ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ভালোবাসার শক্তি পরিচয়


প্রকাশ: 15/08/2022


Thumbnail

প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী তারিখে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে “ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ” শিরোনামে প্রচারিত সাক্ষাৎকারটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এযাবৎকাল বিবেচিত হয়ে এসেছে। পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবার মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় বঙ্গবন্ধু ও ডেভিড ফ্রস্টের এই কথোপকথনের মধ্যে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, শক্তিমত্তা, দর্শন ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। সে সময়ের ৫২ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে যে গভীর দেশপ্রেমের রাজনীতি করেছেন তার একটি পরিণত রূপ দেখে ডেভিড ফ্রস্ট নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের জন্যে যে ইতিহাস-বীক্ষা এই সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে রয়েছে তার অন্তর্গত অনুসন্ধান বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে প্রজন্মান্তর উৎসাহিত করবে।

ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথমেই জানতে চান কেন তিনি ২৫ মার্চ সবরকম আশঙ্কার খবর জেনেশুনেও বাড়িতেই ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় যখন ৩২ নং বাড়ি পাকিস্তানী সামরিক কম্যান্ডোরা ঘিরে রেখেছিল, বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলছেন, “তারা চেয়েছিল আমি বাড়ির বাইরে এলেই আমাকে হত্যা করবে। এতে তারা বিশ্বের কাছে প্রচার করতো যে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমাদের আপোষ আলোচনা চলছে কিন্তু তাঁর নিজের দলের চরমপন্থীরা তাঁকে মেরে ফেলেছে ফলে ইয়াহিয়া খানের এখন ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এটা ছিল তাদের প্রাথমিক চিন্তা। আমি জানতাম তারা নিষ্ঠুর ও অসভ্য প্রকৃতির, তারা আমার মানুষদের হত্যা করবে। আমি ভাবলাম আমি মরি তা-ও ভালো কিন্তু আমার দেশবাসী রক্ষা পাক যারা আমাকে এতো ভালবাসে”। কেন কোলকাতা বা দেশ ছেড়ে আর কোথাও গেলেন না এর প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমি যেতে চাইলে যে কোন স্থানেই যেতে পারতাম কিন্তু আমি দেশের মানুষের নেতা, আমি তো তাদের প্রতিরোধ করার ডাক দিয়ে রেখেছি, আমি কেমন করে তাদের ছেড়ে যাই”?

২৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাড়ির চতুর্দিকে গুলিবর্ষণ করতে করতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একটি দল তাঁকে গ্রেফতার বা হত্যার জন্যে এগিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু তাঁর শোবার ঘরে ছিলেন, সেখানেও গুলি এসে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছেন ডেভিড ফ্রস্টের কাছে, “আমার ছয় বছরের শিশু সন্তানটি ঘুমিয়ে ছিল, আমার স্ত্রীকে দুই সন্তান নিয়ে সে ঘরে বসে থাকতে বলে বিদায় নিয়ে আমি দরোজা খুলে ঘরের বাইরে চলে এলাম। সামরিক লোকদের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, “গুলি থামাও, কী চাও তোমরা? কেন গুলি করছো? তারা চারদিক থেকে ঘিরে আমাকে বেয়নেট চার্জ করতে উদ্যত হলে একজন অফিসার বাধা দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো আর অন্যদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো আমাকে যেন মারা না হয়। তখন পেছন থেকে সেনাদের কেউ কেউ আমার পিঠে ও পায়ে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করছিল ও ধাক্কা দিচ্ছিল। আমি উচ্চস্বরে বললাম, আমাকে যেন ধাক্কা দেয়া না হয় ও আমার পাইপ আনতে যেতে দিতে বললাম, বা তারা যেন আমার স্ত্রীর কাছ থেকে তা নিয়ে আসে। আমি পাইপ আনতে যেয়ে দেখলাম আমার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আমাকে পাইপ ও একটা ছোট স্যুটকেস হাতে তুলে দিলেন”। বন্দী বঙ্গবন্ধু যাবার পথে পথে দেখলেন চারিদিকে আগুন জ্বলছে। জানালেন, “আমি এই বাড়িতে আর ফিরে আসবো কিনা জানতাম না কিন্তু একটা কথা মনে ছিল যে যদি মরি মাথা উঁচু করেই মরবো যেন আমার দেশের মানুষকে লজ্জা পেতে না হয় যে আমাদের নেতা আত্মসমর্পণ করেছে এই ভেবে। তাহলে তারা দুনিয়ার কাছে মুখ দেখাতে পারতো না”। বঙ্গবন্ধু ফ্রস্টের কাছে আরও উল্লেখ করলেন, “I told them that a man who is ready to die, nobody can kill him. You can kill a man physically, but can you kill a man's soul? You can't, it's my faith. I'm a Mussalman and a Mussalman dies only once, not twice, I'm a human being. I love humanity. I'm a leader of this nation, and my people love me and I love them. There is nothing I expect from them now. They have given everything for me because I was ready to give everything for them. I want to make them free. I have no objection to die. I want to see them happy. I become emotional when I feel the love and affection my people gave me” । এর মানে দেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু মৃত্যুভয়ে কখনও শঙ্কিত ছিলেন না।

২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ৩২নং বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের ঘটনার এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একই কায়দায় গুলি ছুড়তে ছুড়তে কাপুরুষ হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে। একই কায়দায় বঙ্গবন্ধু ঘরে থেকে বের হয়ে হুঙ্কার দিয়ে জানতে চান, “কে তোমরা, কি চাও?” শুধু পার্থক্য এই যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা যা পারেনি বাংলাদেশের কতিপয় ঘাতক তা পেরেছে, বঙ্গবন্ধুর বুকের উপর গুলি চালিয়ে দিতে পেরেছে। হত্যাকারীরা বাংলাদেশেরই মানুষ যে দেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধু ভালবেসে তাঁর সারা জীবনের রাজনীতি করেছেন ও যে দেশের মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অসীম মায়া ও বিশ্বাস। নিরাপত্তাজনিতকারণে তাঁকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থাকতে হবে এমন চিন্তা এই মানুষটি কস্মিনকালেও করেননি কারণ তিনি জানতেন এই দেশের মানুষ কখনই তাঁকে মারতে পারে না। ডেভিড ফ্রস্ট্রের কাছেই তিনি বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি দেশের মানুষকে ভালবাসি, আর আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসি”।

সে ভালোবাসার প্রতিদান স্বাধীন বাংলাদেশের কিছু অসভ্য ও বর্বর প্রকৃতির লোকের হাতে কলঙ্কিত হয়েছে কিন্তু এ কথাও সত্যি যে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে ভালোবেসে এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ১৯৭১ সালে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল, ৩০ লক্ষ মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে, ২ লক্ষ মা-বোনদের নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হ’তে হয়েছে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানীরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে, শত সহস্র মানুষ গৃহহারা হয়েছে, আপনজন হারিয়েছে।  বঙ্গবন্ধু জানতেন এই পাকিস্তানীরা কত ভয়ঙ্কর। তাই ডেভিড ফ্রস্টের কাছে বলছেন, “They are not human beings, they are criminals, they are fanatics, inhuman, uncivilized creatures... I've seen many human beings with human qualities, but I think the soldiers of West Pakistan are not human beings, they are worse than animals. People may have animal qualities, but people cannot be worse than animals. But these people are worse than animals, because an animal would kill a man attacking it, but not torture it. But they killed my people torturing them for 5 days, 7 days, 15 days”। এমনকি কথোপকথনের ফাঁকে ঘৃণাভরে ইয়াহিয়া খানকে তিনি ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে উল্লেখ করে কোনদিন তার ছবি পর্যন্ত তিনি দেখতে চাননা বলে জানান। ভূট্টোর বরাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি তথ্য ডেভিড ফ্রস্ট-কে জানান যে, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতার পালাবদলের সময়ে ভূট্টোকে বলেছিল, “Mr. Bhutto, I've created the greatest blunder of not killing Sheikh Mujibur Rahman”।

ডেভিড ফ্রস্টের কাছে দেয়া এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেন। বিশেষ করে দেশের মানুষকে যুদ্ধাকালীন সময়ে যে নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা, অত্যাচার, পৈশাচিকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেসব কথা উল্লেখ করতে যেয়ে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রতি যে নির্মম অত্যাচার হয়েছে ও বহু নেতা-কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁদের কথাও তিনি নাম ধরে স্মরণ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তার নানারকম দিক উঠে এসেছে এই কথোপকথনে। যে কেউ আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ইতিহাসের বহু বৈচিত্র্যরূপ তথ্যের সন্ধান পাবেন যদি তা অনুধাবনের চেষ্টা করেন আর বর্তমান সময়ে তা খুবই জরুরী। সত্যরূপের বঙ্গবন্ধুকে ভালো করে বুঝতে হলে যে অনুসন্ধান জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন তা সময়ের সাথে সাথে মূল্যবান হয়ে উঠছে, এ কথা একবাক্যে সবাই এখন স্বীকার করবেন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল পটভূমি ধারণ করে মানুষের মুক্তি আন্দোলনে বিশ্ব আসনে ঠাই পেয়েছেন এমন নেতৃত্বের সংখ্যা খুব বেশী নয়। ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “যথার্থ নেতৃত্বের সংজ্ঞা কি?’ – উত্তরে বঙ্গবন্ধু খুবই দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, “যথার্থ নেতৃত্ব আসে সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আকস্মিকভাবে কেউ নেতা হতে পারে না, তাঁকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে ও মানুষের মঙ্গলের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। নেতার থাকতে হবে আদর্শ, থাকতে হবে নীতি। কেবলমাত্র এইসব গুণাবলী থাকলেই কেউ নেতা হতে পারে”।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শ ও নীতিতে আজীবন অবিচল ছিলেন, সংগ্রামের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েই তিনি জাতির পিতার আসনে ঠাই পেয়েছেন ও মানুষের মঙ্গলের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস ও নিজের দেয়া নেতৃত্বের সংজ্ঞায় তাঁর কোন বিরোধ বা দ্বন্দ্ব ছিল না, যে কারণে তিনি ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী’র মর্যাদাও অর্জন করেছেন। এতো বৈচিত্র্যময় গূণাবলী আর অর্জন ক’জন বাঙালীর আছে?    



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭