ইনসাইড টক

‘পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কখনো সিরিয়াসলি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি’


প্রকাশ: 11/08/2022


Thumbnail

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেছেন, সরকার পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনবে কিংবা উদ্যোগ গ্রহণ করবে, অর্থপাচার রোধ করা হবে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রতি বছর বাজেটের সময় বলা হয়। কিন্তু আমরা সেটা কতটুকু করতে পেরেছি সেটা দেখার বিষয়। আমাদেরও অনেক সমস্যা আছে। সংশ্লিষ্টরা সন্দেহাতীতভাবে জানেন যে, আসলে অর্থ পাচারকারী কারা। সুনির্দিষ্ট করে যদি অর্থ পাচারকারীদের বলা হয়, আপনি অর্থ পাচার করেছেন, আমাদের হিসেবে মতো আপনি এত টাকা পাচার করেছেন, এখন এটা ফেরত আনেন। এবং সেটা জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ও তাদের বেঁধে দিতে হবে। আমি এক হিসেব করে দেখেছি, গত ৪০ বছরে অর্থ পাচারের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকার মত। প্রথমত, অর্থ পাচার সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। এটা একটা অপরাধ। যেকারণে এখানে আইনি সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত না। দ্বিতীয়ত, নৈতিকভাবেও এটা কখনোই ‍উচিত নয়। মাঝে মাঝে কালো টাকার ক্ষেত্রে বলা হয় যে, আপনি এত শতাংশ কর পরিশোধ করে পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরত নিয়ে আসেন এবং সাদা করেন এবং বিনিয়োগ করেন। আবার এগুলো কখনো পরিষ্কার করে বলাও হয় না। এতে আমার মনে হয় যে, আমরা কখনো সিরিয়াসলি কালো টাকা উদ্ধার বা পাচারকৃত টাকা উদ্ধার এটা আমরা চাই না। যেকারণে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কখনো সিরিয়াসলি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিদেশে পাচারকৃত টাকা দায়মুক্তির দিয়ে দেশে আনার সুযোগের ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে বুধবার বাংলাদেশ সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির তথ্য চায়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার্ড। এ নিয়ে বাংলা ইনসাইডার এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত এসব কথা বলেছেন। পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডার এর নিজস্ব প্রতিবেদক শান্ত সিংহ।

অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেন, এই মুর্হূতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রিজার্ভ কমে আসা। বলা হচ্ছে এখন আমাদের পাচঁ মাসের আমদানির রিজার্ভ আছে যেটা চার মাসের সমান হয় যেতে পারে। আবার তিন মাসের হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অবস্থা অর্থনীতিতে এক ধরনের যুদ্ধের মতো অবস্থা বলা যায়। সেই জায়গায় খুব শক্ত পদক্ষেপ ছাড়া এটা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এক সময় দেশের অনেক নাম ডাক পত্র-পত্রিকায় টাকা পাচারকারীদের অনেকের নাম এসেছিল। কোম্পানিসহ মালিকের নাম কিন্তু সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে সময় তো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তার মানে খুব সিরিয়াসলি হাত না দিলে কিছু হবে না। কিছু মুখরোচক কথা দিয়ে অর্থ পাচার ঠেকানো যেমন যাবে না, তেমনি পাচারকৃত টাকাও ফেরত আনার সম্ভব হবে না।

তিনি আনও বলেন, আমরা এমন এক ইকোনমি সিস্টেমে বাস করি যেখানে দুর্নীতি, কালো টাকা, অর্থ পাচার- এগুলো সিস্টেমের অংশের মধ্যে পড়ে গেছে। যদি এগুলো এমন সিস্টেমের অংশ হয় তাহলে কিছু করার নাই। কিন্তু সিস্টেমের অংশ হলেও সামগ্রিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে তো আমাদের এই জিনিসগুলো কখনো না কখনো দেখতে হয়। আমি মনে করি এখন হচ্ছে সেই উপযুক্ত সময়। এই বিষয়গুলো খুব শক্ত হাতে দেখার। এখানে আরেকটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ যেটা আমি আগেও বলেছি সেটা হলো বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় আছে, তার ডেভেলপমেন্ট মডেল কি হবে? আমরা এখন সবাই মিলে সমাধান খুঁজছি। এক্ষেত্রে চারটি সমাধান হতে পারে। প্রথমত, ব্যয় কমানো যেটাকে কৃচ্ছতা সাধন বলছি। কিন্তু কৃচ্ছতা সাধন কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তাছাড়া কৃচ্ছতা সাধন তো গরীব মানুষকে করতে বলা যাবে না। গরীব, সে তো গরীবই। যে নিম্নমধ্যবিত্ত তাকেও বলা যাবে না। সে এমন পরিস্থিতিতে বেশ কষ্টেই আছে। যে মধ্যবিত্ত সেও কষ্টে আছে। এখন দেশের প্রায় সব জায়গায় এক ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেটা হলো যখন লোডশেডিং হচ্ছে তখন মানুষ জেনারেটর চালাচ্ছে। সেটা চালাচ্ছে ডিজেল দিয়ে। তাহলে ডিজেলের ব্যয় তো কমছে না। বরং ডিজেলের ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো অস্থায়ী সমাধান। দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান করতে হলে নীতি নির্ধারকদের খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, খুব সর্তকতার সঙ্গে পরিকল্পনা নিতে হবে। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কারো স্বার্থ দেখা যাবে না। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, ঋণ পুনর্গঠনের নামে আমরা ধনীদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে দিচ্ছি। যে প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে ধনীরাই বেশি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি যারা আচ্ছেন তারা কিন্তু খুব বেশি পাননি। ঋণ পুনর্গঠন দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটা হলো দেশের মধ্যে ঋণ পুনর্গঠন। আরেকটা হলো বিদেশ থেকে  আমরা যে ঋণ গ্রহণ করি সেটা একটা। বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতি খুব জোরদার করা দরকার। সেটাও খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয় না।

তৃতীয়ত হলো সম্পদের পুনর্বন্টন। অর্থাৎ সম্পদশালী থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত করা। সেটা বেশ কিছু উপায়ে করা যেতে পারে। একটি সম্পদ কর আরোপ। বাংলাদেশে সম্পদ কর আইন আছে কিন্তু সম্পদ করা নেওয়া হয় না। সেটা অর্থমন্ত্রীও এক বাজেট বক্তৃতায় স্বীকার করেছিলেন। সেটা যদি করা যায় তাহলে চরম বৈমষ্য কমবে। সম্পদ করের পাশাপাশি দ্বিতীয়ত হলো উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত যে সম্পদ আছে তার উপর কর আরোপ করা। তৃতীয়ত হলো অতিরিক্ত মুনাফার উপর কর। অনেকে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে থাকেন। যেমন কোভিড কালীন সময়ে অনলাইনে বা অন্য কোনো উপায়ে অনেকে অনেক অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করেছেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে এমনটা করা হয়েছিল। অর্থাৎ অতিরিক্ত মুনাফার উপর কর আরোপ করা হয়েছিল। সেটা এখনকার পরিস্থিতির জন্য উত্তম বলে আমি মনে করি। 
চতুর্থত হলো কালো টাকা উদ্ধার এবং পাচারকৃত টাকা উদ্ধার। এর বাইরে আরও অনেক কিছু আছে। যেমন মাদকের উপর শুল্ক কর বাড়ানো, বিলাসবহুল পণ্যের উপর শুল্ক কর বাড়ানো ইত্যাদি।

অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত জানান, অর্থ পাচার বহুভাবেই হয়েছে। অর্থ পাচার করাও কিন্তু সহজ না। কারণ যখন পাচার হয় তখন কিন্তু রিয়েল মানি পাচার হয়। ধরা যাক কেউ ১০ লাখ ডলার কোনো রেগুলার ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার করলো। পাচার করার সাথে সাথে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে সে টাকা ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন হাউজে চলে যায়। তারপর আবার এটাকে টেনে নিয়ে আসার হয়। যখন এটা টেনে নিয়ে আসার হয় তখন কিন্তু সেই টাকাটা সাদা হয়ে যায়। অর্থ পাচার যদি সাদা হয়ে থাকে তাহলে অর্থ পাচারকে তো অর্থ পাচার বলা যাবে না। 

তিনি আরও জানান, যারা দেশের অর্থ পাচার করেছেন তাদের দিয়ে প্রথমে এক্সপেরিমেন্টাল পাইলট করে দেখা যেতে পারে। কিছু জাযগায় হাত দিতেই হবে। হাত দেওয়া পর তখন তাদের বলতে হবে যে, অর্থ পাচার নাও এন্ড নেভার। আপনাকে এই এক বছর সময় দেওয়া হলো বা ৬ মাস কিংবা ৩ মাস সময় দেওয়া হলো এর মধ্যে আপনার পাচারকৃত টাকা নিয়ে আসবেন এবং সেটার উপরে কঠোরভাবে কর আরোপ করতে হবে। করের হার বেশি ধরতে হবে, কম হলে হবে না। করের হার কম ধরা হলে সৎ ব্যবসায়ীদের উপর এর প্রভাব পড়তে পারে। তাদের জন্য এটা কাউন্ড অব প্রোডাক্টটিভ হবে। সে ক্ষেত্রে সৎ ব্যবসায়ীরা টাকা পাচারকে একটা ভালো জিনিস মনে করতে পারে। কারণ পাচার করলে তো কোনো অসুবিধা নাই। পরে একটা কম করের বিনিময়ে টাকা বৈধ করা যাবে। সেজন্য খুব ভালোভাবে, মাথা খুলে এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। বলার জন্য মুখরোচক কিছু কথা বললাম আর সব হয়ে যাবে এটা ভাবলে হবে না। আর যারা পাচার করেছেন তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। দেশে সাড়ে ১৬ কোটি লোকের মধ্যে হয়তো ১০ লাখ বা ৫ লাখ কিংবা ১ লাখ বা আরও কম সংখ্যক লোক টাকা পাচার করেছেন। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষকে হ্যান্ডেল করা যাবে না সেটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার হ্যাল্ডেল করতে গিয়ে যেন এমন না হয় যে, একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম, আরেকজনকে কিছু করলাম না, সেটা দেখলে হবে না। সমস্যা আছে, এর সমাধান করতে হবে। আবার করতে হবে এমনটিও নয়, করতেই হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭