প্রকাশ: 22/11/2022
আজ ২২ নভেম্বর, ২০২২। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে জন্ম নেওয়া সিংহ পুরুষ কৃষিবিদ বদিউজ্জামন বাদশা’র ১ম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের কৃষিবিদদের প্রাণের স্পন্দন প্রিয় বাদশা ভাই। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, তুখোড় বক্তব্য, বুদ্ধিদীপ্ত কথা ও আচরণ সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করে। এসব গুণাবলির জন্য সমসাময়িক যে-কোন রাজনীতিবিদদের চেয়ে তিনি এগিয়ে। নিজের জীবনে কি পেয়েছেন সে হিসাব কখনও করেননি, তবে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষিবিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবসময়ই ছিলেন অগ্রগামী।
অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ ছিলেন তিনি।
তিনি একটা কথা প্রায়ই বলতেন-
"হেই মিয়া এতো হতাশ হও কেন? আমাকে দেখো,
চাকুরী করলে রিটায়ার্ড করতাম এতোদিনে ,
রাজনীতি করি বলে এখনো রিটায়ার্ড হই নাই, এখনো পর্যন্ত এমপি ইলেকশন করতে পারলাম না।
আমি যদি এই বয়সে আশাবাদী হতে পারি তো তোমরা এতো হতাশ হও কেন?’
আশির দশকের মাঝামাঝি ছাত্র রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের ‘বদিউজ্জামান বাদশা’ নামটির সাথে পরিচয় থাকার কথা । এক সময় মেধা, বিস্তর পড়াশুনা আর অনর্গল তথ্যে-উপাত্তে বক্তৃতা দেবার সক্ষমতায় ছাত্র রাজনীতিতে কিছু অভিজাত নেতার দেখা মিলতো, বদিউজ্জামান বাদশা ছিলেন তাঁদেরই একজন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রাঞ্জল শব্দচয়নে, সমৃদ্ধ তথ্যে বক্তৃতা দিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মত আটকে রাখার সক্ষমতা একজন ছাত্রনেতাকে যে কতোটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে আশির দশকে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে আমরা যেন তারই কালের সাক্ষী, আর আইকনটি ছিলেন জনাব বদিউজ্জামান বাদশা ।
দুরারোগ্য ব্যাধি অগ্নাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২২ নভেম্বর, ২০২১ ভোর ২ টা ৪৫ মিনিটে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান । প্রাণহীন বদিউজ্জামান বাদশাকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, তাঁর জন্মভূমিতে । আমি গত ২২ নভেম্বর ২০২১ শেরপুরের নালিতাবাড়িতে একজন জননেতার শেষ বিদায় দেখলাম । তিনি ছিলেন নকলা-নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষের নেতা । প্রিয় নেতাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল । লোকে লোকারণ্য ছিল উপজেলা সদর এলাকা । গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে দলে দলে আসছে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা । তারাগঞ্জ হাই স্কুলের বিশাল মাঠে তিল ধারনের ঠাঁই ছিলনা। জানাজা পূর্ববর্তী সময়ে স্থানীয় নেতারা, জনপ্রতিনিধিরা তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরছেন। বক্তারা বলছেন-,‘একজন মানুষের মৃত্যু হলে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিন্তু কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশার মৃত্যুতে নকলা-নালিতাবাড়ীর সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হলো। মানুষের সেবা করাই ছিল বাদশা-র নেশা’।
এই নেতার স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা-র রাজনীতির চারণক্ষেত্র শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আতিউর রহমান আতিক বলেছেন-, ‘মর্মে মর্মে আমি উপলব্ধি করছি, ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর পারে গারো পাহাড়ের পাদদেশে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা, যিনি আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন’।
মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন পূর্বে অসুস্থ অবস্থায় এক জনসভায় জননেতা বদিউজ্জামান বাদশা বলেছেন, ‘আপনাদের কষ্টের কথা আমার জানা আছে । যতদিন আমি জীবিত থাকবো বন্ধুগণ, ভাইয়েরা আমার, ততদিন আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবো । যদি কিছু নাও দিতে পারি, অসুখে-বিসুখে আমার রক্তটুকুও যদি কাজে লাগে, আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই রক্তটুকু দিয়ে হলেও আপনাদের ভালবাসার ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করবো । আর আমার জীবিত অবস্থায় আপনারা কেউ আমার কাছে কোন কাজে আসেন, তার যদি আমার সাধ্যের ভিতরে থাকে, আমার ঘরের লোক হিসেবে আমি সেটিকে পূরণ করতে চেষ্টা করবো।’
ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। সবকিছুই চলছে, শুধু বাদশা ভাই নেই।
‘অপরাজেয় কৃষিবিদ’ ফেজবুক পেইজে কৃষিবিদ তানজিবুল এর লেখা থেকে দুজন খেটে খাওয়া মানুষের কথোপকথনের কিছু অংশ উল্লেখ না করলে বুঝা যাবে না একজন নেতার কতোটা সম্মোহনী শক্তি থাকলে মানুষের মনে এভাবে জায়গা করে নিতে পারেন।
একদিন চলার পথে রিকশাচালকের সাথে-
‘-চাচা, ঢাকায় কি করেন?
-রিক্সা চালাই।
-বাড়ি কোথায়?
-শেরপুর।
-শেরপুর কোথায়?
-শেরপুর, নালিতাবাড়ী।
-ওহহ, নালিতাবাড়ী কোথায়?
-নেতা বাদশার বাড়ির কাছে।
-বাদশা ভাইতো মারা গেছেন?
-হুম, আমার কলিজাটা পুড়ায় এখনো।
-নেতা বাদশা এমপি হতে পারে নাই?
-কিন্তু আমাদের মাথার উপর ছায়া হইয়া ছিলো।’
আরেকদিন আগারগাঁওয়ে-
‘-আপনার ভাষা শুনে মনে হচ্ছে, বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহ?
-জ্বি, শেরপুর।
-শেরপুর এর কোথায়?
জ্বি, নালিতাবাড়ী।
-নালিতাবাড়ী কোথায়?
-ভোগাই নদীর পাশে।
-বাদশা ভাইয়ের এলাকায়?
-হুম,আর কইয়েন না, নেতা বাদশাহ আমাদের জন্য এমনি একজন ছিলেন যে, নেতা বাদশাহ মারা যাওয়ার পর মনে হচ্ছে আমার শরীরের একটা হাত নেই!’
শেরপুরের এমন অগণিত মানুষের কাছে, সমগ্র কৃষিবিদদের কাছে একজন বন্ধু, একজন অভিভাবক, একজন ভাইয়ের মতো ছিলেন, বাদশাহ ভাই। তিনি এই পৃথিবীতে না থেকেও আমাদের মনে এখনও জ্বলজ্বল করছেন নক্ষত্রের মতো।
বিনম্র শ্রদ্ধা, বদিউজ্জামান বাদশা ভাই। মহান আল্লাহ বাদশা ভাইকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭