ইনসাইড থট

মনি ভাই, আপনার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলি না


প্রকাশ: 04/12/2022


Thumbnail

আমার ছাত্র রাজনীতিতে প্রকৃত গুরু বলতে যদি কেউ থাকে তাহলে অবশ্যই বলতে হবে শেখ ফজলুল হক মনি। মনি ভাই আমার রাজনৈতিক গুরু অর্থাৎ রাজনৈতিক মেন্টর। যদিও মরহুম আব্দুর রাজ্জাক সাহেব এবং আমার ভাগিনা শহিদুল হক মুন্সী দুজনই আমাকে প্রথম ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন এবং মনি ভাইয়ের কাছে নিয়ে যান। মনির ভাইয়ের সাথে কথা বলার পরে জিজ্ঞাসা করলো বাড়ি কোথায়? আমি বললাম গোপালগঞ্জ। শুনে তিনি মুচকি হাসি দিলেন।

মাঝে মাঝে মনি ভাইয়ের আরামবাগের বাসায় যেতাম। আজ মনি ভাইয়ের জন্মদিনে তার ব্যাপারে দুটো বিষয় উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। মুক্তিযুদ্ধের পরে একজন যুবক আমার সাথে দেখা করলেন। আমি তাকে মনি ভাইয়ের খুব নিকটস্থ কর্মী হিসেবে চিনি। মনি ভাইয়ের প্রায় অন্ধ ভক্তই বলা চলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেহেতু মনি ভাই মুজিব বাহিনী থাকতেন এবং আমি মুজিবনগরে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অন্যভাবে যুক্ত ছিলাম। তো সেই যুবকটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি। সে এসে আমাকে বললেন যে আমি কি আপনাকে সালাম' করতে পারি? আমি বললাম, আমি আর এমন কি, সালাম করতে হবে না। তবু সে সালাম করবেই। আমি বললাম করো। সালাম করে সে আমাকে বলল, আপনার সাথে দেখা হয়নি আগে কিন্তু আমি মনি ভাইয়ের কাছে আপনার কথা শুনেছি। তিনি আপনাকে এতো পছন্দ করেন যে আপনার কোনো কথা ফেলবেন না।

সে আমাকে বলল, আমি খুবই সাধারণ মধ্যম শ্রেণীর পরিবারের ছেলে। আমার একটা চাকরি খুব দরকার। আমি রাজনীতি করতে চাই না। আমি বললাম তুমি মনি ভাইকে বলো। সে বলল আমি অনেক বলেছি, কিন্তু ভাই শুধু চুপ থাকেন। তারপর একজন বুদ্ধি দিলো যে আপনাকে দিয়ে মনি ভাইকে বলাই। আমি তাকে বললাম, আমি প্রথমত তোমাকে চিনি না। সে জবাব দিলো আপনিতো আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন, তখনি তো বুঝবেন যে আমাকে আমি মনি ভাইয়ের লোক কিনা। তারপর আপনি বলবেন। এইজন্য তো আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি বললাম ঠিক আছে।

তার পরেরদিন তাকে নিয়ে মনি ভাইয়ের ওখানে গেলাম। আমাকে দেখে মনি ভাই বলল, কিরে তুইতো বলেছিস তুই লেখাপড়া করবি। আমার এখানে তুই আসছিস কেন? পত্রিকায় লিখবি নাকি? আমি হাসে বললাম, আমারে চোখের লেখাপড়া চলছে। আশা করি এবার শেষ করতে পারব। তো এখন বল কি জন্য আসছিস? তার সাথে অনেক লোকজন। জিজ্ঞাস করলাম সবার সামনে বলা যায় বলা যাবে? তিনি অনুমতি দিলেন। আমি আমার সাথের যুবকটিকে দেখি বললাম, উনিতো আপনার সাথে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করেছে। মনি ভাই তাকে দেখে বললেন, যদি বিশিষ্ট কয়েকজন মাত্র আমার মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার বিশ্বস্ত কর্মী এবং রাজনীতি বুঝে মুক্তিযুদ্ধ করেছে এমন কয়েকজনের কথা বলি তাহলে তাদের মধ্যে এই যুবক একজন। আমি বুঝলাম যে ছেলেটি যা বলেছে তা সত্যিই বলেছে। আমি বললাম মনি ভাই ও আমাকে নিয়ে এসেছে একটা তদবির করার জন্য। মনি ভাই বলল, কি অনুরোধ করার জন্য এনেছে তা আমি জানি। আমি একটু চুপ করে থাকলাম। ওকে একটা চাকরি দিতে হবে, এইতো? আমি বললাম, জী। মনি ভাই বললেন, ঠিক আছে ওকে আমি চাকরি দিবো। ছেলেটিকে বললেন, তুমি যাও। যাওয়ার পর মনি ভাই একা আমাকে কিছু কথা বললেন। মনি ভাই বললেন, শোন, তোকে একটা কথা বলি। তোর ভবিষ্যতে অনেক কাজে লাগবে। আমি চুপ করে আছি। মনি ভাই আমাকে বললেন, এই যে কর্মীটা যাকে আনলি তাকে আমি চাকরি ঠিকই দেবো কথা দিলাম। কিন্তু হবে কি জানিস? এর ফলে আমাদের বিপদ-আপদের সময় সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং রাজনৈতিক সচেতন একজন কর্মীকে সারা জীবনের জন্য হারলাম। এই চাকরি দেওয়ার জন্যই তার নিজের ক্ষতি হলো, আমাদের ক্ষতি হলো এবং দেশের ক্ষতি হলো। এটা তোকে বললাম তোর মনে রাখার জন্য। মনিভাই তার কথা রাখেন। ছেলেটির চাকরি হয়। এরপর তার সাথে আমার একবার দু'বার দেখা হয়েছে। এখন সে কোথায় আছে আমি জানিনা। এই হচ্ছে কর্মীদের সম্পর্কে মনি ভাইয়ের মূল্যায়ন।

আরেকটি কথা আমি বলতে চাই, তখন আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমাদের তখন রাতে ক্লাস থাকতো এটা মনির ভাই জানেন। আমি গিয়েছিলাম মনি ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। তখন সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটা বাজে। আমাকে দেখেই মনির ভাই খুবই রাগ হয়ে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, এখন আসছিস কেন? তোর তো এখন ওয়ার্ডে থাকার কথা। আমি এত ভয় পেয়েছি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তুই ডাক্তার হবি। তোর প্রয়োজন হলে দিনের বেলা আসতি। ক্লাস ফাকি দিয়ে কেন? তোদের রাতের ক্লাস তো গুরুত্বপূর্ণ। আমি এতো ভয় পেয়েছিলাম যে, আর কিছু না বলে শুধু বললাম, তাহলে ঠিক আছে আসি মনি ভাই। সালাম করতে গেলাম। আমাকে বললেন সালাম লাগবে না। ওই ভাতের টেবিলে বস। আমাকে ভাত খাইয়ে একটা টাকা দিয়ে বললেন, যা রিকশা নিয়ে চলে যাবি। তার কথা আমি জীবনে ভুলবো না। আমার মনে হয় একজন ছাত্র নেতা হিসেবে একজন যুব নেতা হিসেবে মনির সাথে তুলনা করার মত আরেকটি লোক আমি এখনো দেখি না।

মনি ভাইকে যারা হত্যা করেছে তারা বুঝেই হত্যা করেছে এবং জানে যে মনি ভাই জীবিত থাকলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে হত্যাকারীরা কোনদিনও রেহাই পেতো না।

মনি ভাই, আপনার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলি না। আপনার সন্তান তাপস এবং পরশ আমাকে পিতৃতুল্য সম্মান করে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া যে আপনার এত সুন্দর সোনার চাঁদের মত দুটি ছেলে আল্লাহ জীবিত রেখেছে এবং তারা ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭