কালার ইনসাইড

সাবিনা-কৃষ্ণা-রুপনাদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে কবে?


প্রকাশ: 22/09/2022


Thumbnail

সাতক্ষীরার মেয়ে মাসুরা পারভীন, ফুটবল খেলাই যার নেশা। সাতক্ষীরা পিটিআই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তিনি খেলাধুলা শুরু করে। তার বাবা ভ্যানচালক রজব আলী। উপার্জনের একমাত্র সম্বল ভ্যানটিও ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে বাড়ির উঠানে পড়ে রয়েছে। বাড়িটি তৈরি টিনের ছাউনি দিয়ে । রজব আলী এখন অসুস্থ হওয়ায় কাজও করতে পারছেন না। মাসুরা যখন প্রথমদিকে খেলতে শুরু করেছিলেন, বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি তার বাবা। বাধার মুখে পড়েছিলেন পদে পদে।

মাসুরার বাড়ি সাতক্ষীরা সদরের বিনেরপোতা এলাকায়, সরকারিভাবে দেওয়া আট শতক জমিতে থাকে মাসুরার পরিবার। মা ফাতেমা বেগম, দুই বোন সুরাইয়া পারভীন ও সুমাইয়া ইয়াসমিনকে নিয়ে তার পরিবার। সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা দাবি করে ওই বাড়িতে ক্রস চিহ্ন দেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এরপর ভেঙে ফেলা হতে পারে বলে শঙ্কায় ছিলো তাঁদের পুরো পরিবার। তবে সব কিছু ছাপিয়ে সেই মাসুরা আজ দেশের গর্ব। সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার মাসুরা। যাকে নিয়ে আজ সারাদেশে মাতামাতি।

গোল করেই আকাশের দিকে তাকালেন। এরপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বললেন ঋতুপর্ণা চাকমা। যেন গোলটা পাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার। নেপালে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দুই ম্যাচের কোনোটিতেই একাদশে ছিলেন না ঋতুপর্ণা।

মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বদলি নেমেও তিনি গোল পাননি। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামতেই গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশ পাঁচটি গোল দিয়েছে পাকিস্তানের জালে, জয়ও নিশ্চিত। পরে দলের হয়ে ৬ নম্বর গোলটা করেছেন ঋতুপর্ণা।

গোলটা ঋতুপর্ণা উৎসর্গ করেছেন অকালপ্রয়াত ভাই পার্বণ চাকমাকে। গত ২৯ জুন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন পার্বণ। ভাই হারানোর শোক এখনো লেগে আছে ঋতুপর্ণার চেহারায়। জাতীয় দলের সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি মেয়েটাই এখন সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। পরশু তিনি গোল পাওয়ার পর টিম বাসে উঠেও অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। টিম হোটেলে গিয়েও রাতে কান্নাকাটি করেছেন। কাঠমান্ডুর আর্মি হেডকোয়ার্টার মাঠে গতকাল অনুশীলনের সময় সতীর্থরা হাসি–আড্ডায় মেতে থাকলেও ঋতুপর্ণাকে দেখা গেছে বিষণ্ণ।

বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। বড় তিন বোন, ভারতী চাকমা, পামপি চাকমা ও পুতুলি চাকমার বিয়ে হয়ে গেছে। চার বোনের এক ভাই হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন পার্বণ। সেই আদরের ভাইকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন ঋতুপর্ণা।

পার্বণের দুই বছরের বড় ঋতুপর্ণা। পিঠেপিঠি ভাই–বোন হওয়ায় দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। ২০১৭ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে ঋতুপর্ণার সব ম্যাচ দেখেছেন পার্বণ। পাকিস্তানের বিপক্ষে গোলের পর তাই সবার আগে ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ঋতুপর্ণার।

এই দুইটি গল্প কোন সিনেমার চিত্রনাট্য নয়। মাঝে মাঝে সিনেমার গল্পকেও হাড় মানায় বাস্তব কিছু গল্প। ঠিক তেমনি কিছু গল্প রয়েছে সদ্য দৃষ্টিনন্দন, শৈল্পিক এবং একই সাথে শ্বাসরুদ্ধকর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঐতিহাসিক কীর্তিগাথা রচনা করে আসা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রতিটি খেলোয়াড়রে। ব্যক্তি জীবনের সব দুঃখ, কষ্টকে পিছনে ফেলে দেশের জন্য লড়ে গিয়েছেন নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে। সাফের ট্রফি নিয়ে দেশে এসেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। বুধবার দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখেন সাবিনারা। তাদের বরণ করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। উপস্থিত ছিল বাফুফের প্রতিনিধিদলও।বিমানবন্দর থেকে শহর ঘুরে বাফুফে কার্যালয়ে সাবিনাদের নিয়ে যাওয়া হয় ছাদখোলা বাসে করে।

ফুটবল নিয়ে এই উন্মাদনা আজ থেকে নয়। বহু বছর আগে থেকেই চলছে এই উন্মাদনা। এমনকি ফুটবল নিয়ে হলিউড, বলিউড, ঢালিউডে নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র। ফুটবল নিয়ে খুব একটা বড় বাজেটের সিনেমা নির্মাণ হয়নি। বড় বাজেট না হলেও আলোচিত বেশ কিছু সিনেমা রয়েছে ফুটবল নিয়ে।  হলিউড থেকে শুরু করে বলিউডেও অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে ফুটবলকে নিয়ে।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলেকে নিয়ে ২০১৬ সালে হলিউডে নির্মিত হয় ছবি ‘পেলে-বার্থ অফ অ্যা লিজেন্ড’। ছবিটি দেখলে পেলের বেড়ে ওঠার পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যাবে।

এছাড়াও মদের নেশায় আসক্ত সাবেক এক ফুটবলারের জীবনের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ইয়েস্টারডেস হিরো’। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি মন ছুঁয়েছে অনেকেরই। ফুটবল ম্যানেজারের জীবন নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘এ শট অ্যাট গ্লোরি’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০০ সালে।

ডেভিড বেকহ্যাম তখন সুপার ফর্মে। তখনই ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচালক গুরিন্দর চাঁদা নির্মাণ করলেন ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’।

গ্রেগরিস গার্ল (১৯৮১) ফুটবল নিয়ে ব্রিটিশ রোমান্টিক কমেডি আছে অনেকেরই পছন্দের তালিকায়। দেখতে পারেন ফুটবল নিয়ে হংকংয়ের অ্যাকশন কমেডি ছবি শাওলিন সকার। আরও দেখতে পারেন রুডো এন্ড কার্সি (২০০৮), ড্যামনেড ইউনাইটেড, হোয়েন স্যাটারদে কামস, মিন মেশিন, গ্রেসি ছবিগুলো।

ক্রিকেটের দেশ বলিউডে ফুটবল নিয়ে সিনেমা নেই বললেই চলে। কোন কোন সিনেমায় একটা কিংবা দুইটা দৃশ্য রাখা হয় ফুটবলের। যেমন ‘কাভি আলভিদা না কেহনা’য় শাহরুখের দৃশ্য। সেক্ষেত্রে ‘ধান ধানা ধান গোল গোল’ ছবিটাকে পূর্ণ মাত্রার সিনেমা বলা চলে। ‘সিকান্দার’ ছবিরও অনেকটা জুড়ে ছিল ফুটবল।

শুধু ফুটবল নয় ক্রিকেট নিয়েও কম দিনেমা নির্মাণ হয়নি। লাগান ছবি ক্রিকেট সম্পর্কিত ছবিগুলির মধ্যে একটি। অভিনেতা আমির এর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষের গ্রামের লোকজন তাদের জীবনযাত্রা এবং ইংরেজ সরকারের ব্যবহার তাদের প্রতি এই নিয়েই গল্প ছিল ওই ছবিটির। লাগান নামে একটি ক্রিকেট দল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সেখানে কর্ম করার জন্য ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবন কাহিনী কে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে ক্রিকেট নিয়ে ছবি তৈরি হয়েছিল। আত্মঘাতী অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত সেই ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন। ধোনির ক্রিকেট নিয়ে জীবন সংগ্রাম এবং ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় কে কেন্দ্র করে ছবিটি গড়ে উঠেছিল। তার ওই ছবিটি সুপার হিট হয়েছিল।

নব্বইয়ের দশকের সময় ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের জীবনী নিয়ে তৈরি হয় ক্রিকেট মূলক ছবি আজহার, ইমরান হাশমি সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটের খাওয়ার সময় এবং ম্যাচ ফিক্সিং সম্পর্কে সব কিছু ঘটনা ওই ছবিতে দেখানো হয়েছিল। তিনি তার সময়ে দুরন্ত ব্যাটিং করতেন কিন্তু ম্যাচ গড়াপেটা তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তার ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তির নানাদিক সেই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছিল।

বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে তেমন ভাবে ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ক্রীড়া ভিত্তিক কোন খেলোয়াড় দিয়ে তেমন কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। যদিও ২০১০ সালে নির্মাতা খিজির হায়াৎ খান ফুটবল খেলা নিয়ে নির্মাণ করে ছিলেন জাগো নামের চলচ্চিত্র। এরপর তার তেমন ভাবে ক্রীড়া ভিত্তিক কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি।

চলচ্চিত্র একটি দেশকে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত করিয়ে দেয়। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, খেলেধূলা সম্পর্কে বিশ্বকে জানান দেয়। হলিউড থেকে শুরু করে বলিউডের অনেক ক্রীড়া ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। পাশাপাশি নামীদামী অনেক খেলোয়াড়দের জীবন নিয়েও নির্মিত হয়েছে বায়োপিক। যেগুলো বিশ্ব দরাবারেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। 

যে মানুষগুলো তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সব দুঃখ, কষ্টকে পিছনে ফেলে দেশের জন্য লড়ে জয় ছিনিয়ে আনছেন তাঁদের হয়তো আমরা সাময়িক কিছু সম্মাননা দিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করছি কিন্তু তাদের সংগ্রামী জীবনের অনেক কথাই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কখনো কী তাঁদের সেই সংগ্রামী জীবনের গল্প ফুটে উঠবে সেলুলয়েডের পর্দা?


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭