প্রকাশ: 01/12/2022
গত সপ্তাহে বাসার বিদ্যুৎবিল পরিশোধ বিষয়ক না দাবী সনদপত্র
খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ পেয়ে
যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের
এক স্মৃতি-স্মারক। আমার দু'চোখের
পাতা কেঁপে ওঠলো। যেন পলকে চার
দশক পেছনে ফিরে গেলাম। ধুলোয় মলিন নথিপত্রের সঙ্গে
লেপ্টে থাকা একখানা অসাধারণ
কাব্যগ্রন্হ। ধূসর বিবর্ণ সে
বইয়ের গা থেকে ময়লা
সরিয়ে হাতে নিয়ে দেখি
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র বই 'আমার
সময়'।
আশির
দশকের মাঝামাঝি সময়ে বইটা আমার
হাতে
এসেছিল। ছেঁড়া মলাট উল্টিয়ে আরও
একবার চমকে যাই।
ভেতরে
নিজ হাতে লেখা --
এম.এ. মান্নান
৬৪৫,
মহসীন হল,
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়
তাং
০৭- ১০- ৮৭ইং।
ভাবছিলাম,
আমি কি এক সময়ে
নামটা এভাবে লিখতাম? আমার হাতের লেখাটা
এমন ছিল?
এখন
কি এভাবে লিখতে পারব? মনে হয় কত
যুগ-যুগান্তর ধরে স্বহস্তে কিছু
লিখি না। কলমের পরিবর্তে
আমরা সবাই এখন কিবোর্ডে
আঙুল ছুঁয়ে থাকি। সারাক্ষণ চোখে চোখে লেগে
আছি এক অবাক স্পর্শের
সাথে।
২) এটা এক দীর্ঘ
কবিতার বই। মোট ছয়টি
কবিতা নিয়ে তেতাল্লিশ পৃষ্ঠার
কাব্য । প্রথম প্রকাশিত
হয়েছিল ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে।
বোঝা
যায়, তখনকার বই মেলার আয়োজনকে
সামনে
রেখেই বোধকরি বাজারে আসে। অনিন্দ্য প্রকাশন,
নবাবপুর রোড, ঢাকা থেকে
মুদ্রিত। প্রচ্ছদ ও মুদ্রন সে
সময়ের তুলনায় চমৎকার দৃষ্টিনন্দন। কবিতাগুলোর শিরোনামও ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক
এবং চমকপ্রদ।
'আমার
সকল কথা'
'আমার
সময়'
'পরিচিত
পথঘাট'
'আমি
এখন যাবার জন্যে তৈরী'
'এখন
ভয় করে না'
'আমার
গোপন ব্যথা'
বইটি
কবি তাঁর মা'কে
উৎসর্গ করেছেন।
লিখেছেন,
"আমার মা কাকাতুয়া"কে
--
৩) প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরে পুনর্পাঠ করতে গিয়ে মনে পড়ছিল, ছাত্র জীবনে কবিতাগুলো যেন বাঁধ-ভাঙা আবেগের প্রগলভতা নিয়ে পড়েছিলাম। সে বয়সে রবীন্দ্র, নজরুলের বাইরে নাজিম হিকমত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মোহন রায়হান এঁরা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। বাঁশী বা কেউ কথা রাখেনি, কবির মৃত্যু, বা জেলখানার চিঠি ইত্যাদি কবিতা থেকে দু'চার ছত্র মুখস্থ থাকা চা'ই। তখনকার দিনে কবিতা আওড়ানোর মধ্যেও একপ্রকার আভিজাত্য ছিল। আজকাল ক্যাম্পাসে কি হয় খুব জানতে ইচ্ছে করে। তবু বলা যায়, মুখস্হ যুগের অবসান হয়েছে। তবে এ কবিকে না পড়লে বলা যাবেনা, কী বিস্ময়কর খেদ ও মনোবেদনা নিয়ে এ পৃথিবীর অশ্রুত গান তিনি গেয়ে গেছেন। কেমন নিপুণ কারিগরের হাত দিয়ে নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবন বা বার্ধক্যের জলছবি তিনি এঁকেছেন। প্রকৃতির রূপ-রূপান্তর, বৃক্ষ লতাপাতা, নদী-নালা, দিগন্ত উন্মোচিত নিসর্গের সংগীত ভেসে আসছে তাঁর নির্বাচিত বর্ণমালায়। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র এবং তৎকালীন পাকিস্তান এলিট সার্ভিসের সদস্য হয়েও মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাঁর অপরিমেয় ভালবাসার এক আশ্চর্য চিত্র ফুটে ওঠেছে কবিতার প্রতিটি শব্দের গভীরে, অনুপ্রাসের গহীনে বা অন্ত্যমিলের বৃত্তাংশে। কবিরা নাকি কল্পলোকের বাসিন্দা হয় কিন্তু এই কবির দৃষ্টিতে যেন আষ্টেপৃষ্টে ধরা পড়েছিল আবহমান বাংলা, মা, মৃত্তিকা ও মানুষের ক্ষুদ্র জীবনকালের বিমূর্ত রূপের নিগূঢ় ভাষাচিত্র। বিশেষ করে তাঁর 'আমার সময়' কবিতাটি তখনও আমি বারবার পাঠ করেছি এবং মুগ্ধতা ভরে কল্পনা করেছি। দেখেছি চোখের আলোয় উদ্ভাসিত গাঢ় শ্যামল এক মনোজ্ঞ ক্যানভাস।
তিনি লিখেছেন--
আমার
মা'র চুল
লম্বা
এবং কাল ছিল
কবর
কি চুলের মত কালো?
বা
--
এবং
ইদানীং
আমি
আমার বন্ধুদের
অনায়াসে
এড়িয়ে চলি।
আমি
কখনো
মেষ
পালক ছিলাম না
অথচ
গোধূলি এবং সন্ধ্যার
অন্তর্বতী
বিষাদ
রাখালের
বাঁশির মত
আমার
সঙ্গে বাস করে।
অথবা
--
আমার
সময়ে যুবকেরা
হয় আত্মগোপন করতো
অথবা
ধরা পড়তো
অথবা
মরে যেতো।
আরও
--
বৃক্ষ
যেমন পাখির জন্য
ছায়া
ধরে রাখে
নদী
যেমন মাছের জন্য
কোল
পেতে থাকে
কালো
মেঘ যেমন ফুলের জন্য
বর্ষিত
হয়
ফুল
যেমন মৌমাছির জন্য
মধুময়
হয়
আমি
কিছু দিতে পারি না।
আমি
কবিতার কিছু বুঝি না।
লিখতে সাহসও করি না। যদিও
কখনও কখনও কবিতা আমাকে
মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তবে
মনে হয়, কবিতা কেবল
শোনার বিষয়, ভাব ও ভঙ্গির
বিষয়। ছন্দের টানেই রচিত হয় কবিতা,
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের সমন্বিত মিছিলের প্রতিধ্বনি পাঠকের কর্ণ থেকে হৃদয়ে
দোলা দিতে পারে। কবিতা
পড়ে এর যথাযথ অর্থ
খোঁজা পাঠকের কাজ নয়। কবিতার
জন্য প্রয়োজন একটি সংবেদনশীল কান
এবং মন , যা আবু
জাফর ওবায়দুল্লাহ'র শব্দে ও
উপমায় প্রস্ফুটিত হয়ে চারদিকে ধ্বনিত হয়েছে।
৪) বইটির এক প্রান্তের ফ্ল্যাপে
লেখা মন্তব্যও পাঠযোগ্য-
'আবহমান
বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসের
রক্তাক্ত পথ ধরে দেশ
কাল ও সময়ের পটভূমিতে
স্বদেশের প্রতি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র প্রগাঢ় কন্ঠের
দূরাগত ঝর্ণাধ্বনির মত মন্ত্রোচ্চারণ 'আমার
সময়'কে বাংলাদেশের জাতীয়
মহাকাব্য বললে অত্যুক্তি করা
হয় না।
সেই
সঙ্গে খালিদ আহসানের সাবলীল রঙ ও রেখার
টানে রচিত হয়েছে এক
আশ্চর্য ধাতব সঙ্গীত নির্ঝর'।
৫) সত্তুরের দশকের শেষ দিকেই কবি
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ 'র
মৌলিক কবিতাগুলো জনপ্রিয়তার বিচারে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল।
বিশেষ
করে তাঁর 'আমি কিংবদন্তির কথা
বলছি' এবং 'বৃষ্টি ও
সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা' নতুন
প্রজন্মকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
আবৃত্তি শিল্পী বা বাচিকগন তাঁর
কবিতাকে স্বকন্ঠে লালন করে নিজেরাও
আলোচিত হয়েছেন। বলা যায়, আমি
কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি
আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি এই
কবিতাটি স্বাধীনতােত্তর কালের সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম প্রধান একটি।
এই কবিই বলেছেন,
"আমি
কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি
আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি,
বা
জিহবায়
উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানেনা সে আজন্ম
কৃতদাস
থেকে যাবে"।
জয়তু
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
ও তাঁর
কাব্যগ্রন্হ 'আমার সময়'।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭