এডিটর’স মাইন্ড

মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান পত্নী এবং পরিজন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৪ মে, ২০২২


Thumbnail মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান পত্নী এবং পরিজন

১৯৯৮ সাল। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আওয়ামী লীগ। জিল্লুর রহমান একাধারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সহধর্মিণী আইভি রহমান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য জিল্লুর রহমানের দফতরে গেছি। আমরা ক্যামেরা লাইট এসব ঠিক করছি। এ সময় আরও দু-একজন নেতা নিয়ে মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলেন আইভি রহমান। আইভি রহমানকে বসিয়েই মন্ত্রী গেলেন ভিতরের ছোট কক্ষে। এ সময় মন্ত্রীর টেবিলে থাকা লাল ফোন বেজে উঠল। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে আমি আইভি রহমানকে বললাম ফোনটা ধরতে। আইভি রহমান ফোনটা ধরলেন না। পরে মন্ত্রী এসে দেখলেন। ফোনটা এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। জিল্লুর রহমান ফোন করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত কথা বলে রেখে দিলেন। সাক্ষাৎকার শেষ করে বিদায় নিচ্ছি। তখন আইভি রহমান আমাকে বললেন, ‘শোন ওটা লাল ফোন। লাল ফোন যার নামে তিনি ছাড়া এটা ধরার এখতিয়ার কারও নেই।’ আইভি রহমানের এই কথাটার তাৎপর্য যথার্থ বুঝলাম এত বছর পর। রেলমন্ত্রীর ৯ মাসের দাম্পত্য সঙ্গীর ক্ষমতার দাপট দেখে। আওয়ামী লীগে আইভি রহমান জনপ্রিয় মুখ ছিলেন। তাঁর নিজস্ব পরিচয় ছিল। কিন্তু তারপরও মন্ত্রীর লাল ফোন তিনি ধরেননি। আর রেলমন্ত্রীর পত্ন্নী ৯ মাস হলো বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রেল মন্ত্রণালয়কেই অস্থির করে তুলেছেন। রেলের টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করার আগে অবশ্য রেলমন্ত্রীর নবপরিণীতার ক্ষমতা সম্পর্কে আমজনতা খুব একটা জানত না। বিয়ের ৯ মাসে তিনি কেবল তার স্বামীকেই আপন করে নেননি। রেল মন্ত্রণালয়কেও সংসারের একটা অংশ বানিয়ে ফেলেছেন। এখন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, মন্ত্রীপত্নীর সিন্ডিকেটের। মন্ত্রীপত্নী ঠিকাদারি, টিকিট কিংবা অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কি না সে বিতর্কে আমি যাব না। রেলমন্ত্রী এসব জানতেন কি না, সে প্রশ্নও আমি করব না। তবে রেলমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ৯ মাস। এখনো তার বোঝার অনেক বাকি।’ তার এই বক্তব্যের সহজীকরণ করলে যা দাঁড়ায়, মন্ত্রীপত্নী এখনো ‘অবুঝ বধূ’। বাংলা সাহিত্য ঘাঁটলেই অবুঝ বধূদের নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিপত্তির কথা জানা যায়। তবে রেলমন্ত্রীর অবুঝ স্ত্রীর এই অধ্যায়টি সাহিত্য বা ইতিহাসে স্থান পাবে কি না আমরা এখনো জানি না। গণমাধ্যমে এ বিষয়টি এমনভাবে আসছে যাতে মনে হতে পারে শুধু রেলমন্ত্রীর স্ত্রীই বোধহয় ‘ক্ষমতাবান’। কিন্তু বাস্তবতা তেমনটি নয়। রেলমন্ত্রীর পত্নী আলোচনায় এসেছেন একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কয়েক মাস ধরেই মন্ত্রণালয়ের লোকজন তার ক্ষমতার উত্তাপের আঁচ পেয়েছেন। আবার রেলমন্ত্রীর পত্নী এবং পত্নীপরিজন যেভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন, সেভাবে আর কেউ দেখান না এমনটি নয়। কান পাতলেই শোনা যায় অনেক মন্ত্রীর পরিজনের ক্ষমতার দাপটের কথা। অনেক মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন মন্ত্রীদের নিকটজনরা। টিটিই শফিকুলের মতো কোনো ঘটনা ঘটে না এ জন্যই এসব গণমাধ্যমে আসে না। কিন্তু কান পাতলেই এসব ক্ষমতার দাপটের কথা শোনা যায়। একজন মন্ত্রীপুত্র অভিজাত এলাকায় আলাদা অফিস নিয়েছেন। সেখানে ঠিকাদাররা নিয়মিত যান। দেন-দরবার হয়। মন্ত্রীপুত্র সরকারি একান্ত গোপনীয় ফাইল দেখেন। মন্ত্রীপুত্রের কথা অনুযায়ী মন্ত্রী ফাইলে স্বাক্ষর করেন। একজন মন্ত্রীর স্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প দেখভাল করেন। মন্ত্রীপত্নীর প্রতিনিধি হিসেবে আছেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব। এপিএস ছাড়া ওই মন্ত্রী কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করেন না। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের চারপাশে দেখা যায়। মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতায় তখন তার নিকটজনরা মধু খাবেন এটা স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ এটাকে মেনেই নিয়েছে। যারা মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার বাণিজ্যে নেই তারা আছেন বিদেশ ভ্রমণ। মন্ত্রীরা যখন বিদেশ সফরে আত্মীয়-পরিজনকে নিয়ে একটু আনন্দ ভ্রমণ করেন, তখন আমলা এবং অধস্তন কর্মকর্তারা কীভাবে চুপচাপ বসে থাকবেন। সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি সফর তালিকায় চোখ রাখলাম। ৫৫ জনের বিশাল বহর। তালিকায় এক প্রতিমন্ত্রীর দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ জিনিসটা কী বোঝার জন্য একটু খোঁজখবর নিলাম। জানা গেল ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হলো আসলে চাকর-বাকর। কোটটা পরিয়ে দেবে। জুতাটা পায়ে গলিয়ে দেবে। গালে ময়লা লাগলে টিস্যু দিয়ে মুছে দেবে। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অনেক কাজ। তাই একজন প্রতিমন্ত্রী দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করবেন, এতে অবাক হওয়ার কী আছে। প্রতিমন্ত্রী যখন দুজন চাকর-বাকর (ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) নিয়ে যাচ্ছেন, তখন তার মা-বোন না গেলে বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড হবে না। এটা তো রীতিমতো গৃহবিবাদ সৃষ্টি করবে। প্রতিমন্ত্রী বুদ্ধিমান, তাই তার মা এবং বোনকেও সফরসঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী যদি তার পারিবারিক সুখ সুরক্ষায় মনোযোগী হন, তাহলে তার অধস্তন কর্মকর্তারাও তো তা অনুসরণ করবেন। না হলে, সেটা হবে অবাধ্যতা। তাই এই মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার স্ত্রী-কন্যাকে সঙ্গী করেছেন। প্রতিমন্ত্রীরা যদি চৌদ্দগোষ্টিকে সফরসঙ্গী করেন, তাহলে এমপিরা কি বিদেশে গিয়ে নিঃসঙ্গতাকে বরণ করবেন? এটা কী করে হয়? তাই সফর তালিকায় থাকা এমপি তার স্ত্রীকেও সঙ্গী করেছেন। সংসদ সদস্য মানে তো শুধু পুরুষ নন, নারীরাও এখন সংসদ সদস্য হচ্ছেন। নির্বাচন করে অথবা কোটায়। পুরুষ সদস্য যদি তার পত্নীকে সফরসঙ্গী করেন, তাহলে বিষয়টি ভারী পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যায়। এ জন্য সফরে যাওয়া মহিলা এমপিও তার স্বামীকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বামীকে একা রেখে যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। এভাবে পারিবারিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রাষ্ট্রের পয়সায় বিদেশ যাওয়াটা এখন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিমন্ত্রী বিদেশযাত্রায় পারিবারিক ব্যাপ্তি আরও বড় করেছেন। প্রতিমন্ত্রী যাচ্ছেন সুইজারল্যান্ড। অপরূপ সুন্দর দেশ। এমন দেশে একা যাওয়া রীতিমতো গর্হিত কাজ। এ জন্য প্রতিমন্ত্রী তার নিকটজনের কাউকে বাদ দেননি। প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে, মেয়ের জামাই এমনকি প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাইও সফরসঙ্গী। প্রতিমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তাও তার স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়েছেন সঙ্গী হিসেবে। মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের এক রকম যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণ প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। বুধবার অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী অযথা বিদেশ ভ্রমণ না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার মর্মার্থ কি আমাদের মন্ত্রী মহোদয়গণ অনুভব করবেন? যেসব মন্ত্রীর আত্মীয়-পরিজন মন্ত্রণালয়ে নেই। প্রমোদ বিহারের সঙ্গী নন, তাদেরও দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা এলাকায় আছেন। মন্ত্রীদের এখন ক্লোন হচ্ছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন আর তাদের ভাই-ব্রাদাররা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাইয়েরাই এলাকায় মন্ত্রী কিংবা তার চেয়েও ক্ষমতাবান। একজন মন্ত্রী ভাইদের বিশ্বাস করেন না। নিজের স্ত্রীকেই স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন। জিতিয়ে এনেছেন। তাদের কথায় এলাকার প্রশাসন ওঠবস করে। জনগণ তটস্থ থাকে। কিছুদিন আগে সাবেক এক মন্ত্রীর ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। মন্ত্রীর চেয়েও তিনি এলাকায় ক্ষমতাবান ছিলেন। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন স্রেফ দুর্নীতি করে। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আগে তাকে নিয়ে কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। এখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ভাইদের নানা কথা বাতাসে ভাসে। কোনো মন্ত্রীর ভাই নদী দখল করে জমির মালিক হয়েছেন। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে আবার জমি সরকারের কাছে বিক্রির পাঁয়তারা করেছেন, সে খবর আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার কোনো কোনো মন্ত্রীর ভাইয়েরা ভীষণ চতুর। তারা কাজ করেন নীরবে, নিভৃতে। মন্ত্রীর ভাইয়েরা যে এলাকায় অঘোষিত মন্ত্রী এমনটা কিন্তু নয়। অনেক মন্ত্রীর পত্নীও এলাকায় ব্যাপক আলোচিত। কোনো কোনো মন্ত্রীর সহধর্মিণী মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় নেমেছেন। স্বামী সামনে মন্ত্রীর চেয়েও বড় পদে যাবেন। এলাকায় নির্বাচন করবেন না। তিনিই আগামী দিনের প্রার্থী। এমন ঘোষণার কথাও কোথাও কোথাও শোনা যায়। এসব সত্য না মিথ্যা সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু জনগণের মধ্যে এসব নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ ধারণাগুলো সংক্রামক। বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারাই আজকাল বলাবলি করেন, কিছু মন্ত্রী সরকারকে লজ্জায় ফেলছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মন্ত্রী এবং তার পত্নীপরিজনের জন্য লজ্জিত হলেও মন্ত্রীরা কি তার স্বজনদের নিয়ে লজ্জিত? আওয়ামী লীগের এই ‘সৌভাগ্যবান’ মন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নাম বলে মাতম করেন। কিন্তু জাতির পিতার আদর্শ এবং জীবনাচার কতটুকু অনুসরণ করেন? জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা কী সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আজকাল ভিআইপি বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছু কিছু মন্ত্রীর পত্নীদের দেখলে মনে হয় যেন আস্ত একটা সোনার দোকান গায়ে জড়িয়েছেন। বঙ্গমাতা কোনো দিন রাষ্ট্রীয় কাজে নাক গলাননি। তিনি ছিলেন দুঃসময়ের কাণ্ডারি। দল যখন বিপর্যস্ত, বঙ্গবন্ধু যখন কারাবন্দি তখন দলের হাল ধরেছেন। কিন্তু কোনো পদ নেননি। বঙ্গবন্ধু মহামানব। বঙ্গমাতার উচ্চতায় এখন আর কারও পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু শেখ হাসিনার জীবনাচার তো স্বজনকাতর মন্ত্রীদের অজানা থাকার কথা নয়। ’৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করতেন। ওয়াজেদ মিয়ার চাকরি শেষ হওয়ার পর অবসরে যান। শেখ হাসিনা তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেননি। এটাই শেখ হাসিনার আদর্শ। ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে ড. ওয়াজেদ মিয়া কটি বিদেশ সফরে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসেবে সরকারি গাড়ি তাঁর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া কোনো দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকলের গাড়ি ব্যবহার করেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তার কদিন বাদেই (২০০৯-এর মে মাসে) মৃত্যুবরণ করেন এই অসামান্য মেধাবী মানুষটি। শেখ হাসিনার পরিবারের অন্য সদস্যরাও কখনো ‘ক্ষমতাবান’ হিসেবে আবির্ভূত হননি। ক্ষমতার দাপট দেখাননি। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ অটিজম নিয়ে কাজ করেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশে^ তিনি অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশও অটিজমকে গুরুত্ব দিয়েছে সায়মা ওয়াজেদের একান্ত পরিশ্রমের জন্যই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অটিজম সেল হয়েছে। এই সেলের দায়িত্বে এক সময় ছিলেন সুভাষ চন্দ্র সরকার। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তিনি এই সেলের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু মন্ত্রীর সঙ্গে তার বিরোধ হয়। এক সময় মন্ত্রী তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। মন্ত্রীর অনুরোধে সুভাষ চন্দ্র সরকারকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। বদলির সময়ই একটি অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তৃতা দিতে আসেন সায়মা ওয়াজেদ। সুভাষ চন্দ্র সরকার নিজেই আমাকে এক দিন এ ঘটনাটির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে চা পান করতে করতে সায়মা ওয়াজেদ জানেন যে সুভাষকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এটি শুনে সায়মা দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আমি আপনার কর্মতৎপরতা মিস করব। সুভাষ বললেন ‘আমাকে এখানে রাখার জন্য একটু বলতে পারেন কি?’ সায়মা ওয়াজেদ উত্তরে বলেছিলেন ‘দুঃখিত। এটা করতে পারব না। মা এসব একদম পছন্দ করেন না।’ প্রধানমন্ত্রীর কন্যা তাঁর সেক্টরে ভালো কাজ করা এক ব্যক্তির বদলি থামাতে তদবির করেন না। অথচ সেই প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় অনেক মন্ত্রীর পত্নী-পরিজন বদলি এবং নিয়োগ বাণিজ্যকে রীতিমতো পেশা বানিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের স্বজনপ্রীতির সূচনাকাল ১৯৭৫। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই এটাকে ভোগের সুযোগ হিসেবে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে জিয়াউর রহমানকে সৎ হিসেবে চিত্রিত করার প্রাণান্তর চেষ্টা করা হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি দেখিয়ে এটিকে এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কিন্তু জিয়া এবং তার পরিবার কতটা সৎ ছিল, তা নিয়ে সত্যনিষ্ঠ কোনো গবেষণা নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখব হয়তো ভবিষ্যতে। কিন্তু ছোট একটি তথ্য দিতে চাই এ লেখায়। জিয়া ততদিনে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ৬ জুন ১৯৭৭ সালে জিয়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে গেলেন। সঙ্গে তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্র। আট দিন পর জিয়া দেশে ফিরলেন একা। তার পত্নী এবং পুত্ররা মাস কাটাল লন্ডনে। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করে। এ সময় এ নিয়ে সরকারের মধ্যে নানা কথাবার্তা হয়। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পেতেন। ভারতের আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়া টুডে’ এ নিয়ে একটি ছোট্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। জিয়া ‘ইন্ডিয়া টুডে’র ওই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। জিয়ার জীবদ্দশায় বাংলাদেশে ইন্ডিয়া টুডে নিষিদ্ধ ছিল। জিয়ার শাসনামল ছিল এক অন্ধকার সময়। অবরুদ্ধ সময়। সে সময়ের খুব কম তথ্যই মানুষ জানত। লন্ডনে প্রমোদ ভ্রমণের মতো অনেক তথ্যই বন্দি করে রাখা হতো। এরশাদের জমানায় অবরুদ্ধ তথ্যের দেয়ালে চির ধরে। এরশাদের বিনোদন বিলাস, তার বান্ধবী এবং পত্নীগণের অনেক কেচ্ছা-কাহিনি সে সময় বিদেশের গণমাধ্যমে বেরোতে থাকে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সে সময় মোশাররফ হোসেন। তিনি পরবর্তীতে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরশাদ জমানায় তার স্ত্রীর দাপট ছিল সর্বত্র। এটা অবশ্য তার সরকারি চাকুরে স্বামীর বদৌলতে নয়। এরশাদের কারণে সরকারে প্রচণ্ড ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন জিনাত। এরশাদের পতনের পর বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন। বেগম জিয়ার হাতেই পরিবার এবং স্বজন তোষণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বেগম জিয়ার ভাইবোন হয়ে ওঠেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। ২০০১ সালে বেগম জিয়া দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে জিয়া পরিবার এখনকার শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবারের মতোই রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক হয়ে যান। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে তার পুত্র তারেক রহমান হয়ে ওঠেন অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার এক ভাই হন সেনাবাহিনীর কেনাকাটা সিন্ডিকেটের প্রধান। মন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের হাতে বিমান দেউলিয়া হয়। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান টেলিকম, বিজ্ঞাপন ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব পান। ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন তিনি। পাঠক একটু মিলিয়ে দেখুন, এখন শ্রীলঙ্কায় যে অবস্থা ঠিক এরকম অবস্থাই বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। জিয়া পরিবারের কাছেই ছিল সব ক্ষমতা। আজ শ্রীলঙ্কায় যা ঘটছে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তা ঘটে গেছে। ক্ষমতা ভোগের এই ব্যাধি এখন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো মন্ত্রীর মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। ভালো লক্ষণ হলো ব্যাধিটা চিহ্নিত হয়েছে। এখন এর চিকিৎসা প্রয়োজন।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

রেলমন্ত্রী   ট্রেন   ক্ষমতাবান   পত্নী   পরিজন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কমে গেল কাদেরের দাপট?

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ০২ মে, ২০২৪


Thumbnail

ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এমন একজন নেতা যিনি ওবায়দুল কাদেরের এই সিদ্ধান্ত মানেননি। সিদ্ধান্ত না মেনে তিনি ধানমণ্ডি ৩ নম্বর কার্যালয়ে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের তোপের মুখে পড়েন। ওবায়দুল কাদের তাকে বলেন, আপনি তো দলের কোন সিদ্ধান্তই মানেন না। কিন্তু তার পরও শাজাহান খান তার ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে রাখেন এবং দলের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন আশঙ্কার মধ্যেই তিনি উপজেলা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির সংবাদ সম্মেলনের পর দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদের যা বলেছেন এবং আওয়ামী লীগের যে সিদ্ধান্ত তার মধ্যে দুস্তর ফারাক রয়েছে। ওবায়দুল কাদের যেভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বাস্তবতা তা নয়। ওবায়দুল কাদের যত গর্জেছেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ তত বর্ষেনি। আর একারণেই এখন ওবায়দুল কাদেরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।


এমনিতেই আওয়ামী লীগে বেশ কিছুদিন ধরে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির বাইরে অন্য কোন নেতার কথা তৃণমূলের আওয়ামী লীগ বা মাঠ পর্যায়ের নেতারা মোটেও কর্ণপাত করেন না। তাদেরকে খুব একটা আমলে নেন না। তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে কথা। তিনি দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তি যখন বলছেন, সকলে ধরে নিয়েছিল যে, এটি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এবং ওবায়দুল কাদের এটিকে শেখ হাসিনার নির্দেশনা বলেই অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা একরামুল করিম চৌধুরী, শাজাহান খান এবং ড. রাজ্জাকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন এবং তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থিতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই তিনজনের কেউই ওবায়দুল কাদেরের কথায় কর্ণপাত করেননি। 

ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা অমান্য করে তারা প্রার্থী হওয়ার পর এখন দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের অবস্থানই এখন আর সঠিক নেই। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। অথচ ওবায়দুল কাদের একাধিক গণমাধ্যমে বলেছিলেন যে, ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই হয়নি। তাহলে কী ওবায়দুল কাদের বাড়িয়ে বলেছেন? 


কেউ কেউ দাবি করেন, যেহেতু একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সেহেতু ওবায়দুল কাদের বিষয়টিকে বড় করে দেখেছেন এবং তিনি নিজেই উপজেলা নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। কারণ তার নির্বাচনী এলাকায় যদি একরামুল করিমের সন্তানও উপজেলা চেয়ারম্যান হয় তাহলে তার এলাকায় আধিপত্য কমে যাবে। আর একারণেই হয়তো তিনি বিষয়টিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।

আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই মনে হয় যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতারা এই বিষয় নিয়ে গর্জে ছিলেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বিষয়টিকে অতটুকু গুরুত্বতর মনে করেন না। বরং তার প্রধান আগ্রহের ব্যাপার হলো উপজেলা নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। আর এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনা সবসময় যা বলেন সেটিরই পুনঃউচ্চারণ করেন এই বক্তব্যটি ঠিক না। শেখ হাসিনা আত্নীয় স্বজনদের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একই রকম বক্তব্য রাখেননি। আর এর ফলে ভবিষ্যতে ওবায়দুল কাদেরের হুশিয়ারি বা নির্দেশনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কতটুকু শুনবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন তাহলে কী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাপট কমে গেল?




ওবায়দুল কাদের   আওয়ামী লীগ   সাধারণ সম্পাদক  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন। 

আগামীকাল ৩০ এপ্রিল দলটির কার্যনির্বাহী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এবং এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল ৩০ এপ্রিলের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ৩০ এপ্রিল কি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধোঁকা খাবে? যারা ক্ষমতাবান মন্ত্রী-এমপি সংসদ সদস্য তারা তাদের সন্তানদেরকে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী করার ফলে তারা কি শাস্তি পাবেন? নাকি এবারেও তারা পার পেয়ে যাবেন? ৩০ এপ্রিল কি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হবে, নাকি ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ আবারো ধোঁকা খাবে। 

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যারা সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন, যারা স্বজনপ্রীতি করেছেন, যারা ভাই, ভাতিজা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, শ্যালককে প্রার্থী করেছেন তাদেরকে লাল কার্ড দেখানো হবে। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেহেতু কঠোর বার্তা দিয়েছেন সেহেতু তার কাছে নিশ্চয়ই ‘ট্রাম্প কার্ড’ আছে। আর এই এই ট্রাম্প কার্ড দেখানো হবে ৩০ এপ্রিল। দলের সিদ্ধান্ত যারা লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। 

আওয়ামী লীগের জন্য ৩০ এপ্রিল দিনটি অত্যন্ত প্রতারণামূলক এবং ধোঁকা খাওয়ার দিন হিসেবেই পরিচিত। ঠিক কুড়ি বছর আগে এই ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ধোঁকা খেয়েছিলো। তখন পাদপ্রদীপে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিলের আগে প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে আসতেন এবং কিভাবে সরকারের পতন হবে সেবিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতেন। ৩০ এপ্রিলের আগে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সে কর্মসূচি গুলোর মাধ্যমে সরকার পতনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিল ম্যাজিক দেখাবেন বলেই বারবার ঘোষণা করছিলেন। তার কাছে ট্রাম্প কার্ড আছে এমন বক্তব্য তিনি রেখেছেন একাধিকবার। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কিছুই হয়নি বরং আওয়ামী লীগই অসম্মানিত হয়েছে। 

সাধারণ মানুষের কাছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি হাস্যকর হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের গ্লানি আওয়ামী লীগকে বহুদিন বহন করতে হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ৩০ এপ্রিল নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কম টিটকারি করেনি। আবার একটা ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্য নির্ধারণের দিন। এবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই পাদপ্রদীপে। ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি ৩০ এপ্রিল আবারো আওয়ামী লীগ ধোঁকা খাবে। গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবাই নেতা হয়ে গেছেন, কেউ কাউকে মানছেন না। তবে একটা আশার ব্যাপার ছিলো। সকলে মনে করতেন যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ঐক্যের প্রতীক। তাকে সকলে মানেন এবং তার কথার কেউ অবাধ্য হবেন না। 

২০০৭ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ এবং কোন্দলকে প্রশ্রয় দেয়া হতো একটি চিন্তা থেকেই। সেটি হলো আওয়ামী লীগে যে যত গ্রুপই থাকুক না কেন, যে যত পক্ষই করুক না কেন তারা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে। শেখ হাসিনা যা বলবেন সেটি তারা মানবেন। শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা। আর বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপগুলো তাকিয়ে থাকতো শেখ হাসিনার দিকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা আস্থা স্রেফ কথার কথা। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা যেটি বলেন সেটি আসলে বাস্তবে করেন না। শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেন। আর এটিই আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কার এবং উদ্বেগের বিষয় বলে আমি মনে করি। কারণ যদি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেও নেতারা অমান্য করে তাহলে দলের অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। আওয়ামী লীগ আসলে এবার সে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেই আওয়ামী লীগের ভিতর একটা ‘ফ্রি স্টাইল’ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যে যার মতো, যেমন খুশী বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সে বক্তব্যের কোন জবাবদিহিতাও ছিল না। একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও কেন্দ্রীয় সদস্যকে গালাগালি করেছেন, একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন। এটি আওয়ামী লীগে হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০১৮ এর পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ মুখোমুখি হয়েছে, হানাহানি করেছে, একে অন্যকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। এঘটনাগুলো যখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে তখনও আওয়ামী লীগের নেতারা নির্লিপ্ত ছিলেন। সারাদেশেই আওয়ামী লীগ দুই তিন ভাগে বিভক্ত। এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। যার ফলে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। 

২০২৪ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তটি ছিলো, দলের প্রতীক না পাওয়া ব্যক্তিরা দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবে। আর এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি-কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো এই বিভক্তি এবং কোন্দলগুলো দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বারবার নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করেও এ ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে যে, এই কোন্দল এবং বিভক্তি কমেনি। বরং বেড়েছে। এই কোন্দল বিভক্তি থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল আরেক সমস্যা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ এলাকায় জমিদারতন্ত্র কায়েমের মিশনে নেমে পরলো। তারা তাদের নিজেদের ভাই-ব্রাদার আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থী করে এলাকাগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মিশনে ঝাপিয়ে পরেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, উপজেলা নির্বাচনে কোন মন্ত্রী এমপি তার আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করতে পারবেন না। 

ধারণা করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের প্রতি সকলে সম্মান দেখাবেন। সকলে না দেখাক অন্তত যারা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতা, যারা মন্ত্রিত্বে আছেন কিংবা তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। তারা নিজেদের স্বার্থকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ভাই, সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থীতা থেকে সরে আসার অনুরোধ প্রত্যাখান করেছেন। তার মানে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা শ্রদ্ধা করেন না, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মানেন না। তারা দলকে বিকশিতও করতে চান না। এধরনের ব্যক্তিরাই যে আওয়ামী লীগে এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সেটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি এসেছে, আওয়ামী লীগ এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারী এবং দলের স্বার্থ পরিপন্থি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার বলছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল আসলে কি হবে? ৩০ এপ্রিল কি কুড়ি বছর আগের মতো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ধোঁকা খাবে? 

২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল যেমন আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের কর্মীরা অন্ধকারে ছিল। কি হবে তারা জানতেন না। তাদের জন্য কোন নির্দেশনা ছিলো না। রাজপথে নামার জন্য তাদেরকে কোন আহ্বান জানানো হয়নি। তারা বুঝতে পারেননি যে, কিভাবে সরকারের পতন ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের পতন ঘটেনি। ঠিক তেমনি এবারের ৩০ এপ্রিলও আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অন্ধকারে। তারা জানেন না ওবায়দুল কাদের কি ব্যবস্থা নিবেন এবং আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা। কারণ এর আগেও দেখা গেছে যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন তাদের খুব কম লোকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবান, স্বার্থান্বেষী এবং স্বজনপ্রীতি করা নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ কি পরাজিত হবে, নাকি সত্যি সত্যি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ কী ঘুরে দাড়াবে নাকি তৃণমূল প্রতারিত হবে। এই প্রশ্নটি এখন সবার সামনে বড় হয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সমস্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগের ভিতরে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক, শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার নির্দেশই যদি নেতারা অমান্য করেন তাহলে তাদের নেতৃত্বে থাকা উচিত? 

একটা কথা খুব স্পষ্ট, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য না। আওয়ামী লীগ যদি কঠোরভাবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তাহলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়বে, সাংগঠনিক শক্তি হারাবে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নাজুক অবস্থা নগ্নভাবে প্রস্ফুটিত হবে। যদি আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তাহলেই দলটি ঘুরে দাড়াবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। দেশে কোন বিরোধী দল নেই। সেই কারণে আওয়ামী লীগ একটা স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় আছে এবং কোনরকম চাপ অনুভব করছে না। কিন্তু যদি সংগঠন না থাকে, সংগঠন যদি এরকম হতশ্রী অবস্থায় চলে যায় তাহলে দুর্বল সংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কী টিকে থাকতে পারবে। এই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগকেই খুঁজতেই হবে।  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিএনপি কি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল। বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।

কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত। ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী। অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।

বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না। জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।

বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে উত্তর নেই।

খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী? নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে।

জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা। আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।

এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি, আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।

আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন, দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   জিয়া   পরিবারমুক্ত  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

৩০ এপ্রিল কী হবে আওয়ামী লীগে

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ। 

উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটা নিরপেক্ষ অবস্থান রাখতে চেয়েছিল। দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নয়, আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, উপজেলা নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করতে পারবেন তাদেরকে মন্ত্রী-এমপিরা সমর্থন দেবে না এবং আওয়ামী লীগ দলগত ভাবে কোন প্রার্থী দেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিরা মানেননি। তারা তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন এবং যারা আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী করেননি তারা নিজস্ব ব্যক্তিকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন এলাকায় আধিপত্য রক্ষার জন্য। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনা মানেননি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের ৩০ এপ্রিলের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এ নিয়ম আওয়ামী লীগের মধ্যে নানারকম চর্চা হচ্ছে। 

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা কারা কারা দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উপজেলা নির্বাচন করছেন, স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনের মাঠে নামিয়েছেন সেই তালিকা তৈরি করেছেন। আগামী ৩০ এপ্রিলের বৈঠকে এই তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে দেওয়া হবে। 

দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র গুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচনকে যেন কেউ প্রভাবিত করতে না পারে, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি কোনো ছাড় দেবেন না- এই বার্তাটি প্রধানত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেওয়া হবে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, যে সমস্ত মন্ত্রী এবং এমপিরা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজেদের স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে পর্যায়ক্রমে। আওয়ামী লীগ আকস্মিকভাবে তাদেরকে বহিষ্কার করা বা চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে না। বরং প্রথমে তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং যে সমস্ত নেতারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থী দিয়েছেন তাদের কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করার বিষয়টিও সামনে আসতে পারে। এ ছাড়া যারা মন্ত্রী এবং এমপি তাদের জন্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের বার্তা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একাধিক সূত্র বাংলা ইনসাইডারকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছেন। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো তাৎক্ষনিকভাবে সবাইকে বহিষ্কার করা বা দলে থেকে বের করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ তিনি নেবেন না। তবে বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য হলো উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা। নির্বাচনে যেন ভোটার উপস্থিতি বাড়ে সেটি নিশ্চিত করা। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে উপজেলা নির্বাচনে যেন মানুষ ভোট দিতে যায় সে বিষয়ে জনগণকে উদ্ধ করার পর জোর দিবেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ যেন উপজেলা নির্বাচনের যাকে ইচ্ছা মানুষ ভোট দিক সে বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ   কার্যনির্বাহী কমিটি   উপজেলা নির্বাচন   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন