এডিটর’স মাইন্ড

’৭৫-এর হাতিয়ার কি কেবলই স্লোগান?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৪ জুন, ২০২২


Thumbnail ’৭৫-এর হাতিয়ার কি কেবলই স্লোগান?

আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির বিকাশ। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর থেকেই রাজপথের আন্দোলন ছিল রাজনীতির প্রধান ধারা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এ রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেই বাঙালির জাগরণ ঘটে। ’৭০-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের গণরায়। এ আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত ছিল। ছিল সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ। এ আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতি ও চিন্তার মানকেও বিকশিত করেছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক কালজয়ী স্লোগান তৈরি হয়েছে। এসব স্লোগানের ঐতিহাসিক মূল্য অমূল্য। ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘রক্তসূর্য উঠেছে/বীর বাঙালি জেগেছে’। স্লোগানগুলোর রাজনৈতিক মর্মার্থ গভীর। সাহিত্যমূল্য অনেক উচ্চ। এসব স্লোগান বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক গন্তব্য ও আকাক্সক্ষার প্রকাশ। স্বাধীনতার পর জাসদের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির চরিত্রের সঙ্গে স্লোগানও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’, ‘অমুকের দুই গালে জুতা মার তালে তালে’ কিংবা ‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও দালালদের আস্তানা’ ইত্যাদি নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক স্লোগান রাজনীতির মাঠ দখল করে। এর বিপরীতে ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ/এসো দেশ গড়ি’ জাতীয় স্লোগান পানসে হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে মিছিল শুরু হতো ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। জাসদ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ দিয়ে মিছিল শুরু করা চালু করে। এ ধারায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালির জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। ইতিহাসে নির্মমতম বর্বরতার শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্লোগানের বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। একদিকে অমর সৃজনশীল স্লোগান উচ্চারিত হয়, অন্যদিকে তীব্র সাম্প্রদায়িক ও উসকানিমূলক স্লোগান রাজনীতির মাঠে জায়গা করে নেয়। ‘এক মুজিব লোকান্তরে /লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ কিংবা ‘মুজিব হত্যার পরিণাম/বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। এর মতো স্লোগানগুলো রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর বিপরীতে ‘রুশ-ভারতের দালালরা/হুঁশিয়ার সাবধান’। কিংবা ‘সিকিম নয় ভুটান নয়/এই আমাদের বাংলাদেশ’-এর মতো স্লোগানগুলো উচ্চারিত হতে থাকে। ’৭৫-এর পর স্লোগান থেকে নিষিদ্ধ হয় ‘জয় বাংলা’, আমদানি করা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এভাবেই রাজনীতিতে দুই মেরুর মতো দুটি বিপরীতমুখী ধারা সমান্তরাল চলছে। একটি ধারার রাজনীতি বাংলাদেশকে হৃদয়ে লালন করে। অন্য ধারার রাজনীতি হলো বাংলাদেশকে অস্বীকার করে, উগ্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে। আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফেরত নেওয়া।

এ দুই ধারার রাজনৈতিক স্লোগানও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রতিফলিত করে। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/মুজিব আছে দেশ জুড়িয়া’ এমন কাব্যিক স্লোগানের বিপরীতে ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান’-এর মতো ভয়ংকর স্লোগানও রাজনীতির মাঠে শোনা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্লোগান শুনে আঁতকে উঠেছি। বিস্মিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’। আমার বিবেচনায় এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, কুৎসিত বীভৎস রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রকাশ। এ স্লোগানটি যারা দিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় এ রকম চিন্তা আছে নিশ্চয়ই। এ স্লোগানের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে। আজ (শনিবার) বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করবে ক্ষমতাসীন দলটি। সামনে আরও কিছু কর্মসূচি পালন করবে। এর বিপরীতে বিএনপিও হয়তো পাল্টা কর্মসূচি দেবে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হবে। রাজনীতিকে সহিংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা আরও জোরালো হবে। কিন্তু আমি হতবাক, বিস্মিত। এ রকম একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক স্লোগানের পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই! তাঁরা তাঁদের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের তিরস্কার করেননি। এ ধরনের স্লোগান যে কোনো রাজনৈতিক কর্মীর ভাষা হতে পারে না, তা বলেননি। ছাত্রদলও এ রকম আপত্তিকর স্লোগান প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। বরং বিএনপি নেতাদের অন্দরমহলে এ স্লোগান নিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ ও আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর এনেছে। কোনো কোনো নেতা এ দুর্বৃত্তদের বাহবাও দিয়েছেন বলে শুনেছি। এর অর্থ হলো ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্লোগান দিয়েছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিএনপির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের একটি প্রকাশ। একটি পরিবারে বাবা-মা যে ভাষায় কথা বলেন, তার প্রতিফলন ঘটে সন্তানদের মধ্যে। ঠিক তেমনি একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সিনিয়র নেতারা যে চিন্তা-চেতনা ধারণ করেন, ছাত্র এবং যুব সংগঠনগুলো মাঠে তারই বাস্তবায়ন করে।

‘৭৫-এর হাতিয়ার’ তাই কোনো বিচ্ছিন্ন, অতি উৎসাহীর আচমকা স্লোগান নয়। এটি বিএনপির একটি রাজনৈতিক দর্শন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এটি নজিরবিহীন, বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অন্যতম একটি জঘন্যতম ঘটনা। বিশ্বের সুস্থ চিন্তার কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি এ ঘটনা সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইতিহাসের এ নিকৃষ্টতম ঘটনাকে সমর্থন করাই হলো বিএনপির অন্যতম নীতি। জাতির পিতা হত্যাকান্ডের পর খুনি মোশতাক এ হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। জিয়া সে অধ্যাদেশ কেবল বহালই রাখেননি; খুনিদের বিদেশে কূটনৈতিক চাকরি দিয়েছেন। এসব খুনিকে জিয়া ‘সূর্যসন্তানে’র খেতাব দিয়েছিলেন। ’৯১ সালে বিএনপি বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসে। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের অনুরোধ করা হয়েছিল। বেগম জিয়া সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বেগম জিয়ার সরকার খুনিদের চাকরিচ্যুত করেনি। পদোন্নতি দিয়েছে। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এর পরই জাতির পিতা হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। প্রচলিত আইনে বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নিম্ন আদালতে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ের দিন বিএনপি দেশব্যাপী হরতাল পালন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হন আইনমন্ত্রী। বিচারপতির শূন্যতা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় বেগম জিয়ার সরকার। শুধু তাই নয়, আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে যারা কূটনৈতিক চাকরি করত, তাদের চাকরি চলে গিয়েছিল হত্যা মামলার জন্য। কিন্তু বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে তাদের আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এ ঘটনাগুলোর উল্লেখ করলাম এজন্য যে, ’৭৫-এর ঘৃণ্য হত্যাকান্ডকে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক প্রবণতা বিএনপির মধ্যে প্রোথিত। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। তবে শুধু জিয়া নন, গোটা বিএনপিই ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। এজন্যই বিএনপি খুনিদের দুধভাতে রেখেছিল। বিচার হতে দেয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেনি। রায়ের দিন হরতাল ডেকেছে। ক’বছর আগেও শোকাবহ এই দিন বেগম জিয়া কেক কেটে পৈশাচিক উৎসব করেছেন।

বিএনপি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টকে শুধু সমর্থন করে না, আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতেও চায়। অতীতেও বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন কথাবার্তায় আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর হীন অভিপ্রায় উচ্চারিত হয়েছিল। বিএনপি অবশ্য শুধু কথায় নয়, কাজেও ’৭৫ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট। ওই দিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সেদিন সৃষ্টিকর্তার কৃপায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার ছাত্রদলের করিৎকর্মা নওজোয়ানরা অবশ্য ১৫ আগস্ট ঘটানোর সেøাগান তোলেনি। তারা বলেছে ’৭৫-এর হাতিয়ারের কথা। ১৫ আগস্ট এবং ’৭৫-এর হাতিয়ার- কথা দুটির পার্থক্য অনেক। ১৫ আগস্ট ছিল একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। আর ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো ১৫ আগস্ট ঘটানোর উপকরণ। ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো সেসব উপকরণ বা অস্ত্র-কৌশল যা দিয়ে বাঙালি জাতিকে অভিভাবকহীন করা হয়েছিল। কী ছিল এ উপকরণে? আমার বিবেচনায় ’৭৫-এর হাতিয়ার ছিল মোটা দাগে পাঁচটি। প্রথম উপকরণ ছিল পাকিস্তানে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি এজেন্ট বা চরদের নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। এরা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর এক অবাস্তব নীলনকশার এরা ছিল বাস্তবায়নকারী। এরা হত্যাকান্ড ঘটায়। ’৭৫-এর দ্বিতীয় হাতিয়ার ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। জাতির পিতা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবতার নেতা। বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আলোড়িত হয়েছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেয়েছিল। এজন্য তারা পাকিস্তানপন্থিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডে আন্তর্জাতিক মদদ ছিল। এ হত্যাকান্ডে তারাই সমর্থন দিয়েছিল যারা এখন মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। ’৭৫-এর তৃতীয় হাতিয়ার ছিল পাকিস্তানপন্থি প্রশাসন। গুটিকয় মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সব ছিল পাকিস্তানিদের পদলেহী আমলা। এরাই বঙ্গবন্ধু সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য প্রশাসনের ভিতর থেকে কাজ করেছিল। চতুর্থ হাতিয়ার ছিল দলের বিশ্বাসঘাতকরা। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ আগস্ট ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছিল। এরা দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এরা চাটুকারিতা আর তোষামোদ করে জাতির পিতাকে ঘিরে রেখেছিল। আর শেষ হাতিয়ার বা উপকরণ ছিল কাপুরুষ নেতৃত্ব এবং বিভ্রান্ত কর্মীরা। এ কাপুরুষ অক্ষম নেতৃত্ব অস্ত্রের ভয়ে সুড়সুড় করে বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কিংবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মতো দু-এক জন বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর প্রতিবাদ ছিল সশস্ত্র। আর সিরাজুল হকের প্রতিবাদ ছিল কণ্ঠ। এ পাঁচ সূত্র একবিন্দুতে মিলিত হয়ে মরণঘাতী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। যে হাতিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করে। ’৭৫-এর হাতিয়ার কেবল একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া কিছু বুলেট নয়। এটি বাঙালির অস্তিত্ব অর্জনকে তছনছ করে দেওয়ার এক মারণাস্ত্র।

’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে বাংলাদেশকে ধ্বংসের এক বিস্ফোরক। তাহলে ছাত্রদলের স্লোগানের মাধ্যমে বিএনপি কি বাংলাদেশ ধ্বংসের বার্তা দিল? বিএনপি কি তাহলে বাংলাদেশের সব অর্জন লন্ডভন্ড করে দেওয়ার মারণাস্ত্র বানাচ্ছে? পাঁচ উপকরণকে একবিন্দুতে মেলাতে চাইছে? এটা যে বিএনপি চাইছে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিএনপির ষড়যন্ত্রের কিছু কিছু আলামত এখন দৃশ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় জোর করেই বাংলাদেশের সব বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। পিটার হাস নতুন রাষ্ট্রদূত হয়ে এ দেশে আসার পর যেন দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। আজ গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠান তো কাল ডিক্যাবের সঙ্গে মতবিনিময়। সব জায়গায় তিনি রীতিমতো শাসাচ্ছেন বাংলাদেশকে। এ অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গুলিতে মারা যাচ্ছে নিরীহ নাগরিক। কদিন আগে টেক্সাসে স্কুলে হামলা হলো। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ওকলাহোমায় মেডিকেল সেন্টারে হামলা। কোনো দেশ বলে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকের জীবন হুমকির মুখে। যে দেশে নাগরিকদের জীবন এত অনিশ্চিত তারাই কি না বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আহাজারি করে।

প্রশাসনে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রেতাত্মারা। এরা বিভিন্ন কাজকর্মে সরকারকে বিব্রত করছে। এদের কারণে জিনিসপত্রের দাম অযাচিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রশাসনের ভিতরে বসে এরা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রশাসনে ছদ্মবেশী মতলববাজ হঠাৎ আওয়ামী লীগ বনে যাওয়া আমলারা এখন যেন একেকটা গ্রেনেড। আওয়ামী লীগেও এখন সুযোগসন্ধানী এবং হঠাৎ বনে যাওয়া নেতাদের দাপট। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতরা কোণঠাসা সর্বত্র। তৃণমূলে বিভক্তি এবং হতাশা। এর মধ্যে কিছু কিছু উঠতি পাতিনেতা এমন সব কর্মকান্ড করছেন যাতে সরকার এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। মন্ত্রিসভা যেন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, টেকনোক্র্যাটের সমাহার। সব কথা শেখ হাসিনাই বলছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যগুলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কতটা উদ্দীপ্ত করে জানি না। সাধারণ মানুষ তাঁর কথায় চমকিত হয় না। এত পোড় খাওয়া, যুদ্ধ করা নেতাকে কেন কাগজ দেখে দেখে কথা বলতে হবে? আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশ কম করছেন না। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলগুলো মন্ত্রীদের সভা-সমাবেশ-সেমিনারে মুখরিত থাকে। এর মধ্যে ড. হাছান মাহমুদ, শ ম রেজাউল করিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, এনামুল হক শামীম আর খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ছাড়া আর কজন মন্ত্রী রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন? মন্ত্রীরা এখন বড় আমলায় পরিণত হয়েছেন। তাঁরা যেন একটি মূল্যবান চাকরি পেয়েছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে বিতর্কিত হতে চান না।

এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে দেশ আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকে বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এ দাবি তুলতেই পারে। এ দাবি নিয়ে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করছে। এতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু যেভাবে এখন দলটি তাদের ছাত্র এবং যুব সংগঠনকে মারমুখী করে তুলেছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ শঙ্কা আরও বাড়ে যখন ’৭৫-এর হাতিয়ার স্লোগান ওঠে। আর এ স্লোগান উপেক্ষা করা যায় না যখন চারপাশে ষড়যন্ত্রের খেলা আলো-আঁধারিতে উন্মোচিত হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে কি তাহলে বিএনপির একটি লাশ প্রয়োজন? একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতির পূর্বাভাস পেয়েই কি কোনো কোনো পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে? এজন্যই কি সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় মাতম উঠেছে? এ কারণেই কি ভরা মৌসুমে চালের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে? সবকিছুই কি ’৭৫-এর জংধরা হাতিয়ার সচল করার সম্মিলিত প্রয়াস? ’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেতাদের ড্রয়িংরুমের গোপন কথা জেনে ফেলা ছাত্রদল অতি উৎসাহী হয়ে স্লোগানের আকারে তা প্রকাশ করেছে। ছাত্রদলের মিছিলে এ স্লোগান আরেকবার প্রমাণ করল, বিএনপি আসলে ’৭৫-এর মতো ঘটনা ঘটিয়ে এ সরকারকে হটাতে চায়। জনগণ, নির্বাচন কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, ষড়যন্ত্রই বিএনপির প্রধান অস্ত্র। এটাই তাদের ’৭৫-এর হাতিয়ার। এখন প্রশ্ন হলো, ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’- এ স্লোগানের মর্মবাণী কি আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে? যদি করে থাকে তাহলে সরকারের ভিতরে-বাইরে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে। আর মর্মবাণী উপলব্ধি না করলে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

৭৫-এর হাতিয়ার   রাজনীতি   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের সাজা প্রায়শ্চিত্ত, বিএনপির মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৬ মে, ২০২৪


Thumbnail

শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?

আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।

আরও পড়ুন:  আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত। ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।

গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।

আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে। এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল। যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।

আরও পড়ুন:  প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি

২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান। চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়, তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই। দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই। সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।

শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com

 


আওয়ামী লীগ   বিএনপি   জাতীয় সংসদ নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কমে গেল কাদেরের দাপট?

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ০২ মে, ২০২৪


Thumbnail

ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এমন একজন নেতা যিনি ওবায়দুল কাদেরের এই সিদ্ধান্ত মানেননি। সিদ্ধান্ত না মেনে তিনি ধানমণ্ডি ৩ নম্বর কার্যালয়ে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের তোপের মুখে পড়েন। ওবায়দুল কাদের তাকে বলেন, আপনি তো দলের কোন সিদ্ধান্তই মানেন না। কিন্তু তার পরও শাজাহান খান তার ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে রাখেন এবং দলের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন আশঙ্কার মধ্যেই তিনি উপজেলা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির সংবাদ সম্মেলনের পর দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদের যা বলেছেন এবং আওয়ামী লীগের যে সিদ্ধান্ত তার মধ্যে দুস্তর ফারাক রয়েছে। ওবায়দুল কাদের যেভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বাস্তবতা তা নয়। ওবায়দুল কাদের যত গর্জেছেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ তত বর্ষেনি। আর একারণেই এখন ওবায়দুল কাদেরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।


এমনিতেই আওয়ামী লীগে বেশ কিছুদিন ধরে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির বাইরে অন্য কোন নেতার কথা তৃণমূলের আওয়ামী লীগ বা মাঠ পর্যায়ের নেতারা মোটেও কর্ণপাত করেন না। তাদেরকে খুব একটা আমলে নেন না। তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে কথা। তিনি দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তি যখন বলছেন, সকলে ধরে নিয়েছিল যে, এটি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এবং ওবায়দুল কাদের এটিকে শেখ হাসিনার নির্দেশনা বলেই অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা একরামুল করিম চৌধুরী, শাজাহান খান এবং ড. রাজ্জাকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন এবং তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থিতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই তিনজনের কেউই ওবায়দুল কাদেরের কথায় কর্ণপাত করেননি। 

ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা অমান্য করে তারা প্রার্থী হওয়ার পর এখন দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের অবস্থানই এখন আর সঠিক নেই। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। অথচ ওবায়দুল কাদের একাধিক গণমাধ্যমে বলেছিলেন যে, ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই হয়নি। তাহলে কী ওবায়দুল কাদের বাড়িয়ে বলেছেন? 


কেউ কেউ দাবি করেন, যেহেতু একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সেহেতু ওবায়দুল কাদের বিষয়টিকে বড় করে দেখেছেন এবং তিনি নিজেই উপজেলা নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। কারণ তার নির্বাচনী এলাকায় যদি একরামুল করিমের সন্তানও উপজেলা চেয়ারম্যান হয় তাহলে তার এলাকায় আধিপত্য কমে যাবে। আর একারণেই হয়তো তিনি বিষয়টিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।

আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই মনে হয় যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতারা এই বিষয় নিয়ে গর্জে ছিলেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বিষয়টিকে অতটুকু গুরুত্বতর মনে করেন না। বরং তার প্রধান আগ্রহের ব্যাপার হলো উপজেলা নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। আর এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনা সবসময় যা বলেন সেটিরই পুনঃউচ্চারণ করেন এই বক্তব্যটি ঠিক না। শেখ হাসিনা আত্নীয় স্বজনদের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একই রকম বক্তব্য রাখেননি। আর এর ফলে ভবিষ্যতে ওবায়দুল কাদেরের হুশিয়ারি বা নির্দেশনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কতটুকু শুনবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন তাহলে কী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাপট কমে গেল?




ওবায়দুল কাদের   আওয়ামী লীগ   সাধারণ সম্পাদক  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন। 

আগামীকাল ৩০ এপ্রিল দলটির কার্যনির্বাহী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এবং এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল ৩০ এপ্রিলের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ৩০ এপ্রিল কি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধোঁকা খাবে? যারা ক্ষমতাবান মন্ত্রী-এমপি সংসদ সদস্য তারা তাদের সন্তানদেরকে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী করার ফলে তারা কি শাস্তি পাবেন? নাকি এবারেও তারা পার পেয়ে যাবেন? ৩০ এপ্রিল কি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হবে, নাকি ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ আবারো ধোঁকা খাবে। 

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যারা সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন, যারা স্বজনপ্রীতি করেছেন, যারা ভাই, ভাতিজা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, শ্যালককে প্রার্থী করেছেন তাদেরকে লাল কার্ড দেখানো হবে। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেহেতু কঠোর বার্তা দিয়েছেন সেহেতু তার কাছে নিশ্চয়ই ‘ট্রাম্প কার্ড’ আছে। আর এই এই ট্রাম্প কার্ড দেখানো হবে ৩০ এপ্রিল। দলের সিদ্ধান্ত যারা লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। 

আওয়ামী লীগের জন্য ৩০ এপ্রিল দিনটি অত্যন্ত প্রতারণামূলক এবং ধোঁকা খাওয়ার দিন হিসেবেই পরিচিত। ঠিক কুড়ি বছর আগে এই ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ধোঁকা খেয়েছিলো। তখন পাদপ্রদীপে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিলের আগে প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে আসতেন এবং কিভাবে সরকারের পতন হবে সেবিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতেন। ৩০ এপ্রিলের আগে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সে কর্মসূচি গুলোর মাধ্যমে সরকার পতনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিল ম্যাজিক দেখাবেন বলেই বারবার ঘোষণা করছিলেন। তার কাছে ট্রাম্প কার্ড আছে এমন বক্তব্য তিনি রেখেছেন একাধিকবার। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কিছুই হয়নি বরং আওয়ামী লীগই অসম্মানিত হয়েছে। 

সাধারণ মানুষের কাছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি হাস্যকর হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের গ্লানি আওয়ামী লীগকে বহুদিন বহন করতে হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ৩০ এপ্রিল নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কম টিটকারি করেনি। আবার একটা ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্য নির্ধারণের দিন। এবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই পাদপ্রদীপে। ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি ৩০ এপ্রিল আবারো আওয়ামী লীগ ধোঁকা খাবে। গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবাই নেতা হয়ে গেছেন, কেউ কাউকে মানছেন না। তবে একটা আশার ব্যাপার ছিলো। সকলে মনে করতেন যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ঐক্যের প্রতীক। তাকে সকলে মানেন এবং তার কথার কেউ অবাধ্য হবেন না। 

২০০৭ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ এবং কোন্দলকে প্রশ্রয় দেয়া হতো একটি চিন্তা থেকেই। সেটি হলো আওয়ামী লীগে যে যত গ্রুপই থাকুক না কেন, যে যত পক্ষই করুক না কেন তারা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে। শেখ হাসিনা যা বলবেন সেটি তারা মানবেন। শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা। আর বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপগুলো তাকিয়ে থাকতো শেখ হাসিনার দিকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা আস্থা স্রেফ কথার কথা। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা যেটি বলেন সেটি আসলে বাস্তবে করেন না। শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেন। আর এটিই আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কার এবং উদ্বেগের বিষয় বলে আমি মনে করি। কারণ যদি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেও নেতারা অমান্য করে তাহলে দলের অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। আওয়ামী লীগ আসলে এবার সে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেই আওয়ামী লীগের ভিতর একটা ‘ফ্রি স্টাইল’ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যে যার মতো, যেমন খুশী বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সে বক্তব্যের কোন জবাবদিহিতাও ছিল না। একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও কেন্দ্রীয় সদস্যকে গালাগালি করেছেন, একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন। এটি আওয়ামী লীগে হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০১৮ এর পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ মুখোমুখি হয়েছে, হানাহানি করেছে, একে অন্যকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। এঘটনাগুলো যখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে তখনও আওয়ামী লীগের নেতারা নির্লিপ্ত ছিলেন। সারাদেশেই আওয়ামী লীগ দুই তিন ভাগে বিভক্ত। এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। যার ফলে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। 

২০২৪ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তটি ছিলো, দলের প্রতীক না পাওয়া ব্যক্তিরা দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবে। আর এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি-কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো এই বিভক্তি এবং কোন্দলগুলো দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বারবার নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করেও এ ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে যে, এই কোন্দল এবং বিভক্তি কমেনি। বরং বেড়েছে। এই কোন্দল বিভক্তি থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল আরেক সমস্যা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ এলাকায় জমিদারতন্ত্র কায়েমের মিশনে নেমে পরলো। তারা তাদের নিজেদের ভাই-ব্রাদার আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থী করে এলাকাগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মিশনে ঝাপিয়ে পরেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, উপজেলা নির্বাচনে কোন মন্ত্রী এমপি তার আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করতে পারবেন না। 

ধারণা করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের প্রতি সকলে সম্মান দেখাবেন। সকলে না দেখাক অন্তত যারা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতা, যারা মন্ত্রিত্বে আছেন কিংবা তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। তারা নিজেদের স্বার্থকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ভাই, সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থীতা থেকে সরে আসার অনুরোধ প্রত্যাখান করেছেন। তার মানে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা শ্রদ্ধা করেন না, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মানেন না। তারা দলকে বিকশিতও করতে চান না। এধরনের ব্যক্তিরাই যে আওয়ামী লীগে এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সেটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি এসেছে, আওয়ামী লীগ এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারী এবং দলের স্বার্থ পরিপন্থি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার বলছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল আসলে কি হবে? ৩০ এপ্রিল কি কুড়ি বছর আগের মতো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ধোঁকা খাবে? 

২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল যেমন আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের কর্মীরা অন্ধকারে ছিল। কি হবে তারা জানতেন না। তাদের জন্য কোন নির্দেশনা ছিলো না। রাজপথে নামার জন্য তাদেরকে কোন আহ্বান জানানো হয়নি। তারা বুঝতে পারেননি যে, কিভাবে সরকারের পতন ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের পতন ঘটেনি। ঠিক তেমনি এবারের ৩০ এপ্রিলও আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অন্ধকারে। তারা জানেন না ওবায়দুল কাদের কি ব্যবস্থা নিবেন এবং আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা। কারণ এর আগেও দেখা গেছে যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন তাদের খুব কম লোকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবান, স্বার্থান্বেষী এবং স্বজনপ্রীতি করা নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ কি পরাজিত হবে, নাকি সত্যি সত্যি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ কী ঘুরে দাড়াবে নাকি তৃণমূল প্রতারিত হবে। এই প্রশ্নটি এখন সবার সামনে বড় হয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সমস্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগের ভিতরে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক, শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার নির্দেশই যদি নেতারা অমান্য করেন তাহলে তাদের নেতৃত্বে থাকা উচিত? 

একটা কথা খুব স্পষ্ট, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য না। আওয়ামী লীগ যদি কঠোরভাবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তাহলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়বে, সাংগঠনিক শক্তি হারাবে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নাজুক অবস্থা নগ্নভাবে প্রস্ফুটিত হবে। যদি আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তাহলেই দলটি ঘুরে দাড়াবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। দেশে কোন বিরোধী দল নেই। সেই কারণে আওয়ামী লীগ একটা স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় আছে এবং কোনরকম চাপ অনুভব করছে না। কিন্তু যদি সংগঠন না থাকে, সংগঠন যদি এরকম হতশ্রী অবস্থায় চলে যায় তাহলে দুর্বল সংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কী টিকে থাকতে পারবে। এই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগকেই খুঁজতেই হবে।  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিএনপি কি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল। বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।

কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত। ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী। অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।

বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না। জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।

বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে উত্তর নেই।

খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী? নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে।

জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা। আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।

এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি, আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।

আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন, দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   জিয়া   পরিবারমুক্ত  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন