ইনসাইড থট

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কি সারা বছর চলবে?


প্রকাশ: 30/11/2022


Thumbnail

গত আড়াই বছরে করোনার তা-ব এবং আতঙ্কের পরে এখন চলছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। অবস্থা প্রায় মহামারী পর্যায়ে। বিশেষ করে ঢাকা, কক্সবাজার এবং কিছু বড় শহরে। ডেঙ্গু রোগের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘চাইনিজ মেডিকেল এনসাইক্লোপেডিয়া’-তে ডেঙ্গু রোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তথ্য আছে। রোগটি প্রথমে বানরের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। সেখান থেকে ‘এডিস ইজিপ্টাই’ নামের মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ। তবে রোগটি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুটিকয়েক দেশে সীমিত ছিল শত শত বছর ধরে। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে জাহাজযোগে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে এডিস প্রজাতির এ মশা জাহাজে করে দেশান্তরী হয়। সাথে নিয়ে যায় ডেঙ্গু ভাইরাস। বর্তমানে প্রায় ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু রোগ আছে।

আমাদের দেশে ডেঙ্গু জর প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৬৪ সালে। পরবর্তী ৬০ বছরে খুবই সীমিত আকারে সংক্রমণ ছিল বিক্ষিপ্তভাবে। আতঙ্ক তো ছিলই না, এমনকি খুব একটা পরিচিতিও ছিল না। প্রাদুর্ভাব ও আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয় ২০০০ সালে। স্বাস্থ্যবিভাগ তো প্রথম দিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কথা উচ্চারণ করতেই চায়নি। চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তখন একটা মিছিল বের করেছিল। মিছিলের ব্যানারে স্লোগান ছিল ‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ হয় না’। বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে লিফলেট তৈরি, র‌্যালি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়েছিল বেশ জোরেসোরেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্কাউটস হাসপাতাল চত্বরে তাঁবু ও ক্যাম্প খাট দিয়ে অস্থায়ী ডেঙ্গু হাসপাতাল পরিচালনাও করেছে

এরপরে প্রায় ২২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গু সম্পর্কে আলোচনা, পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তি, চিকিৎসা এবং সচেতনতা বেড়েছে। অন্ধ থাকেনি, কিন্তু প্রলয় বন্ধ হয়নি। প্রলয় বরং বেড়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের ১, ২, ৩ ও ৪  নামে ৪টি সেরোটাইপ আছে। ২০০০ সালে সেরোটাইপ-১ দিয়ে সংক্রমণ শুরু হয়। ২০১৬ সালে সেরোটাইপ-১ এর সাথে সেরোটাইপ- ২ ও ৩ সংক্রমণে যোগ দিয়েছে। তখন থেকেই সংক্রমণ ও রোগের তীব্রতায় গতি পায়। জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেরোটাইপ-১ এর সংক্রমণই বেশি ছিল (৯১.৩%)। ২০১৮ সালে সেরোটাইপ-১, ২ ও ৩ এর সংক্রমণ ছিল প্রায় কাছাকাছি। হঠাৎ করেই ২০১৯ সালে সেরোটাইপ-৩ এর সংক্রমণ প্রায় সর্বগ্রাসী হয় (৯১.৮৬%)। এ ২০১৯ সালেই রোগীর সংখ্যা লক্ষাধিক এবং ১৭৯ জনের মৃত্যু ঘটে। পরের ২ বছর গতি একটু সীমিত থাকলেও এ বছর রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার ছুঁই ছুঁই, এবং মৃত্যু ঘটেছে ২৬০ জনের বেশি। শুধু নভেম্বরের ৩ সপ্তাহে ৯৩ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু।

প্রশ্ন উঠতেই পারে নভেম্বর মাসে বৃষ্টিপাতের লেশমাত্র নেই। এর পরেও রোগী এবং মৃত্যু বেশি কেন? এডিস মশা বদ্ধ স্বচ্ছ পানিতে ডিম পারে। মশার জীবনকাল গড়ে ৪০ দিন, কিন্তু একবার এ মশা সংক্রমিত হলে পুরো জীবনকালই  সংক্রমণ ঘটাতে থাকে। প্রতি ৩ দিন অন্তর ডিম পারে। কাজেই কম জীবনকাল হলেও একটু স্বচ্ছ পানি পাওয়া গেলে দ্রুত বংশ বিস্তারে এ মশার জুড়ি নেই। এক চায়ের চামচ বা একটা বোতলের ছিপির পানিই যথেষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনে ভ্রমাত্মক বৃষ্টিপাত বেড়েছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি ও কিছুদিন বিরতি পেলেই ছোট পাত্রে পানি জমে। আর আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভ্যাস নিকৃষ্টের মধ্যে অন্যতম। একবার মাত্র ব্যবহারযোগ্য কাপ, বোতল, পাত্র ছুড়ে ফেলার অভ্যাস আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। শিক্ষার হার, গড় আয়ু, ভোগ্যপণ্য ব্যবহার ইত্যাদি বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়েছে বর্জ্য। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এগুলো ছুড়ে ফেলার অভ্যাস। পানি জমার ছোট পাত্রের এখন অভাব নেই। ফলে ডেঙ্গু সারা বছর থাকার সুযোগ পাচ্ছে। নভেম্বরে তো মোটেই রেহাই দেয়নি। ডিসেম্বরেও থাকার আশঙ্কা খুব বেশি।

ডেঙ্গুর ৪টি সেরোটাইপের মধ্যে ১টিতে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে অন্য ০৩টি সেরোটাইপের যেকোন একটির সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। ৪টি সেরোটাইপের কারণে একজন ব্যক্তি ৪ বার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু প্রথম সংক্রমণের পরে পরবর্তী সংক্রমণের তীব্রতা ও মারণঘাতী ক্ষমতা অনেক বেশি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ও পরবর্তী সংক্রমণের ভয়াবহতা অনেক বেশি। দ্বিতীয় ও পরবর্তী সংক্রমণে শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ঘটায়, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরে রূপান্তর ঘটায়, তখন রক্তচাপ ও হদস্পন্দন হ্রাস পায় এবং শক সিনড্রোম শুরু হয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ডেঙ্গুর প্রথম সংক্রমণে সৃষ্ট এন্টিবডি দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপের সংক্রমণে ভাইরাসকে প্রতিরোধ তো করেই না, বরং ভাইরাসের প্রতিলিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যে কারণে রোগের তীব্রতা ও মারণঘাতী ক্ষমতা খুবই বৃদ্ধি পায়।

মশাবাহিত বলে ডেঙ্গু ভাইরাস কখনও নির্মূল হবে না। প্রতি বছর এর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে ও পাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি লোক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার মারা যায়। মৃত্যুর খতিয়ানে শিশুর সংখ্যা বেশি। গত ৫০ বছরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্রাস পাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধের ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে ১৯২৯ সাল থেকেই। বর্তমানে ৬ পদ্ধতির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলছে। মাত্র একটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে। আশা করা যাচ্ছে ৫ বছর পরে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। কাজেই বর্তমান পর্যায়ে সচেতনতা ও রোগ ব্যবস্থাপনাই প্রধান ভরসা।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে রক্তের প্লাটিলেট সংখ্যা দ্রুত কমে। একজন মানুষের শরীরে প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে ১.৫ থেকে ৪ লক্ষ প্লাটিলেট থাকে। প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটলে ৮০% থেকে ৯০% রোগীর প্লাটিলেট ১ লক্ষের নিচে নেমে যায়। ১০% থেকে ২০% রোগীর প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নামে। রক্ত জমাট বাঁধার এ উপাদানটি দ্রুত কমে যাওয়ায় শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কাজেই, ডেঙ্গুর সময়কালে ভিটামিন, আয়রণ ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ ফল, শাক-সবজি বেশি খাওয়া উচিত। ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’ ও ভিটামিন ‘কে’ সমৃদ্ধ খাবার রক্তের প্লাটিলেট বৃদ্ধি করে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এক সেরোটাইপের সংক্রমণে ডেঙ্গু রোগী যতো বাড়বে, পরবর্তীতে অন্য সেরোটাইপের সংক্রমণে ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা ও মারণঘাতী ক্ষমতা ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক
ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক সচিব।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭