টাইপের নায়িকা আপনাদের পছন্দ? সেই নায়িকা পছন্দ- যারা পেটে সন্তান নিয়ে কিংবা সন্তান প্রসব করে হাইডে (আড়ালে) থাকে? নাকি যারা হিরোইন, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা নিয়ে ধরা পড়ে পুলিশের হেফাজতে থাকে? যেসব নায়িকা বিয়ের শাড়িটাও স্পন্সর নিয়ে পরে তাদের পছন্দ? তাদেরকে অনন্ত জলিলের সঙ্গে মানাবে? আমি সেই গ্রেডের নায়িকা না। আমি আমার জায়গায় আছি।

বর্ষার এমন মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই কাতারে ছিলেন ‘পরাণ’ সিনেমার নায়িকা বিদ্যা সিনহা মিম। তিনি বলেন, প্রথমেই বলে রাখি আমার বিয়ের ড্রেস আমার নিজের টাকায় কেনা। আমি মনে করি ইন্ডাস্ট্রিতে যারা কাজ করে তাদের নিয়ে কিছু বলতে গেলে ভেবেচিন্তে বলতে হয়।

তিনি আরও বলেন, সকল কো-আর্টিস্টকে সম্মান দিয়ে কথা বলা শিখতে হয়। এটাই আসল বিষয়। সবাইকে একসঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। আমি আপনার বদনাম করলাম, আপনি আরেকজনের বদনাম করলেন। এটা তো ঠিক না। আমি আমার পরিবার থেকে এসব শিক্ষা পাইনি।

এদিকে, ঈদের পর মুক্তি পেয়েছে নতুন চলচ্চিত্র 'হাওয়া'। এই ছবির মূল অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী নিজেও জড়িয়েছেন বাকবিতণ্ডায়। তিনি সিনেমা মুক্তির দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হাওয়া’ পিওর বাংলাদেশের সিনেমা। বাংলাদেশে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ নকল সিনেমা তৈরি হয়েছে। এখনও সেই স্টাইল ফলো করে অনেকে নির্মাণ করছেন। ‘হওয়া’ যারা দেখবেন, আপনারা সত্যি সত্যি যদি সিনেমা বুঝেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে, ‘হাওয়া’ সিনেমা পিওর বাংলাদেশের সিনেমা।

নিজের সিনেমার প্রশংসা করতে গিয়ে ছোট পর্দার এই অভিনেতার বড় পর্দার সব সিনেমা নিয়ে আক্রমণমূলক মন্তব্যে বেশ সরব হয়ে উঠেন অনেকেই। বড় পর্দার সব সিনেমা নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। চঞ্চলের এমন মন্তব্য নিন্দা জানিয়েছেন অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা।

চঞ্চল চৌধুরীর বক্তব্যর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা সায়মন তারিক এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, কাউকে ছোট করে বড় হওয়া যায় না। গত দুদিন আগে টেলিভিশন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ‘হাওয়া’ সিনেমা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, এত দিন এদেশে নকল সিনেমা নির্মাণ হত। নকলের যুগ শেষ। ‘হাওয়া’ সম্পূর্ণ নতুন গল্পের সিনেমা। এই রকম সাবজেক্ট নিয়ে এদেশে আর কোন সিনেমা নির্মাণ হয়নি। আমি সবিনয়ে চঞ্চল চৌধুরীর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাই। ‘হাওয়া’ নতুন কোন গল্পের সিনেমা নয়। আশির দশকে নায়ক রাজ রাজ্জাক ‘অভিযান’ নামে যে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন ‘হাওয়া’ সিনেমাটি তারই কপি গল্প। ‘অভিযান’ সিনেমাটির পুরো গল্প ছিল ট্রলারে। মৎস্যজীবীদের নিয়ে। তাদের জালেই ধরা পরে রোজিনা। রোজিনাকে ঘিরেই গল্প এগিয়ে চলে। ‘হাওয়া’ সেই গল্পের অনুকরণে নির্মিত সিনেমা।

তিনি আরও লিখেন, আজ সুমন যে ‘হাওয়া’ বানিয়েছেন তার অনেক আগেই রাজ্জাক সাহেব এমন সিনেমা বানিয়ে দেখিয়েছেন। চঞ্চল চৌধুরীর মতো অভিজ্ঞ অভিনেতার কাছে এমন মন্তব্য আশা করিনি। নিজের অভিনীত সিনেমার প্রচারণা করতে গিয়ে দেশের মুক্তিপ্রাপ্ত সব সিনেমাকে ছোট করে কথা বলা নেহায়েতই হীনমন্যতার প্রকাশ।

চলচ্চিত্র নির্মাতা দেওয়ান নাজমুল বলেন, চঞ্চল চৌধুরী কে? এমন প্রশ্ন আসলে লক্ষ কোটি মানুষ বলবে সে নাটকের মানুষ। এটাই তার পরিচয়। হঠাৎ করে সিনেমায় নাম লেখিয়ে ২-৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তবুও দর্শক কিন্তু এখনও তাকে নাটকের লোকই বলেন। চঞ্চল চৌধুরী একজন নন্দিত নাটকের নায়ক, পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন অভিনেতা। আপনার কাছে আমরা নন্দিত কথা আশা করব।

প্রশ্ন রেখে তিনি আরো বলেন, আপনার আগের সিনেমাগুলো কি নকল ছিল? আপনার সিনেমা ছাড়া অন্য কারো সিনেমা কি আপনি দেখেন? দয়া করে আমাদের নায়ক রাজ রাজ্জাক স্যারের ‘অভিযান’ দেখবেন। তা হলে আপনার কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। দয়া করে নিজেকে বড় করতে গিয়ে চলচ্চিত্রের অন্যকে ছোট না করার অনুরোধ রাখছি।

চলচ্চিত্র নির্মাতা এম.এন ইস্পাহানী, সৈকত নাসির, চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, সংলাপকার আবদুল্লাহ জাহির বাবু সহ আরো অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা চঞ্চল চৌধুরীর কথার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসে দিয়েছেন।

এ ছাড়া ‘হাওয়া’র অভিনয়শিল্পী সুমন আনোয়ার ফেসবুকে লেখেন, মেধাশূন্য আর দখলদারিত্বের রাজত্বে নতুন হাওয়া বইছে, বাংলার আপামর মানুষ মেধাবীদের বুকে টেনে নিয়েছে, পরচর্চা আর ঈর্ষান্বিত না হয়ে আপনার মেধার বিকাশ ঘটান।

তার এমন স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে চিত্রনায়ক জয় চৌধুরী ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মেধাশূন্য কাদের বলেছেন আর দখলদারিত্বের কথা কাকে বলেছেন সেটা হয়তো অনেকের বুঝতে অসুবিধা হবে না! আপনারা নিজেদের সুশীল বলে বলে গলা ফাটিয়ে এই তার নমুনা!

তিনি আরও লিখেছেন, এমন অহংকার করে অন্যদের ছোট করে কথা আমরা চলচ্চিত্রের লোকেরা কখনও বলি না। আর এটা ভুলে যাবেন না, যে চলচ্চিত্রটি নিয়ে গর্ব করছেন সেটাও গতানুগতিক একটি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রোডাকশন হাউস থেকেই রিলিজ করেছেন। না হলে ঘরে বসে চা খেতে খেতে দেখতে হতো আপনার সিনেমাটা।

এই সব বাকবিতণ্ডার মাঝেই নতুন করে যুক্ত হন ‘হাওয়া’ সিনেমার চিত্রনায়িকা নাজিফা তুষি। মুক্তির প্রথম দিন থেকে সিনেমার প্রচারে হাওয়া টিমের সঙ্গে বিভিন্ন হলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নাজিফা তুষি। সেই ধারাবাহিকতায় শ্যামলী স্কয়ারে যান তিনি। সেখানে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন নাজিফা তুষি। কিন্তু কথা বলার আগে তিনি পাশে থাকা ‘পরাণ’ ও ‘দিন : দ্য ডে’ সিনেমার পোস্টার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। কেবল নিজের সিনেমা ‘হাওয়া’র পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়েই তিনি কথা বলবেন বলে জানান। এরপর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার এমন কর্মকাণ্ডে সমালোচনা করছেন। শোবিজের মানুষেরাও বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এমনকি নায়িকা পরীমনিও তার ফেসবুকে লিখেছেন প্রতিবাদ জানিয়ে।

বিষয়টি নিয়ে তুষি বলেন, আমি ভাবতেও পারছি না একটা ছোট্ট এবং সহজ বিষয়কে এভাবে প্রকাশ করা হবে এবং এ ধরনের রিঅ্যাক্ট আসবে। আমি ইনটেনশনালি কিছু করিনি। সিম্পল জিনিসকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে লোকজন! আমি সত্যি অবাক এগুলো দেখে।

ভার্চুয়াল এমন বাকবিতণ্ডায় চলচ্চিত্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। নিজেদের মাঝে একাত্মতা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার মন মানসিকতা না থাকলে চলচ্চিত্রের অবস্থা কখনোই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না বলে মনে করছেন তাঁরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭