লিভিং ইনসাইড

ঔষধের সঠিক ব্যবহার: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবহেলিত


প্রকাশ: 25/11/2022


Thumbnail

ঔষধের যথাযথ ব্যবহার বা সঠিক নিয়মে ঔষধ গ্রহণ যেকোনো রোগ নিরাময়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। ডব্লিউএইচও-এর মতে, চিকিৎসার নিয়ম মেনে চলার অভাব রোগীদের মধ্যে বড় ধরনের সমস্যার জন্ম দেয়, বেশিরভাগই দীর্ঘ্যস্থায়ী অসুস্থতায়। “সঠিক পদ্ধতিতে ঔষ ধগ্রহণ” কমপক্ষে ৫টি সঠিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে—সঠিক রোগী, সঠিক ঔষধ, সঠিক সময়, সঠিক ডোজ এবং সঠিক রুট বা গমনপথ। “সঠিকভাবে সেবন না করলে ঔষধ কাজ করবেনা”—এই সহজ সত্যটি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই অনুধাবন করেননা, ফলস্বরূপ এখনো উন্নত বিশ্বে দীর্ঘ্যস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই সঠিক নিয়মে ঔষধ গ্রহণ করেননা–বলছে ডব্লিউএইচও।

দীর্ঘ্যস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগীদের এটি মেনে চলা বিশেষভাবে কঠিন হতে পারে কারণ তাদের প্রায়শই দীর্ঘ্য সময়ের জন্য তাদের ওষুধ সেবন করতে হয়, কখনও কখনও তাদের বাকিজীবনের জন্য। সেন্টার্স ফর ডিসিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুমান করে যে ওষুধের অপরিমিত ব্যবহার ৩০% থেকে ৫০% দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসাকে ব্যর্থতার দিকে পরিচালিত করে। চিকিৎসা গাইডলাইনের প্রতি দুর্বল আনুগত্য আশানুরূপ ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়, রোগের লক্ষণ গুলি আরও খারাপ হতে পারে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে পারে।

যুক্তরাজ্যে প্রায় অর্ধেক প্রেস্ক্রিপশনকৃত ঔষধ প্রয়োজন অনুযায়ী নেওয়া হয়না এবং অতি সম্প্রতি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগী ১৮ সপ্তাহের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা পেতে ব্যর্থহয়। নিউজিলান্ড-ভিত্তিক প্যাশেন্ট প্রেফারেন্স এন্ড এডহেয়ারেন্স জার্নালসূত্রে জানা যায় খোদ মার্কিন মুল্লুকেই সঠিক নিয়মে ঔষধ গ্রহণ না করা অন্তত ১০% হস্পিটালাইজেশন, বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার চিকিৎসা ব্যয় এবং লক্ষাধিক রোগীর মৃত্যুর কারণ। একটি সাম্প্রতিক কানাডিয়ান সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৩০% রোগী নির্দেশ দেওয়ার আগে তাদের ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং চারজনের মধ্যে একজন তাদের প্রেসক্রিপশন পূরণ করেননা বা নির্ধারিত ঔষধের চেয়ে কম গ্রহণ করেন।ঔষধের অনুপযুক্ত ব্যবহার প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মোট পরিহারযোগ্য খরচের অর্ধেকেরও বেশি অবদান রাখে।

ঔষধ সঠিকভাবে গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশ এবং পশ্চিমা তথাকথিত উন্নত বিশ্বে আজব মিল খুঁজে পাওয়া যায়।বিশ্বব্যাপী অর্ধেকেরও বেশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হয় এবং সিডিসি বলেছে, হাসপাতাল-কর্তৃক নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিক গুলির ৩০% থেকে ৫০% অনুপযুক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ওয়েলকাম ট্রাস্টের অর্থায়নে ল্যানসেটদ্বারা প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণাতে বলা হয়েছে যে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় অর্ধকোটি মৃত্যু ছিল ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধের সাথে সম্পর্কিত, যেটি ২০৫০ সাল নাগাদ দ্বিগুণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী নন-স্টেরয়েড ব্যাথার ঔষধ থেকে সৃষ্ট অন্ত্রের প্রদাহ বছর-প্রতি অন্তত ৬,৫০,০০ হস্পিটালাইজেশন এবং ১,৬৫,০০০ মৃত্যু'র কারণ। এই শ্রেণীর ঔষধগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কিডনি ইনজুরির কারণ হয়ে থাকে এবং কিডনিরোগীদের ক্ষেত্রে এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ৩ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত হতে পারে।এই ঔষধগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং কোভিডরোগীদের ক্ষেত্রে রিপোর্ট করেছে অনেকগুলো গবেষণা।বিশেষ করে ডেঙ্গু কিংবা কোভিড রোগীদের ব্যাথার ঔষধ দিয়ে জ্বর নামানোর চেয়ে শরীরের হাইড্রেশন লেভেল বজায় রাখা বেশি জরুরি।বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ বা সাপোজিটরি'র ব্যবহার পেট ব্যাথা বা হজমের গোলযোগ সৃষ্টি করে, ফলে বাচ্চার হস্পিটালাইজেশন জরুরি হয়ে পরে।ঘরোয়া পরিবেশে শুধু স্যালাইন কিংবা ফলের রস দিয়ে অথবা শুধু পানি বেশি গ্রহণ করে শরীরের পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করতে পারলেই বেশিরভাগ হস্পিটালাইজেশন বা আইসিইউ এডমিশন ঠেকানো যেতো, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।

প্রায় ৪০% কোভিড রোগী ঘুমের সমস্যা রিপোর্ট করেন--কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে বেনজোডায়াজেপিন ব্যবহার ডেলিরিয়ামের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে,শ্বাসকষ্টের রোগীদের শ্বাসযন্ত্রের দমন করে এবং এগুলো কিছু ভাইরাস-প্রতিরোধী ঔষধের সাথে সেবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন মরফিন-গোত্রের ব্যাথার ঔষধ ব্যৱহৃত হয়, যার ১% এরও কম দরিদ্র দেশগুলো পায়--বলছে অমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ। কাজেই এদের অপব্যবহার এবং এতদসংক্রান্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলোও উন্নত বিশ্বই হজম করে।

ডব্লিউএইচও-এর রিপোর্ট অনুসারে, উন্নত দেশগুলিতে দীর্ঘ্যস্থায়ী রোগের জন্য চিকিৎসা গাইডলাইন সঠিকভাবে প্রতিপালন করেন অর্ধেক রোগী, যা কিনা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরো অনেক কম।দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় অর্ধেক রোগীই তাদের নির্ধারিত ওষুধের ব্যবহার মেনে না চলে তীব্র ও দীর্ঘ্যমেয়াদী জটিলতার ঝুঁকিতে রয়েছেন, যার ফলে হাসপাতালে ভর্তির হার এবং চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি পায়।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ করেছে যে উচ্চ রক্ত চাপের রোগীরা চিকিৎসার নির্দেশিকা অনুসরণ করেনা কারণ--(১) সাবঅপ্টিমালডোজ অথবা ভুল ঔষধ নির্ধারণ (২) বীমার অভাববা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে কদাচিৎ যোগাযোগ এবং (৩) নির্ধারিত ঔষধের বা অন্যান্য জীবনধারার গাইডলাইন মেনে চলতে রোগীর ব্যর্থতা।

বিশ্বব্যাপী বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে তিন-চতুর্থাংশই সঠিক নিয়মে দীর্ঘ্য মেয়াদী চিকিৎসা প্রতি পালনে অক্ষম—কারণ একাধিক শারীরিক জটিলতা এবংঅতিরিক্ত ঔষধের বোঝা। বয়স্ক রোগী যারা কম পক্ষে৫টি ঔষধ গ্রহণ করেন তাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, স্মৃতিভ্রংশ, পতন, দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, যেখানে অতিরিক্ত ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বয়স্ক রোগীদের ৫% থেকে ২৮%  হাসপাতালে ভর্তির জন্য দায়ী বলে অনুমান করা হয়।

চিকিৎসা খরচ দরিদ্রদেশ গুলোতে দীর্ঘমেয়াদী রোগের সঠিক ক্লিনিকাল গাইডলাইন মেনেচলার প্রতিবন্ধকতা--এমনটি  অনেক ফোরামে আলোচিত হলেও ভুলে যাওয়া, ঔষধ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়কাল সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং ঔষুধের সামগ্রিক কার্যকারিতা সম্পর্কে অবিশ্বাস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকল মেনে নাচলার অন্যতম কারণ।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে আজও মৃগীরোগ কোনো অশুভ আত্মাবা‘ জ্বীনেরআসর’বলে ধরাহয়--যদিওদুই-তৃতীয়াংশ রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসায় খিঁচুনি মুক্ত হতে পারে, কিন্তু সঠিক নির্দেশিকার প্রতিদুর্বল আনুগত্যএরকার্যকরী পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বড় সমস্যা।

বিভিন্ন গবেষণায় নিম্নলিখিত কারণ গুলোদীর্ঘ্য স্থায়ী রোগের জন্য চিকিৎসা গাইডলাইন মেনে না চলার জন্য চিহ্নিত হয়েছে:

১. রোগীরআর্থ-সামাজিক অবস্থান: দুর্বল স্বাস্থ্য-শিক্ষা, পারিবারিক বা সামাজিক সহায়তা নেটওয়ার্কের অভাব, অস্থিতিশীল জীবনযাপন বা গৃহহীনতা, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা

২. চিকিৎসা-সম্পর্কিত: চিকিৎসা পদ্ধতির জটিলতাও সময়কাল, ঔষধের নিয়মে ঘন ঘন পরিবর্তন, তাৎক্ষণিক ফলাফলের অভাব, প্রকৃত বা অনুভূত অপ্রীতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ

৩. স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা: উচ্চচিকিৎসা-খরচ, রোগীর শিক্ষা এবং ফলো আপের জন্য সীমিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, চিকিৎক-রোগীর সম্পর্ক, স্বাস্থ্য-সেবার প্রতি রোগীর আস্থা, দীর্ঘ অপেক্ষা, রোগীর তথ্য উপকরণের অভাব

৪. রোগীর সাথে সম্পর্কিত: দৃষ্টি-শ্রবণ এবং জ্ঞান প্রতিবন্ধকতা, গতিশীলতা এবং দক্ষতা, মনস্তাত্ত্বিক এবং আচরণ গতকারণ, অনুভূত রোগের সংবেদনশীলতার ঝুঁকি, কুসংস্কার ও রোগ দ্বারা কলঙ্ক-বোধ, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় ইত্যাদি

পরিশেষে এটাই বলা যেতে পারে যে, রোগ সম্পর্কে রোগীদের জ্ঞান এবং উপলব্ধি হল চিকিৎসা-ব্যবস্থার প্রতিতাদের আনুগত্য নির্ধারণের মূল চালিকাশক্তি। স্বাস্থ্যসেবা  প্রদানকারীদের রোগের প্রতিরোগীদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঔষুধের প্রতি আস্থা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ শনাক্ত করতে এবং ঔষধ সঠিকভাবে গ্রহণ বাড়াতে আরও কার্যকর স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রদানের জন্য অন্বেষণ করা উচিত।

Author: Abdul Kader Mohiuddin
Affiliation: Alumni, Faculty of Pharmacy, Dhaka University
Contact: +01935183385, Email: trymohi@yahoo.co.in


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭